অশ্বত্থামা
"মহাভারতের প্রতিনায়কদের মধ্যে অন্যতম একজন অশ্বত্থামা। আর তাঁকে নিয়ে আলোচনা করতে বসলে ওনাকে কখনই লঘু চরিত্র বলে মনে হবে না আপনার।
তিনি মহাভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আচার্য গুরুর পুত্র। শ্রেষ্ঠতম মহাবীরদের একজন৷ বহু দৈবাস্ত্র ধারণ করতে সক্ষম, সদা স্পষ্টবাদী এবং যথেষ্ট প্রভাবশালী বলতে যা বোঝায়, এককথায় তিনি তাই।
অশ্বত্থামার চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গেলে, সবার আগে আমাদের দ্রোণাচার্যকে নিয়েও কিছু কথা বোঝা প্রয়োজন।
একজন পুরুষের কাছে, যিনি পিতা হয়েছেন, তাঁর কাছে বোধহয় তাঁর সন্তানের থেকে প্রিয় আর কেউ নয়। আর কিছুই নয়। সেই কথা সেই দ্বাপরেও যেমন সত্য ছিলো, ত্রেতাতেও সত্যই ছিলো আর আজকের যুগে এসেও সেটা তেমনই সত্য রয়ে গিয়েছে। কিন্তু, মহাভারতের মহান কবি যদি সেই এক চিরাচরিত মাত্রাতেই তাঁর রচনাকে নিয়ে এগোবেন, তাহলে আর তাঁর কবিত্বের মহত্ব থাকলো কোথায়!?
যৌবন শক্তিতে উচ্ছলা, চঞ্চলা নদীতে প্রবল বর্ষা ঋতুতে ভরা জোয়ারের সময় যেমন আলাদা আলাদা স্রোতের ধারা প্রবাহিত হয় একের নীচে বহু, যেমন সেখানে ঘূর্ণির আবর্ত তৈরী হয়, মহাভারতের প্রত্যেকটা চরিত্রেও তেমনই যেন ঘূর্ণি আছে, চোরাস্রোত আছে। এই আজকেই আপনার কোনও ঘটনা বা চরিত্র নিয়ে একরকম বোধ হবে, তো কিছুদিন পরেই বোধ হবে ভিন্ন কিছু!
অশ্বত্থামার জন্ম হয় কৃপীর গর্ভে, দ্রোণাচার্যের ঔরসে। জন্মের পর একটি সাধারণ শিশুর যেমন ক্রন্দনধ্বনী আমরা শুনতে অভ্যস্ত, অশ্বত্থামার ক্রন্দন ছিল তার থেকে আলাদা। তিনি নাকি অশ্বের হ্রেষার মতো অর্থাৎ চিঁহি-চিঁহি শব্দেই নাকি কেঁদে উঠেছিলেন! মহাকাব্যের কবি বলেই ব্যাস এই ধ্বনিকে ঘোড়ার ডাক না বলে ইন্দ্রের বাহন উচ্চৈঃশ্রবার হ্রেষা বলে চিহ্নিত করেছিলেন। কথিত আছে যে আড়ালে থাকা লোকেরা ঐ অদ্ভুত ও চিকন কন্ঠস্বরের জন্যই দ্রোণপুত্রের নাম অশ্বত্থামা বলে সম্বোধন শুরু করেন। পুত্রের কন্ঠস্বর যেমনই হোক, ক্ষীণকেশিনী কৃপীর গর্ভে পুত্র লাভ করে যারপরনাই আনন্দ লাভ করেছিলেন দ্রোণাচার্য। কৃপী যে সুন্দরী ছিলেন বা বলা ভালো একজন নারী হিসাবে কাঙ্খিত চেহারা বলতে যে ছবি আমরা সচরাচর চোখের সামনে দেখতে বা ভাবতে অভ্যস্ত, তেমনটা ছিলেন এমন কেউই বলবেন না৷ কিন্তু তারপরেও এমন স্ত্রীর গর্ভে পুত্র লাভ করে দ্রোণ যারপরনাই খুশি ছিলেন, তার কারণ ঋষি ভরদ্বাজ পুত্র দ্রোণাচার্য যে অভাব ও প্রতিবন্ধকতার ভিতর দিয়ে এতো দিন কাটিয়ে এসেছেন, সেখানে দাঁড়িয়ে এই পুত্র তাঁর জীবনে আনন্দের এক দমকা হাওয়া বয়ে এনেছিলো, এটা নিশ্চিত।
পুত্রতো হলো। কালের নিয়মে সে বড়ও হতে থাকলো। অশ্বত্থামার কাহিনী বলতেই, আমাদের সকলের যে পিটুলি গোলার গল্প মনে পড়ে, সেটাতো একটা অংশ। কিন্তু তার বাইরেও আরো কিছু ঘটনা আছে।
'পিটুলি পর্ব' পার করে দ্রোণাচার্য যখন হস্তিনাপুরে এসে আশ্রয় পেয়েছেন, একটা অস্ত্রশিক্ষার চাকরিও জুটিয়ে নিয়েছেন সুকৌশলে, তখনই আমরা যেনো একটা দ্বন্ধ দেখতে পাই তাঁর ভিতর!
