নজরুল
❝ যদি আর বাঁশি না বাজে❞
❝বন্ধুগণ, আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন তা আমি মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনুমন প্রাণ আজ বীণার মতো বেজে উঠেছে, তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বনিত হয়ে উঠেছে-আমি ধন্য হলুম, আমি ধন্য হলুম। আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেই দিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভাল লেগেছে।
বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্ম গ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তুর্য বাদকের একজন আমি, এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই, শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই, আমি সকল দেশের সকল মানুষের। কবি চায়না দান, কবি চায় অঞ্জলী, কবি চায় প্রীতি।
কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ। সুন্দরকে স্বীকার করতে হয়, যা সুন্দর তাই দিয়ে। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তব গানই আমার ধর্ম। তবু বলছি, আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তার চোখে চোখ ভারা জলও দেখেছি। শ্বশানের পথে, গোরস্থানের পথে তাকে ক্ষুধা দীর্ন মুর্তিতে ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি। যুদ্ধ ভূমিতে তাকে দেখেছি, কারাগারের অন্ধকূপে তাকে দেখেছি, ফাঁসির মঞ্চে তাকে দেখেছি।
আমাকে বিদ্রোহী বলে খামাখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এই নিরীহ জাতটাকে আছড়ে-কাঁমড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোন দিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি বিদ্রোহের গান গেয়েছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অত্যাচারের বিরুদ্ধে। যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন, পচাঁ, সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নামে ভন্ডামী ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।
কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেই বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই নয়। আমি কেবলমাত্র হিন্দু মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডসেক করাবার চেষ্ঠা করেছি। গালাগালিকে গলাগলিতে পরিনত করার চেষ্ঠা করেছি। সে হাতে হাত মেলানো যদি হাতাহাতির চেয়ে অশোভন হয়ে থাকে তাহলে ওরা আপনিই আলাদা হয়ে যাবে। আমার ঘাটছড়ার বাঁধন কাঁটতে তাদের কোনও বেগ পেতে হবে না। কেননা, একজনের হাতে আছে লাঠি, আরেক জনের আস্তিনে আছে ছুড়ি।
হিন্দু মুসলমানে দিন রাত হানাহানি জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ যুদ্ধ বিগ্রহ, মানুষের জীবনের একদিকে কঠোর দারিদ্র-ঋণ-অভাব, অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তুপের মত জমা হয়ে আছে। এই অসাম্য ভেদ জ্ঞানকে দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্য, সংগীতে কর্মজীবনে অভেদ সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম।
আমি যশ চাইনা, খ্যাতি চাইনা প্রতিষ্ঠা চাইনা নেতৃত্ব চাইনা। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক আনন্দের গান, বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাবো নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে, সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা।
রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন, “দেখ উন্মাদ তোর জীবনে শেলীর মত, কীটসের মত খুব বড় একটা ট্র্যাজেডি আছে-তুই প্রস্তুত হ। ”জীবনের সেই ট্র্যাজেডি দেখবার জন্য কতদিন অকারণে অন্যের জীবনকে অশ্রুর বর্ষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি। কিন্তু আমার জীবন রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভূমির মত তপ্ত।❞
❝যদি আর বাঁশি না বাজে- আমি কবি বলে বলছিনে, আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি-আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চির দিনের জন্য বিদায় নিলাম।
যে দিন আমি চলে যাব সেদিন হয়তো বা বড় বড় সভা হবে, কত প্রশংসা কত কবিতা বেরুবে হয়ত আমার নামে, দেশপ্রেমিক-ত্যাগীবীর-বিদ্রোহী বিশেষণের পর বিশেষণ, টেবিল ভেঙ্গে ফেলবে থাপ্পর মেরে, বক্তার পর বক্তা। এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে-বন্ধু তুমি যেন যেওনা। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ করো, তোমার ঘরের আঙ্গিনায় বা আশেপাশে যদি একটা ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও সেইটিকে বুকে চেপে বলো, বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি-
তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু
আর আমি জাগিব না
কোলাহল করি সারা দিনমান
কারো ধ্যান ভাঙ্গিব না
নিশ্চুল-নিশ্চুপ আপনার মনে
পুড়িব একাকী
গন্ধ বিধুর ধূপ❞
❝ যদি আর বাঁশি না বাজে❞
Comments
Post a Comment