রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে বিধবা জীবন ঘুচল প্রতিমা দেবীর, বিয়ে হল কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে...
(লেখা :- মহুয়া দাশগুপ্ত, বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত প্রবন্ধ।)
প্রতিমা নামের মেয়েটির তখন এগারো বছর বয়স। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটো বোন বিনয়িনী দেবী এবং শেষেন্দ্রভূষণ চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা প্রতিমা। তাঁর বিয়ে হয় গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরেরর বোন কুমুদিনী দেবীর নাতি নীলানাথের সঙ্গে। তখন পিরালি ঘরে এমন কাছাকাছি সম্পর্কে বিয়ে হত। কিশোরী প্রতিমাও নিয়ম মেনে শ্বশুরবাড়ি গেলেন। কিন্তু ভাগ্যের বিড়ম্বনায় দিনকয়েকের মধ্যে গঙ্গায় সাঁতার কাটতে গিয়ে জলে ডুবে মৃত্যু হয় নীলানাথের। সুলক্ষণা মেয়েটি ‘অপয়া’ অপবাদ নিয়ে ফিরে আসেন পিতৃগৃহে। আর পাঁচটি বিধবা মেয়ের মতোই হয়তো তাঁর দিন কেটে যেত, কিন্তু এগিয়ে এলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
প্রতিমা দেবীর জন্মের পর, ফুটফুটে মেয়েটিকে নিজের ছেলের বৌ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী। কিন্তু নিয়তি কাউকে ছাড়ে না। তাই অকালে চলে গেলেন মৃণালিনী দেবী। প্রতিমা দেবীর বিয়ের সময় এগিয়ে এল। মৃণালিনী দেবীর কথা মনে করে প্রতিমা দেবীর অভিভাবকদের তরফ থেকে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর প্রতিমা দেবীর বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন কিশোর ছেলের বিয়ে দিতে চাননি। অগত্যা প্রতিমা দেবীর অন্যত্র বিবাহ হয়ে যায়। তারপর পাঁচবছর বৈধব্যজীবনের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে প্রতিমা দেবী আবার প্রবেশ করেন রঙিন জীবনে। এবার তিনি কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অর্ধাঙ্গিনী। অনেকে বলেন, ঠাকুরবাড়িতে এই প্রথম বিধবাবিবাহ।
চিরায়ত সংস্কারের কারণে প্রতিমা দেবী এবং তাঁর মা বিনয়িনী দেবী নাকি এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইচ্ছে এবং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রতিমা দেবীর শুভবিবাহ সুসম্পন্ন হয় ১৯১০ সালের ২৭ জানুয়ারি। নবদম্পতি নতুন সংসার পাতেন শিলাইদহে, অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশে। স্বপ্নের মতোই সুন্দর ছিল তাঁদের জীবনের প্রথম বছরটি। প্রতিমা দেবীকে পেয়ে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিক কতটা খুশি ছিলেন, তা অনুমান করা যায় ভগ্নিপতি নগেন্দ্রনাথকে লেখা রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি চিঠি থেকে। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘প্রতিমা এখন আমার - সে কী চমৎকার মেয়ে কী করে লিখি। আমি যদি তাঁর গুণের বর্ণনা করতে যাই তো সবকথা বিশ্বাস করবে না বা আমাকে Lunatic ভাববে।’ এমনই মুগ্ধতা আর আবেশে যে সম্পর্ক শুরু হয়েছিল, সেই সম্পর্ক ধীরে ধীরে ভাঙনের পথে চলবে। জীবনের অপরাহ্ণবেলায় প্রতিমা দেবী গভীর একাকিত্বকে মেনে নিয়ে শান্তিনিকেতনে, রাঙামাটির দেশে রয়ে যাবেন। যেন এক একলা শিল্পী, জীবনের বেদনা ফুটিয়ে তুলছেন তাঁর শিল্পে। আর রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর? কর্মব্যস্ত জীবনে স্ত্রীকে কাছে পাবেন না। প্রৌঢ় বয়সে বন্ধু নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মীরা চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে চলে যাবেন দেরাদুনে। একদিকে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা মীরা দেবী কেউই নিজেদের দাম্পত্য সম্পর্ক ভাঙবেন না , অন্যদিকে জীবনের মূল্যবান প্রহরগুলি থেকে বঞ্চিত করবেন প্রতিমা দেবী এবং মীরা দেবীর স্বামী নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। প্রতিমা দেবী অতি বড় বেদনায় এবং অপমানেও স্থির ছিলেন। শুধু যখন বিশ্বভারতীর উপাচার্য রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে অপবাদ ও গুঞ্জন শুনছেন, তখন একবার বলেছিলেন, ‘ওনার সমস্ত ব্যক্তিত্ব ওই মেয়ে গ্রাস করে নেবে।’ প্রথম বিবাহের পর স্বামীর মৃত্যু এবং দ্বিতীয় বিবাহের পর স্বামীর অন্য নারীতে আসক্তি— প্রতিমা দেবীর একাকিত্বই ছিল দাম্পত্যের ললাটলিখন। তবু, নিয়তির পরিহাসকে অতিক্রম করে প্রতিমা দেবী স্বতন্ত্রভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেন। এইখানেই তিনি অনন্যা!