কৌরব বংশীয় শতাধিক বালকের প্রশিক্ষণের মাঝে কখনও কখনও অশ্বত্থামাকেও কিছু কিছু কৌশল শেখাতে সচেষ্ট ছিলেন দ্রোণ। এরকম সময় পিতা হিসাবে পুত্রের প্রতি কিছুটা দুর্বলতা আসে৷ পিতার মন চায় পুত্রকে একটু বেশি কিছু, একটু বিশেষ কিছু যদি আলাদা করে শেখানোইই যায়। রপ্ত করানো যায়। কিন্তু শিক্ষকস্বত্তা সেই পথ আগলে দাঁড়ায়!
এক অদ্ভুত উপায় বার করলেন দ্রোণ। সমস্ত শিষ্যদের একটি করে কলস বা কমন্ডুলু দিলেন তিনি, যেটির আকার বেশ বড় আর মুখটি ছোট আর অশ্বত্থামারটির মুখ তুলনামূলক বড়ো। ফলে জল নিয়ে অশ্বত্থামা দ্রুত ফিরতেন আর সেই বাড়তি সময়ে দ্রোণ পুত্রকে কিছু বাড়তি কৌশল বাতলে দিতেন! শিখিয়ে দিতেন খানিক বাড়তি কিছু! সেই যুগের রীতি-নীতি-মান-মর্যাদা অনুযায়ী দ্রোণাচার্যের এহেন আচরণ পুত্র-শিষ্যের মধ্যে পক্ষপাতহীনতার শর্তকে ভঙ্গ করলেও কোথায় এসে যেন এই আচরণই তাঁকে রক্ত মাংসের এক মানুষে পরিণত করে।
মহাভারতের মহাকবির বর্ণনায় দ্রোণের সমস্ত শিষ্যদের মধ্যে অর্জুনের পর যদি কারো শস্ত্রশিক্ষার প্রয়োগ-সংবরণ-লঘু-গুরু জ্ঞান থেকে থাকে, সেটা ঐ একজনেরই ছিলো। তিনি হলেন অশ্বত্থামা।
পাঠক লক্ষ্য করবেন 'অর্জুনের পর' বলা আছে। সেই যুগে মহান যোদ্ধা বা বীর তাঁকেই বলা হতো বা গণ্য করা হতো যার ভিতর শস্ত্রজ্ঞানের সাথে সাথে সেটিকে প্রয়োগ করার জন্য, সংবরণ করার জন্য শাস্ত্রজ্ঞানও সমহারে থাকতো। এই যৌথবিদ্যার যথাযথ মিশেলেই এক একজন বীর কালবন্দিত হতেন। অর্জুনের শিক্ষায় এই দুইয়ের মিশেল ছিলো। কিন্তু কর্ণ বা অশ্বত্থামার সেই গুণ পুরোপুরো ছিলো না!
