রবীন্দ্রনাথ
বসন্তোৎসব, শান্তিনিকেতন, রবীন্দ্রনাথ : কিছু কথা...
রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, উৎসব হোক মানুষের অনাড়ম্বর মিলন। বাঙালি তাকে 'স্পেকট্যাকল' করে তুলেছে। যেমন, বসন্তোৎসবের শান্তিনিকেতন।
মান্য ইংরেজি অভিধান খুললে স্পেকট্যাকল শব্দের একটা মানে পাওয়া যাবে : স্পেশালি প্রিপেয়ারড অর অ্যারেঞ্জড ডিসপ্লে। চতুর্দশ শতাব্দী থেকেই এই অর্থ চালু। এর মূলে আছে লাতিন spectaculum, তা আবার এসেছে spectare থেকে। অর্থ দেখা। অর্থাৎ বিশেষ ভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে যখন কোনোও একটা দৃশ্য তৈরি করা হয় আর দর্শকরা যখন তা দেখে আনন্দ পান, তখন তা স্পেকট্যাকল হয়ে ওঠে। যেমন বুলফাইট, সার্কাস, এ সব। নির্মিত আমোদপ্রদায়ী দৃশ্যের আবার নানা গাঁইগোত্র। কোনওটা জাত বিচারে কুলীন, কারও আবার সেই মর্যাদা নেই। উচ্চবংশীয় সম্পন্ন ভদ্রলোকরা যা দেখে আমোদ পেতেন, নিম্নবংশীয়রা তা দেখে আমোদ পেতেন না। উনিশ শতকে শহরের, বিশেষ করে কলকাতায় যাত্রা, কবিগান দেখে সাধারণের কী আহ্লাদ - সাত বছরের বাচ্চা থেকে জরাক্রান্ত বাহাত্তর, কেউ বাদ যান না। বাবু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এ সবে ঘোর বিরক্ত, আরক্তও। পারলে চোখ-নাক-কান চাপা দেন।
সে কালের কথা থাক, এ কালের কথায় আসি। এ কালের শহর কলকাতা যে কত স্থাবর-অস্থাবর দৃশ্যের জন্ম দিয়েছে তা বলার নয়। ইংরেজ আমলের নকশা পিছনে ফেলে জেগে উঠেছে বিশ্বায়িত ইভেন্টফুল কলকাতা। দেখে থ হয়ে যাওয়ার মতো জিনিসের সেখানে অভাব নেই। আর হুজুগে বাঙালি তো দেখতে মাততেই চায়। দেখায় তাকে কলকাতা কমলালয়। পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলার লোকজন কলকাতায় এসে অবাক হতে পারলেই খুশি। কলকাতাবাসীও পারলে কেমন দেখালাম বলে কলার তুলে ঘোরেন। কলকাতার দেখাদেখি পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য অঞ্চলও এই দেখনদারিত্বে মেতে উঠেছে। তবে কলকাতার এই দেখনদারিত্বের দাপট থেকে বাঙালির দুটো উৎসব এখনো মুক্ত। বসন্তোৎসব ও পৌষমেলা। একটি প্রাকৃতিক উৎসব, অন্যটি অর্থনীতি-নির্ভর। সেখানে যেন শান্তিনিকেতন দেখাচ্ছে, আর কলকাতা বা অন্যরা দেখছে। পৌষমেলা কয়েক দিনের উৎসব। ফলে কলকাতা বা অন্যদের ভিড় শান্তিনিকেতনের পথে পথে নানা দিনে ভেঙে যায়। দোল তো এক দিনের। ভিড় সে জন্য বেশি, পারলে গোটা কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ শান্তিনিকেতনে দোলের স্পেকট্যাকল দেখতে উঠে আসে। এই দিনটিতে কলকাতা, সঙ্গে গোটা পশ্চিমবঙ্গ শান্তিনিকেতনমুখো। গাড়িতে, ট্রেনে দলে দলে ঝুলে বসে দাঁড়িয়ে শুয়ে যে যে-ভাবে পারছেন আসছেন। আসছেন দেখতে - কোপাই, খোয়াই, আশ্রম মাঠের অনুষ্ঠান। গাড়িতে গাড়িতে ছয়লাপ, জনারণ্য - বাসন্তিক জমায়েত। আর দোল যদি উইকএন্ডে পড়ে, তা হলে তো কথাই নেই।
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য বরাবরই কলকাত্তাইয়া স্পেকট্যাকল-মত্ততার বিরোধী। তাঁর জন্ম কলকাতায়, কিন্তু কলকাতার বাবুয়ানা আর আদেখলাপনা, যা একটি অন্যটির প্রতিক্রিয়া, তা রবীন্দ্রনাথ একেবারেই ভালোবাসতেন না। বানিয়ে তোলা দর্শনযোগ্য দৃশ্য, তা যাঁরাই তৈরি করুন না কেন, তা তাঁর পছন্দ হয় না - কী রাজনীতি, কী সংস্কৃতি, কী সমাজ, সব ক্ষেত্রেই। নাট্যমঞ্চে পাবলিক থিয়েটারে বহু টাকা খরচ করে দর্শক ভোলানো রোমাঞ্চকর সব দেখার মতো সিন তৈরি হয়। রবীন্দ্রনাথের মনে হয় এ সব বাজে খরচ, বিলেতের নকল, বহুমূল্য জঞ্জাল। ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কৌশল। নায়িকা জলে ঝাঁপ দেবে, তা দেখানোর জন্য মঞ্চে স্প্রিং দেওয়া বিশেষ দরজা। দেখে সাধারণের তাক লেগে যায়, পরিণত রবীন্দ্রনাথ মনে করেন এই জাতীয় আপাত তাক লাগানো দৃশ্য উৎপাদনকারী রঙ্গমঞ্চ দর্শকের সঙ্গে নাটকের এক রকম দূরত্ব গড়ে তোলে। ঠিক একই রকম দূরত্ব মঞ্চকাঁপানো রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের। হাততালির পর্ব মিটে গেলে, মুগ্ধতার নেশা কেটে গেলে মানুষ ও দর্শকের ঝুলি শূন্য। 'ঘরে বাইরে' উপন্যাসে বিমলার খানিক এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সন্দিপ ও তার রাজনৈতিক বক্তৃতার দৃশ্যে বিমলা প্রথমে অভিভূত, তার পর আশা ভঙ্গ।
রাজনৈতিক আর সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ দেখনদারির বদলে যে বিকল্প হাজির করতে চেয়েছিলেন, তাকে বলা চলে অংশগ্রহণ। জনগণ সেখানে নিতান্ত দর্শক হয়ে থাকবেন না, দেশনায়ক ও নাট্য-অভিনেতা দর্শকের থেকে আলাদা মঞ্চে অবস্থান করবেন না। দু'পক্ষের মধ্যে ভেতর থেকে যোগ তৈরি হবে। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ বক্তৃতা না দিয়ে গান লিখেছিলেন। লোকায়ত বাউলের সুর ব্যবহার করে গড়ে তোলা সেই গানগুলি সাধারণ মানুষ গলা মিলিয়ে গাইতে পারতেন, গাইতে গাইতে পথে নামতে পারতেন ও হিন্দু-মুসলমান পরস্পরের হাতে বেঁধে দিতে পারতেন রাখি। এখানে কেউ কারও দৃশ্যবস্তু নন, সহযাত্রী। নাটকেও তিনি মঞ্চ আর দর্শকের মাঝখানের দেওয়াল ভেঙে দেন সামাজিক ও প্রাকৃতিক উৎসবের বেলাতেও। রবীন্দ্রনাথের আশ্রম বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি সামাজিক ও প্রাকৃতিক উৎসব গড়ে উঠেছিল। তাতে অর্থের অপচয় নেই, আড়ম্বর নেই, শ্রী ও নান্দনিকতা আছে। আশ্রমের মানুষেরা নাচে-গানে-নান্দনিকতায় এই সব উৎসবে অংশ নিতেন। পার্শ্ববর্তী পল্লিসমাজও ব্রাত্য ছিল না। বাঙালি যদি উৎসবের এই রীতি গ্রহণ করত, তা হলে দিনবিশেষে শান্তিনিকেতনে এলাহি ভিড় জমাতে হত না। নিজের মতো করে যে যেখানে থাকেন, সেখানেই অনাড়ম্বর ভাবে পরস্পর মিলতে পারতেন।
রবীন্দ্রনাথের বসন্তের গানে কান পাতলে টের পাওয়া যায় সেখানে গৃহবাসীকে দ্বার খুলতে বলা হয়েছে। জলে-স্থলে-বনতলে দোল লাগলে ঘরে থাকাও সাজে না, দূরে থাকাও মানায় না। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "বসন্তে সমস্ত বনে-উপবনে ফুল ফুটিবার সময় উপস্থিত হয়; তখন তাহাদের প্রাণের অজস্রতা, বিকাশের উৎসব।... মানুষই কি কেবল এই অজস্রতার স্রোত রোধ করিবে। সে আপনাকে ফুটাইবে না, ফলাইবে না, দান করিতে চাহিবে না; কেবল ঘর নিকাইবে, বাসন মাজিবে ও যাহাদের সে বালাই নাই তাহারা বেলা চারটে পর্যন্ত পশমের গলাবন্ধ বুনিবে।" একে অন্যের সঙ্গে বিনিময়ের পথ প্রশস্ত হোক, এই ছিল কবির উদ্দেশ্য। কিন্তু সে আর হল কোথায়! নিজেকে বিশেষ ভাবে ফলানো ও ফোটানোর জন্য বাঙালির শান্তিনিকেতনে যাত্রা। দল বেঁধে দেখার উল্লাস।
যেখানে যা করা বা বলা মানায় না, তা বলা বা করা গ্রাম্যতা। অন্য গ্রাম শহরে গিয়ে তা করে ফেলে বোকা বনে যায়। আর গ্রাম-শহরের মধ্যে 'আমি শহরের লোক' বলে এক রকম গর্বও মিশে থাকে। ফলে সে গ্রাম্যতা গর্বিত, বাহারে ও ক্ষতিকর। দোলের সময় ও দোল-পরবর্তী শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি ও পরিবেশ নগর জীবনেরর প্লাস্টিক ও বোতলের ভগ্নাবশেষ বহন করে। গাছেরা ফুল গোঁজার শিকার হয়। জিনিসপত্রের দাম গ্রাম শহুরে বাবুদের দেখানোপনায় তুঙ্গে। নাচে-গানে সহজ অংশগ্রহণের বদলে বেসুর বেতালার হুজুগ। অংশগ্রহণের উৎসব নিতান্ত স্পেকট্যাকল দেখার উল্লাসে রূপান্তরিত।
Comments
Post a Comment