তোমাকে আরো কাছে পেতে চাই
সর্বগাত্রেণ সংস্পর্শং নিত্যালিঙ্গণ বিভ্রমম—
আমি তোমাকে আরও কাছে পেতে চাই! এমন দূরে, আলাদা করে নয়। নিত্য আলিঙ্গনে, ছায়ার মতো তোমার অঙ্গের সমস্ত পরমাণুর স্পর্শ চাই আমি। — কালিকাপুরাণ
প্রকৃতির এই চিরন্তন আকুলতায় সাড়া দিল পুরুষ। জন্ম ও মৃত্যুর মতো, অন্ধকার ও আলোর মতো, ধ্বংস ও সৃষ্টির মতো, মিথ্যা ও সত্যের মতো একই দেহে সমাহিত হলো নারী ও নর। বসন্তকালে মহাবিষুবের লগ্নে, যেদিন সমস্ত পৃথিবীতে রাত আর দিনের দৈর্ঘ্য সমান, হরগৌরি আবির্ভূত হলেন অর্ধনারীশ্বর রূপে। প্রেমে, সমতায়, ভারসাম্যে........
ভারসাম্যের এই লীলা কেবল ভারতেই নয়, প্রচলিত চীনেও। মহাবিষুবের দিন মসৃণ তলের ওপর একটি ডিমকে সোজা দাঁড় করাতে হবে। আসন্ন গ্রীষ্মে যেন বৃষ্টি ও রোদের, ঝড় ও বাতাসের ভারসাম্য বজায় থাকে। বন্যা ও খরা দুইই তো দরকার সমান সমান। পলিমাটিও দরকার, ধান শুকানোও দরকার।
বিষুব সংক্রান্তি— বছরে দুবার আসে। শরতের জলবিষুব আনে জলবাহিত রোগ। আর বসন্তে বিষুবের পর বছরের শুরু, চৈতালী হাওয়ায় গুটিবসন্তের প্রকোপ। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যায়। তখন ঔষধি জ্ঞানের পরম্পরায়, মাটি খুঁড়ে আমাদের পূর্বনারীরা আবাহন করেন দূর্গতিনাশিনীকে—
দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ।
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত।।
রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।
ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকারঃ পরিকীর্তিত।।
দুর্গা— বসন্তকালের দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ ও ভয় নাশ করেন। যার গায়ের রঙ হলুদ। রান্নাঘরের কৌটোয় বন্দী হলুদেরও আরেক নাম দূর্গা। বাসন্তী পূজার দশমীতে যেদিন রাত ও দিন সমান, সেদিন নীল আর নীলাবতীর বিয়ে। তাই ঘিরে বসন্তকালের গাজন, চড়ক আর নীল পূজা। সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর, শিবের সঙ্গে পার্বতীর বিয়ের উৎসব। গাজনের গানে আর নীল ষষ্ঠীর ব্রতকথায় মঙ্গলময় সংসার রচনা করেন মাতৃকুল। এর পর বঙ্গদেশে বছরের শুরু— শিব হাল ধরেন, অন্নপূর্ণা দেন কামদ বীজ, কৃষি শুরু হয়, রচিত হয় সংসার...
শিব চললো বিয়ের বেশে
নারদ বাজায় বীণে,
পাড়াপড়শীর ঘুম নাইকো
বিয়ের কথা শুনে।
বিষুব- বৈসুক, বৈশাখ, বর্ষ, বিসু, বিষু, বিহু, বৈসু, বিজু, বিঝু
সংক্রান্তি- সংক্রান, সাংক্রান, চাংক্রান, থিংয়ান, য়াওশাঙ, সাংগ্রাই, সাংলান
মানুষের ধর্মে, সংস্কৃতিতে, বিশ্বাসে কিংবা আচারের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিন। শব্দের বিবর্তনে লুকিয়ে আছে সূর্যের আলোর উৎসব। বিহু ফুল, দাদমর্দন, নতুন কুঁড়ি আর কচি পাতারা এখনো ঠিকঠাক সময়েই চলে আসে। আমরা কেবল গুনতে দেরি করে ফেলি একটু।
চৈত্রের শুরুতে মহুয়া ও শালফুলে ছেয়ে ওঠে বন। বাহা পরবের তোড়জোড় চলে তখন। ঘর-দুয়ার পরিচ্ছন্ন করে, নতুন কাপড় পরে, খোঁপায় ফুল গুঁজে জাহের থানে জড়ো হন সাঁওতালরা। ফুল দিয়ে, জল দিয়ে দেবতা মাড়কো, মারাঙ বুরু, বোঙ্গার কাছে প্রার্থনা করেন ভারসাম্য ও সমৃদ্ধির। চম্পা, চামেলী ফুলের শৃঙ্গারে আসামের মানুষ বহাগ বিহুর দিন প্রজননের সঙ্গী খুঁজে ফেরেন। অস্ট্রালয়েড পূর্বজদের হাত ধরেই বসন্তের এই রঙ, ফুল, প্রেম ও আনন্দগাথা বয়ে চলেছি আমরাও।
