ফিরোজা বেগম
তাঁকে বলা হতো 'নজরুলের গানের পাখি'! কবি নজরুলকে সামনাসামনি মাত্র ১০ বছর বয়সে সঙ্গীত-জীবনের শুভসূচনা হয়েছিলো যাঁর! কবি নজরুলের অসুস্থোত্তরকালে কবির গানগুলোকে অ-রক্ষিত এবং বিলুপ্ত হবার 'অভিশাপ' থেকে মুক্ত করে 'নজরুল-গীতি' পরিচয় দিতে যে মহীয়সী নারী মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, তিনি আর কেউ নন - ফিরোজা বেগম।
১৯৩০ সালের ২৮শে জুলাই, ফরিদপুর জেলার তৎকালীন গোপালগঞ্জ মহকুমায় রাতইল ঘোনাপাড়া গ্রামের এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এই নজরুল-সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী। বাবা খান বাহাদুর মোহাম্মাদ ইসমাইল ছিলেন তৎকালীন ফরিদপুর জেলার প্রথম মুসলিম আইনজীবী এবং মা কওকাবুন্নেসা বেগম। বাঁধাহীন হওয়া সত্ত্বেও এবং বিশেষ কোনো পারিবারিক অনুপ্রেরণা না পেলেও, তিনি নিজের আগ্রহে এবং আত্মঅনুপ্রেরণায় গান শিখেছিলেন! বাড়িতে পূর্বপুরুষদের ব্যবহৃত পুরনো গ্রামোফোন ছিলো। মা ছিলেন সঙ্গীতানুরাগী। কাননবালা দেবী, শচীন দেব বর্মন, চিত্ত রায়, কমল দাশগুপ্তদের রেকর্ড বাজতো, পাশাপাশি যাঁর গান তখন একটা 'যুগ' এবং মনের অজান্তেই যাঁকে বেশি শুনতেন ফিরোজা, তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এভাবে বিভোর হয়ে গ্রামোফোন থেকে গান শুনে শুনে কণ্ঠে তুলতেন ফিরোজা।
১৯৩৯ সালে প্রথম অল ইন্ডিয়া রেডিওতে গান গাবার সুযোগ পান। গ্রীষ্মের ছুটিতে বাবার সাথে কোলকাতা বেড়াতে যান সপরিবারে। ওনার মামা একরামুল কবীর তখন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে এম. এ. করছেন। চাচারা ওখানেই থাকতেন। একদিন হঠাৎ চাচাতো ভাইয়েরা ছোট্ট ফিরোজাকে গুনগুন করে গাইতে শুনলে বলে বসলেন কোলকাতা রেডিওতে সে গাইবে কি না! অনেক বড় বয়সে ফিরোজার থেকে তাঁরা। ততদিনে গোটা বাড়ি জানে ছোট্ট ফিরোজা কত সুন্দর গায়! শুনেই ফিরোজা কিছুটা ইতস্তত করলেন! অডিশন আবার কি জিনিস? ফিরোজা বেগমের ভাষ্যে, ওই চাচাতো ভাইদের একজনের বন্ধু কোলকাতায় অল ইন্ডিয়া রেডিওতে চাকরি করতেন। তাঁকে ডাকা হলো। গান শোনামাত্রই প্রস্তাব দিয়ে বসলেন অডিশনে আসার, যদিও ততদিনে হারমোনিয়াম বা কোনো বাদ্যযন্ত্রই দেখেননি ফিরোজা বেগম। অবশেষে, অডিশনের দিন অল্প গান গেয়ে ছেলেমানুষি বিরক্তি প্রকাশ করে গাওয়ার মাঝখানেই থেমে যান ফিরোজা। কয়েকদিন পর চিঠি আসে এবং চিত্ত রায়ের সঙ্গীত পরিচালনায় ওইবছরই প্রথম কলকাতা অল ইন্ডিয়া রেডিওতে গান গাইলেন ফিরোজা বেগম।
কবি নজরুলের সান্নিধ্য লাভ এবং কবির দোয়া -
১৯৪০ সালে কবি নজরুলের সাথে সাক্ষাৎ হয় ছোট্ট হিজ মাস্টার ভয়েস - এইচএমভির কোলকাতা স্টুডিওতে। বলাবাহুল্য, কোলকাতা এইচএমভিতে দ্বিতীয় এবং দীর্ঘস্থায়ী মুসলমান গায়িকা ছিলেন ফিরোজা বেগম। মামা একরামুল কবীরের খুব ইচ্ছে ছিলো ভাগ্নিকে নিয়ে একবার কবির কাছে যাবেন। কারণ, মনের অজান্তে গানের প্রতি টানে বিভোর হয়ে আঙুরবালা, ইন্দুবালা দেবীর কণ্ঠে কবির গান শুনে শুনে তুলতেন ছোট্ট ফিরোজা! মামার হাত ধরে সেই চাচাতো ভাইয়ের বন্ধু-মারফত চলে গেলেন এইচএমভিতে, কবি সেখানেই সারাটাদিন থাকতেন কাজে। এবং, কোলকাতা এইচএমভিতেই প্রথম পরনে ঘিয়ে রঙের পায়জামা-পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি এবং সোনালি ফ্রেমের চশমা চোখে প্রধান প্রশিক্ষক অর্থাৎ কবি নজরুলকে দেখতে পান ছোট্ট ফিরোজা। সেও এত লোকজন দেখে লজ্জায় একটু আড়ষ্ঠ। কবি স্বয়ং এবং কবির চারিপাশে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ তাঁর প্রশংসা শুনে বলে বসলেন একটি গান শোনাবার জন্য। ১০ বছর বয়সের ফিরোজা খালি গলায় গাইলেন কবিরই গান, "যদি পরাণে না জাগে আকুল পিয়াসা, শুধু চোখে দেখা দিতে এসো না...."