অসাধারণ ছবি আঁকতেন প্রতিমা দেবী। অবন ঠাকুরের ভাগ্নি উত্তরাধিকার সূত্রেই এই প্রতিভা অর্জন করেছিলেন। বিয়ের পর ইতালিয়ান শিক্ষক গিলহার্ডির কাছে ছবি আঁকতে শিখেছিলেন প্রতিমা দেবী। তারপর শান্তিনিকেতনে থাকার সময় নন্দলাল বসুর সঙ্গেও কাজ করেছেন। সব থেকে বড় প্রাপ্তি তাঁর ‘বাবামশায়’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহচর্য। প্রতিমা দেবী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি বিষয়ে মূল্যবান আলোচনা করেছিলেন ‘গুরুদেবের ছবি’ রচনায়। রীতিমতো চিত্রসমালোচকের মতো সে সমালোচনা। ইন্দোনেশিয়ায় গিয়ে বাটিকের কাজ শিখে শান্তিনিকেতনে তার প্রচলন করেছিলেন । ফ্রান্স থেকে শেখা সেরামিকসের কাজ শিখিয়েছিলেন শ্রীনিকেতনে। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের করা কাঠ ও চামড়ার কাজে বিদেশি নকশা মিশিয়ে তৈরি করতেন ট্রে, ফুলদানি, ল্যাম্পশেড আরো কত কী! বলা যায়, শান্তিনিকেতনের যে বিশেষ স্টাইল তা প্রতিমা দেবীর জন্যই বিশিষ্ট হয়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনৃত্যে একটি বড়ো ভূমিকা রয়েছে প্রতিমা দেবীর। শান্তিনিকেতনে প্রতিমা দেবী মূলত ভাবনৃত্য শিখিয়েছিলেন। বিয়ের কিছুদিন পরে ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’ নাটকে ক্ষীরির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন প্রতিমা দেবী। এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অনুরোধেই ‘পূজারিণী’ কবিতার নৃত্যনাট্যরূপ লিখে দেন। নাম দেন— ‘নটীর পূজা’। প্রতিমা দেবী শান্তিনিকেতনের মেয়েদের দিয়ে কবির জন্মদিনে, ‘নটীর পূজা’র নৃত্যনাট্যরূপ অভিনয় করিয়েছিলেন। ‘চিত্রাঙ্গদা’ বা ‘পরিশোধ’ লেখার সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমে ভাবেননি তার নৃত্যরূপের কথা। প্রতিমা দেবী প্রায় চোদ্দ বছরের পরিশ্রমের পর রাবীন্দ্রিক গীতিনাট্যের স্থায়ী রূপ তৈরি করেছিলেন ‘চিত্রাঙ্গদা’য়। এর আগে ‘শাপমোচন’ আর ‘চণ্ডালিকা’র নৃত্যনাট্যরূপও তৈরি হয়। মিশ্রতাল ও ভঙ্গির সংমিশ্রণে তিনি নৃত্যকলায় বৈচিত্র্য এনেছিলেন। কুশীলবদের পোশাক এবং মঞ্চসজ্জা নিয়েও ভাবনাচিন্তা করতেন প্রতিমা দেবী। পোশাকের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতেন শালীন সৌন্দর্য নিয়ে। ‘মায়ার খেলা’ নাটকের নতুন রূপ দিয়েছিলেন। গল্পগুচ্ছের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘দালিয়া’, ‘সামান্য ক্ষতি’ ইত্যাদি গল্পের ট্যাবলো ধরণের মূকাভিনয়ের আকার দেওয়া হয়েছিল প্রতিমা দেবীর উদ্যোগে। তাঁর কর্মোদ্যোগের আরেকটি হল ‘আলাপিনী সমিতি’। আশ্রমের মেয়েরা গ্রামে গিয়ে গ্রামের অশিক্ষিতা মেয়েদের স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরি, হাতের কাজ শেখানো ইত্যাদি বিষয় সচেতন করে আসতেন।
কল্পিতাদেবী ছদ্মনামে প্রবাসী পত্রিকায় অনেক কবিতাও লিখেছিলেন প্রতিমাদেবী। তাঁর লেখা ‘স্বপ্নবিলাসী’ পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন ‘মন্দিরার উক্তি’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে কবিতা লেখার চর্চা করতেন প্রতিমা দেবী। তাঁর লেখা ‘নির্বাণ’ বইতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের শেষ বছরের বর্ণনা আছে। এছাড়াও ‘স্মৃতিচিত্র’, ‘নৃত্য’, ‘চিত্রলেখা’ ইত্যাদি বইও লিখেছিলেন প্রতিমা দেবী। প্রতিটি বই-ই সেই সময়কার দলিল। প্রতিমাদেবী লেখাপড়ার চর্চাও করেছিলেন বিয়ের পরেই। সেইসময় বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির ভাবের বদল চোখে পড়েছিল প্রতিমা দেবীর। তখন তাঁর বয়স মাত্র ষোলো।
