রবীন্দ্রনাথের প্রতি সুকান্ত

রবীন্দ্রনাথের প্রতি সুকান্ত

রবীন্দ্রনাথ কে নিয়ে সুকান্ত মাত্র দুটি কবিতা লিখেছেন। একটি ছাড়পত্র কাব্যে রবীন্দ্রনাথের প্রতি, অপরটি ঘুম নেই কাব্যে পঁচিশে বৈশাখের উদ্দেশ্যে। মাত্র একুশ বছর বয়সে মারা যান কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। তার কবিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ আমরা দেখতে পেলাম না। তাঁর অকাল মৃত্যু র কারণে। তবু উষা লগ্নেই তাঁর প্রতিভার যে পরিচয় পেয়েছিলেন বাংলার পাঠককুলভা অভাবনীয়।
শ্রীযুক্ত জগদীশ ভট্টাচার্য লিখেছেন ব্যক্তিগত জীবনে সুকান্ত একটি বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তার প্রথমদিকের অনেক রচনাতেই দলীয় শ্লোগান অতি স্পষ্ট ছিল। কিন্তু মনের বালকত্ব উত্তরণ হবার সঙ্গে সঙ্গে তার আত্মবিশ্বাস আত্মপ্রকাশকে অন্য সরতন্ত্র করে তুলেছিল। তাই কবি সুকান্ত যে আদর্শের কথা বলে গেছে তা পৃথিবীর সমস্ত মতবাদের চেয়েও প্রাচীন, সমস্ত আদর্শের চেয়েও বড়। তাই তিনি লিখতে পেরেছিলেন. 
আর মনে করো আকাশে আছে এক ধ্রুব নক্ষত্র
নদীর ধারায় আছে গতির নির্দেশ।
অরণ্যের মর্মর ধ্বনিতে আছে আন্দোলনের ভাষা।
আর আছে পৃথিবীর চিরকালের আবর্তন। ( ঐতিহাসিক ছাড়পত্র। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছেন। অসুখে পড়রার অল্পকিছুদিন আগে একদিন ওয়েলিংটন স্কোয়ারের এক মিটিংয়ে যাবার পথে আমার এক সংশয়ের জবাবে সুকান্ত বলেছিল আমার কবিতা পড়ে পার্টির কর্মীরা যদি খুশি হয় তাহলেই আমি খুশি। কেন না এই দলবলই তো বাড়াতে বাড়াতে একদিন এ দেশের অধিকাংশ হবে। 
এ সব কথা থেকে বোঝা যায় সুকান্তর ভাবনার স্তরটি। তাঁর লেখা কবিতাগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে নিলে তাঁকে বুঝতে আর কোনো অসুবিধা হয় না। 
কবি সুকান্তর সঙ্গে কবি রবীন্দ্রনাথের তুলনা করা সঙ্গত বলে মনে করি না। তবু এটা বলা যেতেই পারে যে কবি মাত্রই আবেগ ও অনুভূতির মধ্যে একটা সার্বজনীন বোধ কাজ করে। প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ পায়। দার্শনিক বোধের সঙ্গে মিশে থাকে সমাজ চেতনা। রাষ্ট্রীয় শোষণ। সামন্ততান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক শোষণ মানুষকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়। অন্ধকারে নিমজ্জিত মানুষ একদিন জোটবদ্ধ হয়ে আলোর রাও উঠে আমার জন্যে যুদ্ধে নেমে পড়ে। উপনিষদের ভাবনায় অনুপ্রাণিত রোমান্টিক কবি রবীন্দ্রনাথের নানা রচনায় এই সামগ্রিক বোধগুলি সুচারুরূপে প্রকাশিত হয়েছে, আফ্রিকা, প্রশ্ন  এমনি অনেক কবিতাতেই আমরা তার পরিচয় পেয়েছি, প্রশ্ন কবিতায় তিনি বলেছেন, 
আমি যে দেখেছি গোপন হিংসা কপট রাত্রি ছায়ে।
হেনেছে নিঃসহায়ে।
আমি যে দেখেছি প্রতিকার হীন শক্তের অপরাধে
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
আমি দেখিনু তরুন বালক উন্মাদ হয়ে ছোটে
কী যন্ত্রনায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথাকুটে।
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিভাইছে আলো
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ তুমি কি বেসেছ ভালো?