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অন্তিমে, যখন দ্বৈপায়ণ হ্রদ্রের পাশে উরুভঙ্গ হয়ে শায়িত দুর্যোধন রাতের শেষ প্রহরে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষমাণ, ওদিকে অশ্বত্থামা পান্ডব পুত্রদের রাতের অন্ধকারে অন্যায়ভাবে ঘুমের মধ্যে হত্যা করে পালাচ্ছেন আর তাঁর পিছনে ভীম তাঁকে ধাওয়া করছেন, আর এনাদেরকে অনুসরণ করে পিছন থেকে রথ ছুটিয়ে আসছেন কৃষ্ণার্জুন, সেই সময়েই কৃষ্ণ আন্দাজ করেছিলেন যে অশ্বত্থামা এবারে কি করবেন! তিনি জানতেন যে অশ্বত্থামা এবারে ব্রহ্মশির অস্ত্রটি প্রয়োগ করবেন। শুধুমাত্র নিজেকে বাঁচাতে। কারণ কৃষ্ণ জানতেন, অশ্বত্থামা এই অস্ত্রলাভের যোগ্য ছিলেন না। কিন্তু তাও তিনি এই অস্ত্র চেয়ে বসেন দ্রোণের কাছে। নিজের ছেলে হলেও এরকম বায়নায় মোটেও খুশি হননি দ্রোণ! অন্তত আচার্য হিসাবে এটুকু গৌরব বা সততা তাঁর ছিলো যে তিনি বুঝেছিলেন স্বার্থ, লোভ, মাৎসর্য অশ্বত্থামার হৃদয়ে আছে। তিনি এই মারণাস্ত্র, এই দিব্যাস্ত্র ধারণের যোগ্য নন।
তাই পিতা হিসাবে একমাত্র পুত্রের বায়না ফেলতে না পারলেও একজন আচার্য হিসাবে তিনি সেইদিন বলে গিয়েছিলেন যে শতবাধ্য হলেও যেনো অশ্বত্থামা কোনওভাবেই কোনও মানুষের ওপর এই মারণাস্ত্রের প্রয়োগ না করেন। কিন্তু বিধির লিখন খন্ডায় এমন সাধ্যি কার!?
সেই দিনের অস্ত্রশিক্ষার আসর থেকে অন্তিমের এই ব্রহ্মশির প্রয়োগের মুহূর্ত - মাঝে বহু ঘটনা ঘটে গেছে। কখনও আমরা দেখেছি অশ্বত্থামা নিশ্চুপ আবার কখনও তিনি কর্ণ, দুর্যোধনের মতের বিরোধিতা করছেন! কখনও তিনি যোগ্য সম্মান না পেয়ে অভিমানী আবার কখনও তিনিই রাতের অন্ধকারে একপ্রকার একাই কৃপাচার্য, কৃতবর্মাকে বাধ্য করছেন পান্ডব শিবির আক্রমণ করতে! নিজ হাতে পান্ডব পুত্রদের নিধন করছেন। নিধন করছেন যুদ্ধের প্রথম দিন থেকে পান্ডবদের সেনাপতির পদ অলংকৃত করে আসা ধৃষ্টদুন্নকেও!
খেয়াল করবেন আপনারা, এদিকে এতো সেনাপতি এসছেন, মারা গিয়েছেন। কিন্তু ওদিকে একজনই প্রথম থেকে শেষ দিন অবধি পদ সামলেছেন - তিনি দ্রুপদ পুত্র, কৃষ্ণাপাঞ্চালী দ্রৌপদীর ভ্রাতা - ধৃষ্টদুন্ন।
শৈশবের সেইদিনে অশ্বত্থামা ব্রহ্মশির অস্ত্রপ্রয়োগের মন্ত্র কৌশলটুকু শিখেছিলেন বটে, কিন্তু অস্ত্রসংবরনের উপায় কৌশলটুকু মন দিয়ে শিখলেন না! তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো, বিপন্ন হলে বা শত্রু ধ্বংসের প্রয়োজন হলে অস্ত্রটুকু প্রয়োগ করা শুধু! তারপর কার কি হলো, না হলে তাতে ওর কিচ্ছু যায় আসেনা!
এদিকে পিছন থেকে ধাওয়া করে এসে কৃষ্ণের রথ ভীমের রথকে ধরে ফেললো প্রায়! কিন্তু ক্রোধাগ্নি তাড়িত ভীমকে আটকাতে পারে কে!? এমন সাধ্যি কার আছে?? এখানে যেকথা না বললেই নয়, পঞ্চপুত্রের মৃত্যুর পর কৃষ্ণাপাঞ্চালী দ্রৌপদী কিন্তু সেই ভীমের কাছে এসেই প্রতিকার চেয়েছিলেন যথারীতি! তাঁকেই বলেছিলেন পারলে ঐ নরাধম অশ্বত্থামাকে বধ করে প্রতিশোধ নিতে।
ভীম স্থানীয় লোকেদের জিজ্ঞেস করে জানলেন যে অশ্বত্থামা গঙ্গার দিকেই গিয়েছেন এবং সেখানেই হয়তো অবস্থান করছেন। ভীম রথ ছোটালেন গঙ্গার দিকে। পিছন পিছন চললেন কৃষ্ণ, অর্জুন আর যুধিষ্টির।
কিছুদূর এসে ভীম দেখলেন যে মহর্ষি দ্বৈপায়ন ব্যাসের শিষ্য সামন্তের সঙ্গে কুশের কৌপিন ধারণ করে গায়ে ঘি মেখে ধূলি ধূসর দেহে উদাসীন, কাতর হয়ে বসে আছেন অশ্বত্থামা।
আচমকা এই আক্রমণ! একদিকে ভীম আর তার পিছনে কৃষ্ণার্জুন ও যুধিষ্ঠির! অশ্বত্থামা রীতিমতো ভয় পেয়ে অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই 'ব্রহ্মশির' স্মরণ করলেন। অলৌকিক অস্ত্রক্ষেপণের মন্ত্র উচ্চারণ করে অশ্বত্থামা মারণাস্ত্রের লক্ষ্যও উচ্চারণ করলেন - "নিপাত যাক যতো পান্ডবেরা........"