বিয়ের পর থেকে ‘বাবামশায়’ রবীন্দ্রনাথের সেবায় নিমগ্ন ছিলেন প্রতিমা দেবী এবং রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দীর্ঘজীবনের বিচিত্র কর্মপ্রবাহের সহায়ক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সঙ্গে পেয়েছিলেন পুত্র ও পুত্রবধূকে। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও একজন গুণী মানুষ ছিলেন। কিন্তু বাবার প্রখর সূর্যালোকের মতো প্রতিভার তেজের পাশে অনালোচিতই রয়ে গেলেন তিনি। বিদেশ সফরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেখাশোনার জন্য অনেকসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে থাকতেন প্রতিমা দেবী। আসলে স্ত্রী, কন্যাসন্তানদের হারিয়ে প্রতিমা দেবীর মধ্যে গৃহলক্ষ্মীর খোঁজ পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর উপর নির্ভর করতেন। প্রতিমা দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহের ‘মা-মণি’, ‘ব্রাইড মাদার’, ‘বৌমা’! রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর প্রতিমা দেবীর নিঃসন্তান জীবনের সবটুকু মনোযোগ অধিকার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই।
প্রতিমা দেবীর প্রতিভা বিকশিত হল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অকৃত্রিম স্নেহ পেলেন। জীবনের অর্থ খুঁজে পেলেন। কিন্তু রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর প্রতিমা দেবীর যৌথজীবন এক গভীর অসুখের মতো কষ্ট দিয়ে গেলো দুজনকেই। পালিতা কন্যা পুপেও সেই দূরত্ব মেটাতে পারলো না। তার জন্য হয়তো নিজের অজান্তেই দায়ী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিয়ের পর শিলাইদহে মাত্র একবছরের সহজ দাম্পত্য ছিল রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর-প্রতিমা দেবীর। শিলাইদহের কুঠিবাড়ি, চারিদিকের গোলাপবাগিচা, পদ্মানদী, সুখদুঃখের কাহিনিমোড়া বজরা এবং দাম্পত্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দুজনের নিজস্ব অবসর! এইসব ছেড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকে কর্তব্যের ভুবনে প্রবেশ করতে হয় নবদম্পতিকে। ধীরে ধীরে বিরহ আর দূরত্ব তাঁদের দুই অন্য পৃথিবীর বাসিন্দা করে তোলে। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি চিঠিতে প্রতিমা দেবীকে লিখেছিলেন, ‘কতদিন বোলপুরের মাঠে একলা পড়ে কেঁদেছি, কেউ জানে না। তুমিও না!’ একাকিত্ব প্রতিমা দেবীরও ছিল। নাহলে ওই বিপুল কর্মপ্রবাহে একটি মেয়ে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে পারে না।
বন্ধু নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মীরা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একটি আশ্চর্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন প্রৌঢ় রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই নিয়ে শান্তিনিকেতনে গুঞ্জন থেকে গুজব কিছু কম ছিল না। পম্পা সরোবরের ধারে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চারুকাজের স্টুডিও ‘গুহাঘর’-এর উপরতলায় ছিল প্রতিমা দেবীর স্টুডিও ‘চিত্রভানু’। ওই গুহাঘরেই থাকতেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেখানেই নীরবে শিল্পচর্চা করতেন প্রতিমা দেবী। অভিমানের আগুন কখনো প্রতিমা দেবীর কাজের পথে দাহ তৈরি করতে পারেনি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন বিশ্বভারতীর উপাচার্য। এইসময় তাঁকে, তাঁর কাজের পদ্ধতি ও নির্মলচন্দ্রের স্ত্রী মীরা দেবীকে নিয়ে এতরকম চর্চা হচ্ছিল যে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী ছেড়ে দেরাদুনে চলে যান। সেইসময় নাকি জওহরলাল নেহেরু নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন চট্টোপাধ্যায় দম্পতিকে শান্তিনিকেতন থেকে সরিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই সরে গেলেন। প্রতিমা দেবী রয়ে গেলেন শান্তিনিকেতনে, কোনার্ক ভবনে! রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে গেলেন মীরা চট্টোপাধ্যায়। