রবীন্দ্রনাথ
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী জুতোয় পা গলিয়ে ফিতে বাঁধতে বাঁধতে অভ্যেসমত রবীন্দ্রনাথ কে জিজ্ঞেস করলেন "রবিবাবু আপনার মেয়ে কেমন আছে? একটু ভালো তো"? বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বিদায় দিতে রবীন্দ্রনাথ দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসেছেন, শান্ত কণ্ঠে উত্তর দেন সে আজ মারা গেছে।
"কী বললেন!"
"রানী আজ মারা গেছে দুপুরে"। সবাই স্তুম্ভিত। তাদের হতবাক চোখে ঘোরাফেরা করে রবীন্দ্রনাথ -এর শান্ত মুখের দিকে। যেন কিছু ঘটেনি। অথচ ঐ চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা সম্ভব নয়।মাথা নীচু করে অতিথিরা দ্রুত প্রস্থান করলেন।
© ধ্রুবতারাদের খোঁজে
সন্তান-স্বজনের অকাল মৃত্যু শেলের মত বারবার বিদ্ধ করেছে রবীন্দ্রনাথের হৃদয়,মাত্র ন'মাসের ব্যবধানে রক্তাত্ব হৃদয়ে সহ্য করেছেন সহধর্মিণী ও ১২বছরের কিশোরী কন্যা রেণুর অকালমৃত্যু৷ পরপর মৃত্যুর ধাক্কায় রবীন্দ্রনাথ তখন বিপর্যস্ত। বেলার বিয়ের মাস না পেরোতেই রবি কবি তাঁর দ্বিতীয় মেয়ে রেণুর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিলেন বয়স তাঁর কম। তবু বিয়ের জন্য অস্থিরতার বড় কারণ সে একটু ভিন্ন৷ বড় একগুঁয়ে,শাসন মানত না৷ ভাল পোশাকে তেমন আকর্ষণও নেই,গয়ণা গায়ে তোলে না,কবি এই মেয়েকে বড় ভালবাসেন, আগলে রাখতেন৷
পাত্র পছন্দ হয়েছে,দেখতে যেমন সুন্দর তেমন মিষ্টি অমায়িক স্বভাবের৷ আর রাণীটা যা জেদী ওর বর একটু ভাল মানুষ না হলে হয়৷ পাত্র সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য,ডাক্তার৷ জামাইকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠালেন কবি৷ মৃণালিনী দেবী খুব অসুস্থ,তিনি যাতে রেণুর বিয়ে দেখে যেতে পারেন সেজন্য এই তাড়াহুড়ো৷
মৃণালিনী দেবীর রোগের আর উপশম হয় না,কবি বুঝলেন স্ত্রী'র দিন ঘনিয়ে আসছে,রেণুর বর সত্যেন্দ্রনাথকে আমেরিকা থেকে এনে ফুলশয্যার উৎসব করা হল৷ নভেম্বর ১৯০২,প্রয়াত হলেন মৃণালিনী দেবী,রাণীর তখন বয়স বারো,রথীন্দ্র চোদ্দ,মীরার দশ,শমীন্দ্রের আট৷ ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কবি ফিরলেন শান্তিনিকেতনে,এবার নানা ব্যাধি দেখা যায় আদরের কন্যা রাণীর শরীরে, আসলে সে রাজযক্ষ্মা,যে রোগ বাসা বেধেছিল মাধুরীর শরীরেও কবির আদরের বেলা,বেলি বা বেলুবুড়ি,তিনি বেঁচেছিলেন মাত্র একত্রিশ বছর৷
© ধ্রুবতারাদের খোঁজে
হোমিওপ্যাথি,অ্যালোপ্যাথি,কবিরাজি সব ব্যর্থ হবার মত অবস্থা,রেণুকা আবার বাবা ছাড়া কারও হাতে ওষুধ খাবে না,বাবা কে সে সবসময় আঁকড়ে ধরতে চায়৷ সত্যেন্দ্রনাথের হাতে শাম্তিনিকেতনের স্কুলের ভার দিয়ে রাণীকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য রবীন্দ্রনাথ এলেন কলকাতায়৷ ডাক্তারের পরামর্শে হাজারিবাগ থেকে আলমোড়া৷ পাইনগাছের হাওয়া স্বাস্থের জন্য উপকারি,তবে সেই যাত্রা ছিল দীর্ঘ আর ক্লান্তিকর৷ সেইসময় রোগশয্যায় কাতর শিশুকন্যা রাণী শীর্ণ হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে বলত' বাবা গল্প বলো'৷
রেণুকা শুনেছিল ছোট ছেলের গল্প 'শিশুর' কবিতা৷
'আমি যখন বাবার খাতা টেনে
লিখি বসে দোয়াত কলম এনে—
ক খ গ ঘ ঙ হ য ব র
আমার বেলা কেন মা,রাগ কর?
বাবা যখন লেখে
কথা কও না দেখে'৷
কবির ইচ্ছা সেখানে মেয়েকে আরও কিছুদিন সেখানে রাখবেন যদি স্বাস্থ ভাল হয়,রাণী বুঝেছিল তাঁর দিন ঘনিয়ে আসছে৷ সে শেষ কটা দিন কলকাতার আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে থাকতে চায়৷ রাণী কলকাতায় এলেন,পাশে ডাক্তার স্বামী৷ কিন্তু রোগ কি ডাক্তারের কথা শুনে চলে? সব চিকিৎসা ব্যর্থ হলো,মৃত্যুর শেষ মুহূর্তে বাবার হাত আঁকড়ে ছিল,মৃত্যু হল ১৯০৩,মাত্র ১২বছর বয়সে মায়ের মৃত্যুর ন'মাস পরে৷
রাণীর স্বামী সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে একপ্রকার জোর করে রবীন্দ্রনাথ বিয়ে দিয়েছিলেন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের কন্যা ছায়ার সাথে,সেই বিয়েও সুখের হল না,বিয়ের তিন মাসের মধ্যে ম্যালিগনান্ট ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সত্যেন্দ্রনাথ পাড়ি দিলেন তারাদের দেশে৷ এর মাঝে নভেম্বর ১৯০৭ রবীন্দ্রনাথের ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়৷ মৃত্যুর আরও খতিয়ান আছে। পাঠক সব জানেন, সেই তথ্য যেকোনও সংবেদনশীল হৃদয়ের মানুষের মন ভাঙার জন্য যতেষ্ট৷ বারবার সন্তান-স্বজনদের মৃত্যু শেলের মত বিদ্ধ করেছে রবীন্দ্রনাথের হৃদয়৷ তারপরেও নিজের সৃষ্টিতে অমর হয়ে আছেন, রবীন্দ্রনাথ।
Comments
Post a Comment