অশ্বত্থামার অস্ত্র প্রতিহত করতে কৃষ্ণও অর্জুনকে নির্দেশ দিলেন - "গুরু দ্রোণাচার্য তোমাকে যে মারণাস্ত্র দান করেছিলেন, তা প্রয়োগ করার এই হলো সময়। নিজেকে এবং ভাইদের বাঁচানোর জন্য নিক্ষেপ করো ব্রহ্মশির।"
অর্জুন রথ থেকে নেমে সশ্রদ্ধচিত্তে তাঁর আপন মহাস্ত্র স্মরণ করলেন, অথচ এই বিপন্ন মুহূর্তেও, যেখানে অশ্বত্থামার নিন্দিত ব্যবহার শেষ করে দিয়েছে দ্রৌপদীর পুত্রদের, সেই মুহূর্তেও বাণের লক্ষ্য উচ্চারণ করার সময় তিনি গুরুপুত্র এবং অন্যান্য সকলের মঙ্গল কামনা করে শুধু অশ্বত্থামার মারণাস্ত্রটিকে নিবৃত্ত করা বা রুখে দেবার উদ্দেশ্য উচ্চারণ করলেন মনে-মনে। অশ্বত্থামার ক্রোধান্ধ অস্ত্রক্ষেপণের বিপরীতে অর্জুনের কী অসম্ভব দায়িত্বপূর্ণ এই উচ্চারণ!
অশ্বত্থামা অস্ত্র প্রয়োগ করেছিলেন নিজের সামান্য জীবনটুকু বাঁচাতে আর অর্জুন সশ্রদ্ধচিত্তে অস্ত্রপ্রয়োগ করেছিলেন সেই অস্ত্রকে প্রতিরোধ করতে। এই ভাবনার পার্থক্যই যেনো মহাভারতের নায়কের সাথে কোনও এক প্রতিনায়কের পার্থক্যকে যথাযথ সূচিত করে। এই দায়িত্ববোধ, এই সংযম, এই প্রজ্ঞাই একজন যোদ্ধাকে মহান করে তোলে। এখানে এসেই তিনি যেনো বাকিদেরকে ছাপিয়ে বহুদূর এগিয়ে যান!
অশ্বত্থামার মারণাস্ত্র নিবৃত্ত করার জন্য অর্জুনের মারণাস্ত্র প্রযুক্ত হলেও ব্যাস নারদের মতো অমিত প্রভাবশালী ঋষিরা জানালেন - যেখানে যে রাজ্যে এক ব্রহ্মশির দ্বারা আর এক ব্রহ্মশির প্রতিহত হয়, সেখানে সেই রাজ্যে ১২ বছর পর্যন্ত বৃষ্টি হয় না। অতএব তোমরা আপন আপন ব্রহ্মশির ফিরিয়ে নাও।
ব্যাস এবং নারদ অস্ত্রদ্বয়ের মধ্যবর্তী হলেন দেখে অর্জুন তার মারণাস্ত্রের গতি কমিয়ে ঋষিদের উদ্দেশ্যে বললেন - অশ্বত্থামার অস্ত্রটি নিবৃত্ত করা ছাড়া আমার আর অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই এবং এই অস্ত্রটি উপসংহৃত করলে অশ্বত্থমা কিন্তু আমাদের সকলকে মেরে ফেলবে। আপনারা সেটা চিন্তা করুন কথাটা বলেই অর্জুন মারণাস্ত্রটা ফিরিয়ে নিলেন।
অশ্বথামা বিনা পরিশ্রমে বিনা তপস্যায়, আত্মসাধনের জন্য নিজের দৌর্বল্য প্রকট করে পিতার দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছিলেন। তার সংযম যে কতটা কম, সেটা তার স্বীকারোক্তি থেকেই বোঝা যায়। অর্জুনের মতো ঋষিরা যখন তাঁকেও ব্রহ্মশির প্রত্যাহার করতে বললেন তখন অশ্বত্থামা পরিষ্কার জানিয়েছিলেন যে তাঁকে বাঁচতে হবে আর ভীম যেভাবে তার দিকে তেড়ে আসছিলেন, সেটা দেখে প্রাণভয়েই না কি তিনি ব্রহ্মশির ছেড়ে দিয়েছেন।
কথার পরে কথা আসে।যুক্তির জবাবে পাল্টা যুক্তি। অস্ত্র সংবরণ করার বদলে অশ্বত্থামা বলে চললেন হাজারো কথা। কখনও তিনি বলছেন - পান্ডবদের ধ্বংস অনিবার্য। কখনও তিনি নিজের মাথার মণিটি প্রদান করে নিজের প্রাণ বাঁচাতে চাইছেন!
