রেবা রক্ষিত

☘️| বুকে যার ‘একশো হাতির’ বল |☘️

দেহের ওজন উনিশটি মণ না হলেও এই বাঙালি কন্যা ছাতিতে হাতি উঠিয়ে দেশে বিদেশে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। বুকের ওপর হাতি তোলা হয়ে গিয়েছিল তার সকাল বিকালের অভ্যাস। নাম তাঁর রেবা রক্ষিত, হ্যাঁ ঠিকই পড়ছেন মহিলা এক বাঙালি বীরাঙ্গনাই বটে..💪🔥

১৯৩০ সালে পূর্ব বাংলার কুমিল্লার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম রেবার। ছোটবেলা থেকেই ডানপিটে মেয়ের ব্যাপক আগ্রহ ছিল খেলাধুলো শরীরচর্চার উপর। স্কুলে পড়ার সময়েই কলকাতায় চলে আসে তাঁর পরিবার। ভরতি হন এক যোগচর্চা কেন্দ্রে, নাম ‘‌জাতীয় ক্রীড়া ও শক্তি সংঘ’‌। সেখান থেকেই চলে আসা বিষ্টু ঘোষের আখড়ায়। তখন তাঁর বয়স মাত্র এগারো। প্রথম প্রথম কয়েকদিন গিয়েই পালিয়ে এসেছিলেন। ভয়ে পেয়েছিলেন মেয়ে হয়ে তাঁর চেহারা ষণ্ডামার্কা হয়ে যাবে। দাদু বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার নিয়ে যান। বিষ্টুবাবু কথা দিয়েছিলেন নাতনিকে ষণ্ডা নয় কিন্তু এমন চেহারা বানিয়ে দেবেন যে হাতির মতো হবে তাঁর শক্তি। অথচ চেহারা থাকবে একেবারে সাধারণ।

পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিক থেকেই রেবা সার্কাসে খেলা দেখাতে শুরু করেন। জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা এখান থেকেই। বিষ্টু ঘোষের হাত ধরে বুকের উপর দিয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে নেওয়া রপ্ত করে ফেলেছিলেন সহজেই। এরপরে যোগ শিক্ষকের মনে হয় ছাত্রী হাতি তুলতে পারে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখার। শহরে তাঁবু ফেলা এক সার্কাসের মালিকের সঙ্গে কথা বলে শো’য়ের ব্যবস্থা করে ফেলেন। ট্রায়ালে ঠিক হয় পঞ্চাশ–‌ষাট মন ওজনের বাচ্চা হাতি রেবার বুকের উপর দিয়ে হেঁটে যাবে। ট্রায়ালে পাশ। এরপর ফাইনাল শো। বাড়ির সমস্ত বাধা ছুঁড়ে ফেলে মেয়ে চলে গেল বুকে হাতি তুলতে। বিশাল হাতি চলে গেল অথচ নির্বিকার রইল মেয়ে। যেন কিছুই হয়নি। ‌

খবর চাউর হয়ে যায়, একটা মেয়ে নাকি বুকে হাতি তুলছে। তৎকালীন দি গ্রেট বোম্বে সার্কাস থেকে ডাক আসে। প্রথমে বাড়ির লোকজন কিছুতেই রাজি ছিলেন না, পরে মেনে নেন। সার্কাস দলের হয়ে ঘুরলেন দেশ বিদেশ। বোম্বের সেই সার্কাস দল কলকাতায় তাঁবু ফেলল। ‘‌শো’‌ দেখতে এসেছিলেন রাজ্যের প্রথম স্পিকার শৈল মুখার্জী। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন, বাঙালি মেয়ে বুকে হাতি তোলার আজব খেলা দেখবে বলে।

রেবার চেহারা দেখে বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন স্পিকার, মানা করেছিলেন এ খেলা দেখাতে। একসময় হাতি এলো দুলকি চালে। হেঁটে চলে গেল মেয়ের বুকের উপর দিয়ে। সাধারণ ভাবেই উঠে দাঁড়ালো রেবা। নমস্কার করে মঞ্চ থেকে নামতেই শহরে হই হই কাণ্ড। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। হাতি তোলা হয়ে গিয়েছিল তার সকাল বিকালের অভ্যাস। ছুটির দিনে তিন বেলা হাতির শো। নেপালের মহারাজা অব্দি এই খেলা দেখতে এসেছিলেন।

১৯৫৪ থেকে ১৯৬২, টানা আট বছর একভাবে দেশ বিদেশে বুকে হাতি তোলার খেলা দেখাতেন যোগ বলে বলীয়ান মেয়ে। যেদিন হাতির খেলা থাকতো না,ফাঁকা যেত তাঁবু। একসময় চোখের কোনে রক্ত জমতে শুরু করেছিল। ডাক্তার বলে দিলেন হাতির খেলা বন্ধ না করলে কমবে না। ছেড়ে দিলেন সার্কাসে খেলা দেখানো। তখন তিনি ইন্টারন্যাশনাল সার্কাসে। হাতি তোলাই এনে দিয়েছিল তাকে “ পদ্মশ্রী ” সম্মান।

শেষ জীবনটা একরকম নীরবেই কেটেছে রেবার।  ২০১০ সালে মারা যান। সেটাও একেবারে নিঃশব্দে.. জানা যায়নি মৃত্যুর তারিখটাও।

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