আফ্রিকা কবিতায়:
এল ওরা লোহার হাত কড়ি নিয়ে,
নখ যাদের তীক্ষ্ম তোমার নেকড়ের চেয়ে
এল মানুষ ধরার দল।
গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্য তারার চেয়ে।
সভ্যের বর্বর লোভ।
নগ্ন সরল আপন নির্লজ্জ অমানবিকতা 
তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে বাষ্পাকুল অরন্যের পথে
পঙ্কিল হল ধুলি তোমার রক্তে অশ্রুটাও মিশে।
দস্যু পায়ের ঝাঁটা মারা জুতো মারা জুতোর তলায়
বীভৎস কাদার পিন্ড।
চিরচিহ্ন দিয়ে গেল তোমার অপমানিত ইতিহাসে।
এ দেশ বিপন্ন আজ, জানি আজ নিরন্ন জীবন
মৃত্যুরা প্রত্যহ সঙ্গী, নিয়ত শত্রুর আক্রমণ 
রক্তের আলপনা আঁকে, কানে বাজে আর্তনা সুর
তবুও সুদৃঢ় আমি, আমি এক ক্ষধিত মজুর(ছাড়পত্র)
বোধন কবিতায়:
হে মহা মানব একবার এসো ফিরে
শুধু একবার চোখ মেলো এই গ্রাম নগরের ভিড়ে 
এখানে মৃত্যু হানা দেয় বারবার 
লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার 
এই যে আকাশ, দিগন্ত মাঠ স্বপ্নে সবুজ মাটি
নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাঁটি
কোথাও নেইকো পার
মারী ও মড়ক, মন্বন্তর ধন ঘন বন্যার 
আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল
এখানে চরম দুঃখ কেটেছে সর্বনাশার খাল
ভাঙা ঘর ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জনতার কালো
হে মহামানব এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো।
(ছাড়পত্র)
ফলে রবীন্দ্রনাথের প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ ছিল কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের। সেই আকর্ষণ থেকেই তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে তার মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর 'রবীন্দ্রনাথের প্রতি' কবিতায় আর পঁচিশে বৈশাখের উদ্দেশ্যে কবিতায় রবীন্দ্রনাথকে পুনরাগমনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই দুটি কবিতা এখন আমরা একটু পর্যবেক্ষণ করবো, তাহলেই বোঝা যাবে রবীন্দ্রনাথের প্রতি সুকান্তর মনোভাব।
কবি সুকান্ত জানতেন ও আমরাও জানি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট ও কবি সুকান্তে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, এক নয়। তবু সব কবির মধ্যে ভাবনায় অবশ্য বিরাজমান। রবীন্দ্রনাথের সহৃদয় সমাননুভূতিময় কবি সত্বা পাঠকের মর্মে অতি সহজেই প্রবেশ করতে সক্ষম। কবি সুকান্ত তাকে এড়িয়ে যাবেন কেমন করে, তাই 'রবীন্দ্রনাথের প্রতি' কবিতায় বলেন:
এখনো আমার মনে তোমার উজ্জ্বল উপস্থিতি।
প্রত্যেক নিভৃত ক্ষণে মত্ততা ছড়ায় যথারীতি।
এখনো তোমার গানে সহসা উদ্বেল হয়ে উঠি।
নির্ভয়ে উপেক্ষা করি জঠরের নিঃশব্দ ভ্রুকুটি।