সেই বহমান ধারারই নাম দোল কিংবা হোলী— চৈত্র মাসে অশোক ফুলের সুপ্রচুর বর্ষণের নীচে উৎপাদন-কামনায় নরবলি ও যৌন লীলাময় নৃত্যগীত। ভারতে মুসলমান রাজা এবং হারেমের নারীরা হোলী উৎসবের বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। হোলীর আগুন এখনও ভারতের অস্পৃশ্য জাতিদের ঘর থেকে আনতে হয়। মণিপুরিরাও জলকেলি ও রঙের সমারোহে পুরোনো বছরকে বিদায় দেন। তার নাম য়াওশাঙ। থাবাল-চোঙবা নাচে মেতে ওঠে সিলেটের নানা এলাকা। সারাবছর যেন উর্বর থাকে মাটি ও মানুষ।
কামদেবের পঞ্চশরের অশোক ফুল ফোটে বসন্তে। গাছে গাছে কোকিল, বেনে বউ সেই কাম, প্রেম আর প্রজনননের সুর গেয়ে চলে। কাঞ্চন, ভাঁট, আকন্দ ফুলে দুলে ওঠে বাংলার ঝোপঝাড়। জাপান ছেয়ে যায় চেরি ফুলের সুবাসে। দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা এবং কর্ণাটক রাজ্যে পালিত হয় উগাদি। তেঁতুল, গুড়, আম, নিমফুল মিশিয়ে তৈরি হয় পাচাদি শরবত। নতুন বছরের আলো-বাতাসের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে তা শরীরকে প্রস্তুত করে তোলে।
গমের ছাতু, দই ও পাকা বেলের শরবত খেয়ে বসন্তের শরীর রক্ষা করেন বাংলার মানুষ। গ্রামের পুরুষেরা খোলা মাঠে কিংবা ফসল কাটা খেতের প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে নববর্ষের নামাজ আদায় করেন। সেখানেও প্রার্থনা ভারসাম্যের। সারা শীত রস দানকারী খেজুর গাছের গোড়ায় দুধ এবং ডাবের জল ঢেলে কৃতজ্ঞতা জানান গৃহলক্ষী। তারপর ঘরের আশপাশ থেকে শাক খুঁজতে বের হন তারা। কমপক্ষে ১৪টি শাক পাওয়া গেলে নারী সন্তুষ্ট হন যে— সারাবছর চাষবাসে প্রকৃতির যত্ন করেছে পুরুষ।
বরফে ডানা জমে মরে যাচ্ছিল একটা পাখি। তাকে খরগোশে পরিণত করেন ওসতারা। সেই খরগোশ, যে পাখির মতো ডিম পাড়ে; হয়ে ওঠে উর্বরতা আর প্রাচুর্য্যের প্রতীক। মৃত্যুর মুখ থেকে যে ফিরে আসে জীবনের কাছে। ব্রহ্মাণ্ড কিংবা গর্ভাশয়— জন্মের সম্ভাবনা নিয়ে নিষেকের অপেক্ষার প্রতীক—ডিম। মৃত্যুর মতো শীতের শেষে বসন্তের নতুন প্রাণের উৎসব— ইস্টার, পালিত হয় বসন্তের দেবী ওসতারার স্মরণে। তিরুবন্তপুরমের পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের ঠিক মাঝ বরাবর কেটে রাখা জানালা দিয়ে আলো ফেলে ২০ মার্চের অস্তমান সূর্য। স্টোনহেঞ্জের মানমন্দিরে জড়ো হয়ে গান গায় মানুষ। আর গ্রামে গ্রামে মটরের খেতে আসে খরগোশের দল।
ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক নানা পরিবর্তনকে ব্যাখ্যার জন্য পৃথিবীর ওপর বেশ কিছু রেখা কল্পনা করেছে মানুষ। তার একটি হলো বিষুবরেখা। সারাবছর নিজ অক্ষে ঘুরতে ঘুরতে ১৯, ২০ অথবা ২১ মার্চ পৃথিবী এমন বিন্দুতে আসে যেখানে বিষুব রেখায় লম্বভাবে সূর্যের আলো পড়ে। ফলে দিন ও রাত সমান হয়। এর নাম মহাবিষুব বা বিষুব সংক্রান্তি বা বসন্ত বিষুব। এই সময় উত্তর গোলার্ধে দিনের দৈর্ঘ্য বাড়তে থাকে। এই বছর ২০ মার্চ দিন ও রাত সমান ছিল। অর্থাৎ উত্তর গোলার্ধের বাসিন্দা হিসেবে এবার আমাদের নতুন বছর শুরু হয়েছে ২১ মার্চ থেকে। আরেকটি হিসাব মতে, সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর কক্ষপথকে ভাগ করা হয়েছে ১২টি রাশিতে। মীন ছেড়ে মেষ রাশিতে সূর্যের সংক্রমণের দিন থেকে দেশে দেশে বছর গণনা শুরু করার চল।