এই মারণাস্ত্র প্রতিসংহরণের ক্ষমতা আমার নেই, তবে হ্যাঁ, এইটুকু আমি করতে পারি যে, এই অস্ত্র পাণ্ডবদের কাউকে না মেরে পাণ্ডবদের শিশু সন্তানটিকে নষ্ট করবে।
অর্থাৎ নিজের প্রাণের ভয়ে পাণ্ডবদের গায়ে তিনি মারণাস্ত্রের আঁচটুকুও লাগাতে পারলেন না, কিন্তু পাণ্ডব-কিশোর এবং গর্ভশয্যায় শায়িত শিশুটিকে আঘাত করতে তাঁর দ্বন্দ্ব হল না কোনও। তবু সকলে মেনে নিলেন অশ্বত্থামার কথা, বিশেষত কৃষ্ণ।
অভিমন্যুর পুত্র আর উত্তরার গর্ভের যে শিশু সন্তানটি অশ্বত্থামার অস্ত্রের লক্ষ্য হয়ে উঠল, তার সুরক্ষার ব্যাপারে কৃষ্ণ আগে থেকেই সতর্ক ছিলেন।
সারা জীবন ধরে অশ্বত্থামার অনেক রঙ্গ দেখেছেন কৃষ্ণ, বিশেষত যুদ্ধশেষে পাণ্ডবদের ঘরে শিশু-কিশোরদের অপমৃত্যু এবং মৃত্যুর আশঙ্কা কৃষ্ণকে এই মুহূর্তে বিরক্ত করে তুলেছে। তিনি বললেন- "অশ্বত্থামা! তোমার অস্ত্র ব্যর্থ হবে না জানি, হয়তো উত্তরার গর্ভস্থ সন্তানটিও মরবে, কিন্তু সে আবার বেঁচেও উঠবে, আমি তাকে বাঁচাব। কিন্তু শেষ কথা আমি তোমাকে বলি- তোমার মতো কাপুরুষ এই দুনিয়ায় নেই, তুমি বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেদের মেরে সুখ পাও- ত্বান্ত কাপুরুষং পাপং... বালজীবিত ঘাতকম্। তোমার এই কাজের ফল তুমি পাবে। তোমাকে এই লোকালয় ছেড়ে যেতে হবে, হাজার বছর বাঁচলেও একটি লোকের সঙ্গে তোমাকে আলাপ করার সুযোগ দেব না আমি- অপ্রাপ্লুবন্ ক্বচিৎ কাঞ্চিৎ সংবিদং জাতু কেনচিৎ- তুমি অসহায় হয়ে নির্জন জায়গায় ঘুরে বেড়াবে, কারও কাছে মনের কথা বলবার সুযোগ পাবে না। যা তুমি আজ করলে, তাতে মানুষের মধ্যে তোমাকে থাকতে দেব না কিছুতেই। ভবিত্রী ন হি তে ক্ষুদ্র জনমধ্যেষু সংস্থিতিঃ। তোমার অস্ত্র আঘাত করুক উত্তরার গর্ভে, আমি বলছি, আমি তাকে বাঁচাব।"
অশ্বত্থামা এই শাস্তি মাথায় নিয়েও বাঁচতে চান। এতকাল কারণে-অকারণে বিভ্রান্ত পুরুষকার দেখিয়ে শেষে যখন এক লোকালয়হীন, সহায়-সঙ্গীহীন বন্যজীবন তাঁর নিয়তি হয়ে দাঁড়াল, তখনও কী নির্লজ্জভাবে তিনি বলছেন- আমি যখন এই লোকালয়ে কিংবা অন্যত্রও কারও সঙ্গে থাকতে পারব না, তখন হে মহর্ষি ব্যাস, আমি আপনার সঙ্গেই থাকব- সহৈব ভবতা ব্রহ্মন্ স্থাস্যামি পুরুষেষিহ। তাতে কৃষ্ণের কথাও থাকবে আর আমিও বাঁচব। কথাটা বলেই অশ্বত্থামা তাঁর মস্তকস্থিত মণিটি পাণ্ডবদের হাতে দিয়ে চললেন বনের পথে, ব্যাসের অনুগামিতায় চিত্তশোধনের পথে। ব্যাস তখনই তাঁকে হাতে ধরে নিয়ে যাননি বনে, তবে তিনি ব্রাহ্মণোচিত ক্ষমায় অনুমোদন করেছেন অশ্বত্থামার শেষ উপরোধ।