ক্ষুধা তৃষ্ণার্তুর বিপন্ন মানুষকে দেখে যে কবি একদিন সখেদে ঘোষণা করেছিলেন, 
প্রয়োজন নেই কবিতার স্নিগ্ধতা।
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।
( হে মহাজীবন, ছাড়পত্র)
রবীন্দ্রনাথের কাব্যসরোবরে নিমজ্জিত হয়ে তিনি অনায়াসে বলতে পারেন, নির্ভয়ে উপেক্ষা করি জঠরের নিঃশব্দ ভ্রুকুটি। বলতে পারেন 
এখনো প্রঢের স্তরে স্তরে
তোমার দানের মাটি সোনার ফসল তুলে ধরে।
এখনো স্বগত ভাবাবেগে।
মনের গভীর অন্ধকারে তোমার সৃষ্টিরা থাকে জেগে।
কিন্তু কবিতার আবেগময় অনুভূতির বাইরে যে বাস্তব জীবন সেখানে ক্ষুধিত দিন ক্রমশ সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। হানাদারী মৃত্যুর কবলে গোপনে লাঞ্ছিত হন কবি। দিন যাপন হয় রক্তাক্ত। তবু তিনি রবীন্দ্রনাথের দৃপ্ত সৃষ্টিকে অন্তরে প্রতিষ্ঠিত করেন।
সুকান্তর দ্বিধা বিভক্ত অন্তরদ্বন্দ্ব প্রতিফলিত হয়েছে, এই কবিতায়, একদিকে সৃষ্টি সুখের আনন্দময় অমৃত, অন্যদিকে বাস্তবজীবনের যন্ত্রণা। তিনি নিশ্চিন্ত জীবনের গভীর আনন্দে মগ্ন হয়ে থাকতে চান কিন্তু পারেন না।
তবুও নিশ্চিত উপবাস 
আমার মনের প্রান্তে নিয়ত ছড়ায় দীর্ঘ শ্বাস।
আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি
প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুলাষ্ট প্রতিচ্ছবি।
আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়।
আমার বিনিদ্র রাতে সতর্ক সাইরেন ঢেকে যায়।
আমার রোমাঞ্চ লাগে অযথা নিষ্ঠুর শৃঙ্খল দুই হাতে।
রবীন্দ্রনাথের মতো তিনি ও বিশ্বাস করেন এই উৎপীড়ত নিষ্ঠুর সভায় শান্তির লালিত বানী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস, কিন্তু এই খেদোক্তি করেই তিনি থেমে থাকতে চান না। তিনি দেখতে চান মানুষ অত্যাচারী শোষকশ্রেনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ছিনিয়ে আনছে প্রাপ্য অধিকার। অনায়াসে তাই তিনি বলতে পারেন 
তাই আমি চেয়ে দেখি প্রতিঞ্জা প্রস্তুত ঘরে ঘরে।
দানবের সাথে আজ সংগ্রামের তরে।
পঁচিশে বৈশাখের উদ্দেশ্যে' কবিতায় কবি সুকান্ত পঁচিশে বৈশাখের কাছে প্রার্থনা করেছেন আরেকবার রবীন্দ্রনাথের জন্ম দিতে।
আমার প্রার্থনা শোনো পঁচিশে বৈশাখ 
আর একবার তুমি জন্ম দাও রবীন্দ্রনাথ।
কেন তিনি রবীন্দ্রনাথকে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন? তিনি বলছেন ক্ষমতা ধরের অত্যাচারে বিপন্ন মানুষ আজ বাক্যহীন। স্তব্ধবাক মানুষের মুখে ভাষা ফোটাবেন তিনি। পীড়নের প্রতিবাদে উদ্বেল হয়ে উঠবে মানুষ। সারা পৃথিবীকে পাঠানো হবে মৈত্রীর বানী। ভেঙে যাবে রূদ্ধশ্বাস নিরুদ্যম সুদীর্ঘ মৌনতা' সবচেয়ে বড় কথা, রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে আমাদের ভাষা যাবে শোনা।