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন মীরা দেবী। এই সম্পর্কের চর্চা না করেই প্রতিমা দেবীর একাকিত্বের কথা ভাবলে অবাক হতে হয়। সেইসঙ্গে মুগ্ধ হতে হয় তাঁর জীবনচর্যার পরিশীলনে। দেরাদুন যাওয়ার সময় প্রতিমা দেবীকে লেখা চিঠিতে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গিয়েছিলেন, ‘আমি লুকিয়ে চুরিয়ে যাচ্ছি না। এখানে সবাইকে জানিয়েই যাচ্ছি মীরা আমার সঙ্গে যাচ্ছে।’ এই সিদ্ধান্তের পর সত্যি কি কিছু বলার থাকে? তাই প্রতিমা দেবী নিজের কাজের পৃথিবীতেই রয়ে গিয়েছিলেন, শান্তিনিকেতনে! শিল্পীদের সাধনার জন্য জীবন তাদের একাকিত্ব আর বিষাদ উপহার দেয়। প্রতিমা দেবী নাকি রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলেছিলেন, ‘ভালো আছ এই খবর পেলেই খুশী হব।’ কুশল সংবাদ আসতো পত্রের আকারে, দেরাদুন থেকে! কিন্তু মানুষটা তখন অন্য কারো। একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠা কন্যার সঙ্গে মুসৌরি যাওয়ার পথে প্রতিমা দেবী রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেরাদুনের বাড়ির দিকে চেয়েছিলেন। বারান্দায় তখন ঝুলে আছে অন্য কারো নতুন শাড়ি! যে কিশোরী মেয়ের প্রেমে নিজেকে ‘Lunatic’ পর্যন্ত বলেছিলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে তখন সামাজিক ভাবেই শুধু রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী। চিত্রা দেব ‘ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল’-এ লিখেছেন যে, প্রতিমা দেবী রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে শান্তিনিকেতন ছাড়তে রাজি হন নি। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মীরা দেবীর প্রতি আকর্ষণ সম্পর্কে জানার পরেও কি তা সম্ভব? ১৯৬০ সালে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি চিঠিতে প্রতিমা দেবীকে লিখেছিলেন, ‘আমরা দুজনেই এখন জীবনের সীমান্তে এসে পড়েছি। এখন আর কারো প্রতি রাগ বা অভিমান পুষে রাখা শোভনীয় হয় না। সেইজন্য জেনো আমার মনে কোনো রাগ নেই— আমি সব ঝেড়ে ফেলেছি। আমাদের মধ্যে প্রীতি সম্বন্ধ অক্ষুণ্ণ থাকে, এই নতুন বছরে তাই কামনা করি।’
জীবন বড়ো রহস্যময়। একদিন ষোলো বছরের প্রতিমাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আশীর্বাদ করেছিলেন তাঁর সংসারকে পবিত্র জীবনের দ্বারা দেবমন্দির করে তোলার জন্য। প্রতিমা দেবীর ব্যক্তিগত জীবনচর্যায় এই পবিত্র সৌন্দর্য অবশ্যই লক্ষ করা গেছে। হয়তো রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে প্রতিমা দেবীর সপ্তপদী একটা সময়ের পর তাঁকে একাকিত্ব দিয়েছে। হতে পারে তাঁদের সংসারের ভাঙনে দুজনেরই কিছু ভূমিকা ছিল। কিন্তু রবিঠাকুরের সংসার অনেক বড়ো। জোড়াসাঁকো বা শান্তিনিকেতনের চৌহদ্দি পেরিয়ে যে বিরাট সংস্কৃতির ক্ষেত্র, সেখানে প্রতিমা দেবী ‘নির্মল হস্তে পুন্যপ্রদীপটি জ্বালাবার জন্য’ এসেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই আশীর্বচন সত্যই ছিল। প্রতিমা দেবীর কর্মজীবন তার সাক্ষ্য দেয়। সময়ের স্রোত সব আবেগ, সব যন্ত্রণা মুছে দেয়। রয়ে যায় শুধু কর্মের কোলাহল। প্রতিমা দেবীরও সেই কর্মী পরিচয় জেগে থাকবে অবিচলিত ভঙ্গিতে।
Comments
Post a Comment