! সবাই অবাক! কবি নজরুল অবাক হয়ে বলে উঠলেন, "এতটুকু মেয়ে! এই গান তুমি কোথা থেকে শিখলে!" এভাবে তার পরিচিতি কবির সাথে। মামা আসবার সময় ফিরোজাকে বললেন, "তুই গান শোনালি যাঁকে, এত লজ্জা পেয়ে চুপ হয়ে ছিলি যাঁর সামনে, জানিস তিনি কে? যাঁর গান গাস, তিনি - কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সেদিন কবির অসংখ্য গানের বিখ্যাত সুরকার কমল দাশগুপ্তের সাথেও তাঁর দেখা হয়েছিলো। কমল তখন ২৭-২৮ বছরের যুবক।
এরপরে আর দেশে ফিরে যাওয়া হয়নি ফিরোজার। মামা এবং চাচাতো ভাইদের অনুরোধে বাবা খানবাহাদুর ইসমাইল তাঁকে তাঁদের কাছে রেখে দিলেন।
ফিরোজা বেগম এক বিবিসি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ১৯৪২ সালে এইচএমভিতে একবার একজনকে গান শেখানোর সময় পাশে বসে থাকতে দেখে কবি তাঁকে গাইতে বললেন কবি ওই শিল্পীকে কি শেখাচ্ছিলেন! তিনি পুরোটাই নিঃসঙ্কোচে গেয়ে দিয়েছিলেন! কবি খুশি হয়ে দোয়া দিয়ে বলেছিলেন, "এত ছোট্ট মেয়ে কি সুন্দর, দরদ দিয়ে গায়! কি করতে পারবো আমি এর জন্য জানি না! তোমরা খেয়াল রেখো! এইচএমভিতে কোনো মুসলমান মেয়ে এমন সুন্দর গান গাইছে, তোমরা ওর যত্ন নিও!" অসুস্থ হবার আগে ওইবছরই কোনো একসময়ে তিনি এটা বলেছিলেন বলে ফিরোজা বেগম বিবিসি বাংলার এক সাক্ষাৎকারে এটা বলেন। জীবনের প্রথম এইচএমভি রেকর্ড - কবি নজরুলের ইসলামী সঙ্গীত, চিত্ত রায়ের সুরে 'মরুর বুকে জীবনধারা কে বহালো' ১৯৪২ সালে! গানটি ভীষণ জনপ্রিয় হয়! বিভিন্ন পত্রিকা লেখাও শুরু করে দিয়েছিলো তাঁকে নিয়ে ওপার বাংলার এক মুসলিম মেয়ে এইচএমভিতে। কবির অসুস্থোত্তর সময়ে নজরুল-সঙ্গীতের অ-রক্ষণবেক্ষণ নিয়ে তিনি আরো বলেন, ১৯৪৬, '৪৭ সাল থেকে কবির গান গাওয়া অনেক শিল্পীই ছেড়ে দিচ্ছিলেন! এদিকে কবিও অসুস্থ, অসহায়! অনেক গান অ-রক্ষিত থেকে যায়, কোনো কোনো গানের রেকর্ডই পাওয়া যাচ্ছিলো না! স্বরলিপিও না! তিনি নিজেও শিখতে পারছিলেন না! এমন বিপর্যয়ের মুখে দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে কোলকাতায় স্থায়ীভাবে থেকে যান ফিরোজা। ধীরে ধীরে কবির গানের সুরকার এবং গায়ক কমল দাশগুপ্ত, ধীরেন মিত্র এবং চিত্ত রায় প্রমুখকে সঙ্গে করে পুনরায় এক নতুন সংগ্রামই শুরু করলেন কবির গানের জন্য। ১৯৫৬ সালে কোলকাতায় কমল দাশগুপ্তকে বিয়ে করেন তিনি। বিবাহের পর কমল দাশগুপ্ত ধর্মান্তরিত হয়ে নাম রাখেন 'কামালউদ্দিন আহমদ'। এ দম্পতির তিন সন্তান - তাহসিন, হামিন এবং শাফিন। ১৯৭৪ সালে মৃত্যুর পর বনানী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। পাকিস্তান আমলে ফিরোজা বেগম ঢাকা-কোলকাতা যাতায়াত করতেন গানের রেকর্ডিংয়ের জন্য। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে কবির সাথে চিরস্থায়ীভাবে ঢাকা চলে আসেন। কবির সাথেই থাকতেন। কবির মূক-অবস্থায় কাছে গেলেই আঙ্গুল দিয়ে হারমোনিয়ামের দিকে নির্দেশ করতেন কবি। এবার শিষ্যা যাবেন কোথায়, গান তো গাইতেই হবে! কবিও শিশুর মতন হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে ফিরোজার গান শুনতেন (ছবি কমেন্টে)! কবির মৃত্যুশয্যায়ও ছেড়ে যাননি ফিরোজা, কবির মুখের দিক তাকিয়ে অনবরত অশ্রুবিসর্জন দিয়েছেন (ছবি কমেন্টে সংযুক্ত)।
২০১৪ সালে ৮৪ বছর বয়সে ঢাকা ইন্দিরা রোডের বাসভবনে শেষ-নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি!
Comments
Post a Comment