যে রবীন্দ্রনাথকে আজ তিনি আহ্বান করছেন তিনি শান্তির ললিত বানী বিতরন কারী রবীন্দ্রনাথ নন। তিনি মানুষের অপমানের প্রতিবাদে উচ্চকন্ঠ মানবিক রবীন্দ্রনাথ।
আমি দিব্যচক্ষে দেখি সে রবীন্দ্রনাথ 
দস্যুতায় দৃঢ়কন্ঠ ( বিগত দিনের)
ধৈর্যের বাঁধন যার ভাঙে দুঃশাসনের আঘাত 
যন্ত্রণায় রূদ্ধবাক, যে যন্ত্রণা সহায়হীনের।
বিগত দূর্ভিক্ষে যার উত্তেজিত তিক্ত তীব্র ভাষা।
মৃত্যুতে ব্যথিত আর লোভের বিরুদ্ধে খরধার।
ধংসের প্রান্তরে বসে আনে দৃঢ় অনাহত আশা।
তাঁর জন্ম অনিবার্য, তাঁকে ফিরে পাবই আবার।
যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন দামামা ঐ বাজে / দিন বদলের পালা এল ঝড়ো যুগের মাঝে। সেই রবীন্দ্রনাথকেই আজ প্রয়োজন। বতর্মানের সংকটময় বিশ্বের অসহায় রূপটির বর্ণনা দিয়ে সংকট মোচনের জন্যে বর্তমান সময়ের উপযোগী নতুন রবীন্দ্রনাথকে তিনি আহ্বান করছেন।

নিষ্কম্প গাছের পাতা, রুদ্ধশ্বাস অগ্নিগর্ভ দিন;
বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে এ আকাশ, গতিরুদ্ধ বায়ু;
আবিশ্ব জিজ্ঞাসা এক চোখে মুখে ছড়ায় রঙিন
সংশয় স্পন্দিত স্বপ্ন, ভীত আশা উচ্চারণহীন
মেলে না উত্তর কোনো, সমস্যায় উত্তেজিত স্নায়ু।
ইতিহাস মোড় ফেরে পদতলে বিধ্বস্ত বার্লিন,
পশ্চিম সীমান্তে শাস্তি, দীর্ঘ হয় পৃথিবীর আয়ু,
দিকে দিকে জয়ধ্বনি, র্কাপে দিন রক্তাক্ত আভায়।
রামরাবণের যুদ্ধে বিক্ষত এ ভারতজটায়ু
মৃতপ্রায়, যুদ্ধাহত, পীড়নে-দুর্ভিক্ষে মৌনমুক।
পূর্বাচল দীপ্ত ক'রে বিশ্বজন-সমৃদ্ধ সভায়
রবীন্দ্রনাথের বাণী তার দাবি ঘোষণা করুক।
এবারে নতুন রূপে দেখা দিক রবীন্দ্রঠাকুর
বিপ্লবের স্বপ্ন চোখে, কণ্ঠে গণ-সংগীতের সুর;
জনতার পাশে পাশে উজ্জল পতাকা নিয়ে হাতে
চলুক নিন্দাকে ঠেলে, গ্রানি মুছে আঘাতে আঘাতে।
রবীন্দ্রনাথ অসময়ে বলেছিলেন, যে আছে মাটির কাছাকাছি।
সে কবির বানী লাগি কান পেতে আছি।
কবি সুকান্ত আজ নেই রবীন্দ্রনাথকে ভাটির কাছে নেমে আসতে বলছেন। এই রবীন্দ্রনাথের চোখে থাকবে বিপ্লবের স্বপ্ন কন্ঠে থাকবে গণসঙ্গীতের সুর। অনাগত উজ্জ্বল দিনের পতাকা হাতে নিয়ে তিনি জনতার সঙ্গে পা মিলিয়ে মিছিলে হাঁটবেন। মাটির পৃথিবী থেকে দূরে বসে থাকবেন না তিনি। দূর থেকে মানুষের মর্মবেদনা অনুভব করেই তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে থাকবেন না। পুরোনো রবীন্দ্রনাথের সব গুণ সঙ্গে নিয়ে মাটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষের মাঝে নতুন করে জন্ম নেবেন তিনি।
যদিও সে অনাগত, তবু যেন শুনি তার ডাক আমাদেরই মাঝে তাকে জন্ম দাও পঁচিশে বৈশাখ।।

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