কাঙাল হরিনাথ

‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো, পার কর আমারে’ এই বিখ্যাত লোকসঙ্গীতটি কেবল হরি'র উদ্দ্যেশ্যে রচিত, তাই নয়, এটির রচয়িতাও হরি। মানে 'কাঙাল হরিনাথ'। উনিশ শতকের বাংলার এক খ্যাতনামা সাংবাদিক তথা সমাজকর্মী অথচ তিনি কাঙাল। তাঁর দেওয়ার ছিল অনেক কিছুই, চাওয়ার ছিল না কোনকিছুই। তবুও তিনি কাঙাল।।কারণ তিনি চেয়েছেন মুক্তি। যন্ত্রণা থেকে মুক্তি, পরাধীনতা থেকে মুক্তি। চেয়েছেন একাগ্রভাবে। কাঙালের মতো। চেয়েছেন পরের জন্য। পেয়েছেন কি? 

প্রকৃত নাম হরিনাথ মজুমদার। ১৮৩৩ সালের ২২শে জুলাই নদীয়া (বর্তমান কুষ্টিয়া) জেলার কুমারখালি গ্রামে জন্ম হয় তাঁর।
আর্থিক কারণে হরিনাথের লেখাপড়া বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। ১৮৫৫ সালে বন্ধুদের সহায়তায় তিনি নিজ গ্রামে একটি ভার্নাকুলার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং গ্রামের সাধারণ লোকদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে সেখানে অবৈতনিক শিক্ষকরূপে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরের বছর তাঁরই সাহায্যে কৃষ্ণনাথ মজুমদার কুমারখালিতে একটি বালিকা বিদ্যালয়ও স্থাপন করেন।

গ্রামের সাধারণ মানুষের উন্নতির জন্য এবং তাদের শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে হরিনাথ সারাজীবন আন্দোলন করেছেন। অত্যাচারিত এবং অসহায় কৃষক সম্প্রদায়কে রক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি সাংবাদিকতার পেশা গ্রহণ করেন। প্রথমে তিনি  সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লিখতেন, পরে ১৮৬৩ সালে নিজেই 'গ্রামবার্তা প্রকাশিকা' নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটি পরে পাক্ষিক ও শেষে এক পয়সা মূল্যের সাপ্তাহিকে পরিণত হয়। এতে সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হলেও কৃষকদের প্রতি তখনকার নীলকর ও জমিদারদের শোষণ-অত্যাচারের কথা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করা হতো। ফলে ব্রিটিশ সরকার এবং স্থানীয় জমিদারদের পক্ষ থেকে তাঁকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু তিনি নির্ভীকভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করে যান। এসব কারণে পত্রিকাটি তখন বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে।

হরিনাথের জীবনে কখনও সচ্ছলতা ছিল না, কিন্তু তা সত্ত্বেও পত্রিকা প্রকাশের সুবিধার্থে তিনি ১৮৭৩ সালে একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন। রাজশাহীর রাণী স্বর্ণকুমারী দেবীর অর্থানুকূল্যে দীর্ঘ ১৮ বছর পত্রিকা প্রকাশের পর আর্থিক কারণে এবং সরকারের মুদ্রণ শাসনব্যবস্থার কারণে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে হয়।

হরিনাথ ছিলেন ফকির লালন শাহর শিষ্য। তিনি অধ্যাত্মবাদ প্রচারের জন্য ১৮৮০ সালে ‘কাঙাল ফকির চাঁদের দল’ নামে একটি বাউল দল গঠন করেন। তাঁর রচিত বহুসংখ্যক বাউল গান খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করে। গানে ‘কাঙাল’ নামে ভণিতা করতেন বলে এক সময় কাঙাল শব্দটি তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ১২৯০-১৩০০ বঙ্গাব্দের মধ্যে তিনি কাঙাল ফকিরচাঁদ ফকিরের গীতাবলী নামে ১৬ খন্ডে বাউল সঙ্গীত প্রকাশ করেন। শুধু গানেই নয়, গদ্য ও পদ্য রচনায়তেও তাঁর সমান পারদর্শীতা ছিল। সাহিত্যচর্চায় হরিনাথের শিষ্যদের মধ্যে  অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, দীনেন্দ্রনাথ রায় এবং  জলধর সেন পরে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। মৃত্যুর পর হরিনাথের যাবতীয় রচনাসমগ্র 'হরিনাথ গ্রন্থাবলী' (১৯০১) নামে প্রকাশিত হয়। ১৮৯৬ সালের ১৬ই এপ্রিল মৃত্যুর আগে পর্যন্ত অক্লান্ত ভাবে নিজের কাজ করে গেছেন। হয়তো তাঁর পত্রিকা বা সাংবাদিকতার সুনাম সম্পর্কে শহুরে বাঙালী সেদিনও বিশেষ ওয়াকিবহাল ছিল না, আজও নেই, তবু বাংলার গ্রামে গ্রামে সাধারণ মানুষের কথায়-গানে, বাউলিয়া লোকসঙ্গীতে ভীষণভাবে জীবিত আছেন ঊনবিংশ শতকীয় এই কাঙাল 'রাজপুরুষ'; শুধু নামেই নয়, কাজেও তিনি নরোত্তম 'হরি' নাথ।

প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি |

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