ভীষ্ম মহামতি কতকাল আগেই অশ্বত্থামাকে দেখে বলেছিলেন- জীবন অশ্বত্থামার বড় প্রিয়, যেভাবে হোক তিনি বেঁচে থাকতে চান- জীবিতং প্রিয়মত্যর্থমায়ুষ্কামঃ সদা দ্বিজঃ। ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মে ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি গ্রহণ করে, সারা জীবন পরাশ্রয়ে থেকে, নীতিহীন পুরুষকার প্রকট করে শুধু বেঁচে রইলেন অশ্বত্থামা।
ভারতীয় জীবনে সাত জন মানুষের মরণ হয়নি। তাঁরা চিরজীবী। এই সাত জন হলেন অশ্বথামা, দানবরাজ বলি, মহাভারতের কবি ব্যাসদেব, রামায়ণের হনুমান বিভীষণ, কৃপাচার্য এবং পরশুরাম।
শুধু এটুকুই বলার যে এই সাতজন চিরজীবী চরিত্রের মধ্যে অশ্বত্থামা বোধহয় সবচেয়ে নিকৃষ্ট, কেননা লক্ষ্য সাধনের ক্ষেত্রে অশ্বত্থামার কোন নীতি ছিলনা এবং তার লক্ষ্যটা যে ঠিক কী, তা বোধ হয় তিনি নিজেও জানতেন না!
মহাভারতের ঘটনা প্রবাহ ব্যাখ্যা করলে এ কথা স্পষ্টভাবেই বলা যায় অশ্বত্থামাকে কখনোই ঠিক স্পষ্টভাবে চেনা যায় না যেনো! কোথায় যে তাঁর পক্ষপাত তৈরি হবে তা যেমন আগে থেকে বলা যায় না, তেমনি তাঁর নৈতিক বিচারের ক্ষেত্রগুলোও স্পষ্ট নয়!
ফলতো শেষ পর্যন্ত তিনি কিছুই পান না! সঙ্গীহীন সহায়হীন কিন্তু অদ্ভুত অর্থহীন চিরজীবিতায় তিনি চিরকাল বেঁচেই থাকেন শুধু! বড্ড নির্মম সেই চিরজীবিতা! যেখানে বাকি শত সহস্র বছরের নির্জন দ্বীপান্তরের নির্বাসন আছে! যেখানে ত্রিসীমানায় আর কেউ কোথাও নেই! সেই চিরজীবিতার অভিশাপে কোনও গৌরবের কণামাত্র নেই৷ বরং নিজের প্রাণটুকু বাঁচাতে এক নবাগত শিশুর ভ্রূণ হত্যার মহাপাপকে বাকি দীর্ঘজীবন বয়ে বেড়াতে হবে! কত দিন? কত বছর? কেউ জানেনা! মহাপাপের এই সুবিশাল পাথর বয়ে কতোদিন কাটাবেন এই 'মহাবীর'!? এমন জীবনই কি তাঁর প্রাপ্য!? এমন চিরজীবিতার জগদ্দল পাথরের নীচে কতোদিন গুমরে চাপা পরে থাকবেন অশ্বত্থামা!?
সেই কথা জানেন শুধু কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস আর মহাকাল।"
Comments
Post a Comment