এক সময় পঞ্জিকা গণণায় ক্রমশ পরিবর্তনশীল সূর্যের আলোকে ঠিকঠাক ধরতে পারতেন প্রাচীনেরা। সভ্যতার গ্রাসে প্রকৃতি পাঠের সেই জ্ঞান আমরা অনেকটাই হারিয়েছি। ফলে মহাবিষুবের দিন থেকে প্রায় ২৩/২৪ দিন পিছিয়ে গেছে আমাদের পঞ্জিকার নতুন বছর। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ও জাতির পঞ্জিকাতেই সংক্রান্তি, বিষুব ও নববর্ষের গণনায় এই বিচ্যুতি দেখা যায়। ঔপনিবেশিক শাসন ও বিশ্বায়নের ফলে দক্ষিণ গোলার্ধের সৌর পঞ্জিকার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে গিয়ে আমাদের নিজেদের ঋতু, পরবের হিসেবটা গুলিয়ে গেছে। তবে এখনো চৈত্র থেকে বৈশাখ অবধি উত্তর গোলার্ধের সকলেই নানান নামে, জেনে কিংবা না জেনে পালন করছে মহা বিষুব সংক্রান্তি বা বসন্ত বিষুব। প্রার্থনা করছে ভারসাম্যের।
ইরান, আফগানিস্তান, আজারবাইজান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও তুরস্কের কুর্দিরাও এই সময়েই পালন করেন নতুন দিন বা নওরোজ উৎসব। সাবজি–সামানু–সেনজেদ–সির–সিব–সেরকে–সুমাক — এই সাত খাবার দিয়ে ভালবাসা, জ্ঞান, প্রাণশক্তি, ধৈর্য্য ও সমৃদ্ধির প্রার্থনা হয় ঘরে ঘরে। আগুন জ্বালিয়ে, নতুন পোশাক পরে ও বসতবাড়ি পরিষ্কার করে বৎসরের আবর্জনাকে দূরে তাড়ানো হয়। হাফত সিন বা সাতটি ‘স’ এর এই প্রথা আজও বয়ে চলেছে টাইগ্রিস–ইঊফ্রেতিসের ধারায়।
উর্বর জমি, ঐশ্বরিক বীজ, বৃষ্টির জন্য রহস্যময় গান এবং শরীর শীতল করতে স্বর্গীয় থানাকা গুঁড়া— সুবর্ণভূমির মানুষকে এই বর দিয়েছিল পৃথিবী মাতা সিরি। থানাকা মেখে তারা জমিতে চাষ দিলেন। গান গেয়ে বীজ বুনলেন কৃষাণীরা। মেষ রাশিতে সূর্যের সংক্রমণের দিন ফসলে ঝলমল করে উঠলো সুবর্ণভূমি। সেই থেকে থাইল্যান্ডের মানুষ পালন করেন সাংক্রান। মহাবিষুবের পরের নতুন চাঁদের আলোয় মর্তলোক থেকে পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন করেন যুদ্ধ ও প্রেমের দেবী ইনানা। কৃষি দেবতা তাম্মুজের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এরপর ছয় মাস উর্বর থাকে মেসোপটেমিয়ার মাটি। আরব কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন জাতি বসন্ত বিষুবকে ঘিরে মাতৃত্বকে উদযাপন ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
বৈসাবি নামে কিছু নেই। চিম্বুকের ম্রোরা পালন করে চাংক্রান। মালয়েশিয়ার সিয়ামিজ জাতিতে পালিত হয় সংক্রান। মায়ানমারে থিংয়ান। উড়িষ্যায় পনা সংক্রান্তি। মিশরে শাম–এ–নেসিম। প্রেমের ফুলে, আনন্দের রঙে, জলের কামনায় আর ভারসাম্যের প্রার্থনায় এই উৎসব আমাদের পূর্ব নারীদের পরম্পরা। আমাদের সহাবস্থানের জ্ঞান। আমাদের অর্ধেক পৃথিবীর উত্তরাধিকার।
আমাদের আগে যারা মাটি ছুঁয়ে গেছে তারা শিখিয়ে গেছে— বছরের শুরু হয় ভারসাম্যে, প্রেমে, উর্বরতায়। শিখিয়ে গেছে— প্রাণের প্রজননশক্তিই আমাদের রক্ষাকবচ। আর বলে গেছে— আমরা কেউই একা নই। অনেকে ছিল, তাই আমরা আছি। সকলে আছে, তাই আমিও আছি।
Comments
Post a Comment