রবীন্দ্রনাথ
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও ভাইফোঁটার অনুষ্ঠান হত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'ভাইফোঁটা' অনুষ্ঠানের উষ্ণতা ও আন্তরিকতা খুবই পছন্দ করতেন। তিনি তাঁর ভগিনীদের কাছ থেকে ভাইফোঁটা নেবার সুযোগ থেকে কখনও বঞ্চিত হতে চাইতেন না। সৌদামিনী, শরৎকুমারী, সুকুমারী, স্বর্ণকুমারীর ও বর্ণকুমারী দেবীরা নানা সময়েই দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, সৌমেন্দ্রনাথ প্রমুখ দাদা-দের ভাইফোঁটার দিন ফোঁটা দিতেন এবং সেই পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন রবীন্দ্রনাথও।
স্বর্ণকুমারী দেবী রবীন্দ্রনাথ-কে খুবই স্নেহ করতেন এবং ভালোবাসতেন ও তাঁর আদরের ভাই-কে ফোঁটা দিয়েছেন। স্বর্ণকুমারী দেবী তাঁর কাব্যগ্রন্থ 'গাথা' তাঁর আদরের ভাই 'রবি'কে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন -
"ছোট ভাই'টি আমার
যতনের গাঁথা হার কাহারে পড়াব আর?
স্নেহের রবিটি, তোরে আয়রে পড়াই,
যেন রে খেলার ভুলে ছিঁড়িয়া ফেল না খুলে,
দুরন্ত ভাইটি তুই, তাইতে ডরাই।"
১৯৩৯ সাল। ছোড়দি বর্ণকুমারী এবং রবীন্দ্রনাথ ছাড়া পনেরো ভাই-বোনের আর কেউ বেঁচে নেই তখন। সাধ থাকলেও বর্ণকুমারী দেবীর সে বারে ফোঁটা দেওয়া হয়নি ভাইকে। কেননা ভাইফোঁটার আগেই রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো ছেড়ে ফিরে গিয়েছেন শান্তিনিকেতনে।
হতাশ বর্ণকুমারী লোক পাঠিয়ে চিঠিতেই আক্ষেপ জানিয়ে ভাইকে পাঠালেন ভাইয়ের পছন্দের সব জিনিসপত্র। তার সঙ্গে সঙ্গে আদরের ভাইটিকে নিষেধ করে দিলেন তিনি, প্রণামী পাঠাতে।
বর্ণকুমারী দেবীর চিঠি :-
২৭ কার্তিক, সন ১৩৪৬
ভাইটি আমার, শুনলুম তুমি জোড়াসাঁকোয় এসেছ। সেইখানে গিয়ে ভাইফোঁটা দেবো ভেবেছিলুম, কিন্তু হলো না। বিকেলে লোক পাঠালুম জানতে। সে এসে বল্লে, তিনি সকালে চলে যাবেন।
ধীরেন নামে একজন চেনা লোক পেলুম। তাকে দিয়ে সব আনিয়ে পাঠালুম কবির যা প্রিয় জিনিস তাই দিলুম। আমি বড়, তোমায় কিছু পাঠাতে হবে না। আশা করি তুমি ভাল আছ। ধানদূর্ব্বা ফুল দিয়ে আশীর্ব্বাদ করলাম কিন্তু দেখা হলো না এই দুঃখ।
ইতি বর্ণ
ছোড়দির এই চিঠি ও উপহারে দারুণ খুশি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি সে কথা ছোড়দিকে জানিয়েওছিলেন চিঠিতে।
রবীন্দ্রনাথের চিঠি :-
ওঁ
শান্তিনিকেতন
শ্রীচরণেষু
ভাই ছোড়দি, তোমার ভাইফোঁটা পেয়ে খুশি হয়েছি। আমাদের ঘরে ফোঁটা নেবার জন্যে ভাই কেবল একটিমাত্র বাকি আর দেবার জন্য আছেন এক দিদি। নন্দিনী তোমার প্রতিনিধিত্ব করেছে। আমার প্রণাম গ্রহণ করো।
ইতি
তোমার রবি
১৪/১১/৩৯
চিঠিটি লেখার মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ যেন বিশ্ববিখ্যাত কবি বা গুরুদেব নন, তিনি যেন তখন নিতান্তই এক অতি সাধারণ অথচ বিরাট পরিবারের ছোট এক ভাই।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে জানাই, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ সে বারে ফোঁটা নিয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথের পালিত কন্যা, নাতনি নন্দিনীর কাছে।
বর্ণকুমারী দেবীর কাছে রবীন্দ্রনাথ-কে ভাইফোঁটা দেওয়ার শেষবারের মতন সুযোগ আসে ১৯৪০ সালে। অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোতে আসেন ১৯৪০ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর। সেবারে ভাইফোঁটার দিন রবীন্দ্রনাথ অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠেন ও বর্ণকুমারী দেবী তাঁকে ফোঁটা দেন।
এটাই ছিলো কবি'র জীবনের শেষ ভাইফোঁটা। এই আবেগঘন অনুষ্ঠানের অসাধারন বর্ননা আছে রাণী চন্দ'র "গুরুদেব" বইটিতে।
"ভাতৃদ্বিতীয়া এল। গুরুদেবের এক দিদিই জীবিত তখন - বর্ণকুমারী দেবী। তিনি এলেন আশি বছরের ভাইকে ফোঁটা দিতে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। আজও ভাসে ছবি চোখের সামনে - গৌরবরন একখানি শীর্ণহাতের শীর্ণতর আঙুলে চন্দন নিয়ে গুরুদেবের কপালে কাঁপতে কাঁপতে ফোঁটা কেটে দিলেন। দুজন দুপাশ হতে ধরে রেখেছি বর্ণকুমারী দেবীকে। ফোঁটা কেটে তিনি বসলেন বিছানার পাশে চেয়ারে। ভাইয়ের বুকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। খুব রাগ হয়েছে দিদির ভাইয়ের উপরে। কালিম্পঙে গিয়েই তো ভাই অসুস্থ হয়ে এলেন, নয়তো হতেন না - এই ভাব দিদির। ভাইকে বকলেন, বললেন, দেখো রবি, তোমার এখন বয়স হয়েছে, এক জায়গায় বসে থাকবে, অমন ছুটে ছুটে আর পাহাড়ে যাবে না কখনো। বুঝলে?
গুরুদেব আমাদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন, বললেন, না, কক্ষনো আর ছুটে ছুটে যাব না; বসে বসে যাব এবার থেকে।
সকলের খিলখিল হাসিতে ঘর ভরে উঠল।"
#সংগৃহীত
Comments
Post a Comment