রবীন্দ্র নাথ
-
----যদি কেউ কথা না কয় ------------
সম্ভবত মহাত্মা রবীন্দ্রনাথ আজকের সমাজে অপ্রয়োজনীয় এক দায়। তাঁর প্রতি আমাদের অভ্যস্ত উপেক্ষা যেন সচেতন অপরাধ। যিনি "আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসি" বলে আমাদের বহুদূরে ডেকে নিয়ে যান, তাঁর সান্নিধ্যে আমরা ভয় পাই। কারণ, আমরা চিরকাল চেয়েছি ‘ঘরে বাইরে’র বাইরের দৃষ্টিকে, অথচ রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিয়ে যেতে চেয়েছেন ‘সোনার তরী’র গভীর দিগন্তে।
তাঁকে নিয়ে কথা বলা অনেকটা আয়নার সামনে দাঁড়ানোর মতো...সরাসরি মুখোমুখি হতে হয় নিজের ভেতরের ভয়, সংকট, স্বার্থ আর ভান করা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। তাই আমরা সহজে বলি...“রবীন্দ্রনাথ এখন পুরনো হয়ে গেছেন।” আসলে, তিনি এতটাই আপ-টু-ডেট যে আমাদের মানসিক অপারেটিং সিস্টেমে তাঁর ভার্সনটা চলে না। তিনি ‘আধুনিক’ নন...এই অভিযোগ যে ক’জন করে, তারা জানে না "কালান্তর"-এর ভাষা শুধুমাত্র আধুনিকতা নয়, ভবিষ্যতের পূর্বাভাষ। তাঁর ‘নবযুগ’ কোনো রাষ্ট্রের মনোযোগ কুড়োবার ভাষা নয়, বরং আত্মার দিগন্তে ডানা মেলা বলাকা।
তিনি ‘পোস্টমাস্টার’-এর রতনের চোখে নির্জনতার অশ্রু দেখিয়েছেন, ‘দেনা-পাওনা’-য় সমাজ নামক যন্ত্রের নিষ্ঠুরতা তুলে ধরেছেন, আবার ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’-এ শিশুমানবতার স্নিগ্ধ আর্তি। তাঁর ‘কঙ্কাল’ যেখানে সভ্যতার ভেতরের শূন্যতাকে প্রকাশ করে, সেখানে ‘স্বর্ণমৃগ’ আমাদের প্রবৃত্তির প্রতিচ্ছবি।
ঠাকুর মশাই… এমন এক ‘অতিথি’ যাঁকে ঘরে রাখলে আত্মদহন হয়, অথচ চলে গেলে ঘর শূন্য লাগে। ‘মানভঞ্জন’, ‘বলাই’, ‘হৈমন্তী’, ‘স্ত্রীর পত্র’...সব গল্পেই যেন আমরা নিজেরাই ধরা পড়ি। প্রেম, সমাজ, নারী, পারিবারিক কাঠামো...সবকিছু ভেঙে তিনি আমাদের শোনান ‘যেতে নাহি দিব’...এই চিরন্তন হৃদয়স্পন্দন। তাঁকে আমরা বইয়ের পৃষ্ঠায়, গানের রেকর্ডে, স্ট্যাটাসের নিচে কিছু পঙ্ক্তিতে...কিন্তু আমাদের ভেতরকার আলো-আঁধারিতে, দ্বিধা-দ্বন্দ্বে, খুব একটা জায়গা রাখি না আর। কারণ, তিনি সহজ ছিলেন না...তিনি সত্য ছিলেন।
তাঁর নাটক...‘বাল্মীকিপ্রতিভা’, ‘বিসর্জন’, ‘মালঞ্চ’...আমাদের অন্তঃকরণে ঝড় তোলে। যেখানে দেবতা মানুষ হয়ে ওঠে, রাজনীতি হারিয়ে যায় মানবতাবোধে, প্রেম উতরে যায় আত্মত্যাগে। ‘বিসর্জন’ নাটকে…..ধর্ম আর মানবতার দ্বন্দ্বে নৈতিক সাহস জরুরি। তাই বোধহয় তাঁকে দূরে রাখা আমাদের রক্ষণশীল মানসিকতার প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া। তাঁর নাট্যজগৎ আমাদের বাধা দেয়, রুটিন ভেঙে ভাবতে শেখায়। যে সমাজ ‘চলে যা’ বলার আগে না ভেবে বলে ফেলে, রবীন্দ্রনাথ সেখানে বলেন...‘দাঁড়াও, কেন যাবে?’
আমরা যারা আজকের তথাকথিত প্রগতির ধ্বজাধারী তারা কি আসলে শান্তি চাই? না। আমরা চাই শোরগোল। তাই ‘ঘরে বাইরে’র বিপ্লবী সন্ত্রাস বা ‘গোরা’র আদর্শিক দ্বন্দ্ব...এসব এখন অচল কাগজ। কারণ আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আত্মসমালোচনা অচল, আত্মস্বর্থই শেষ কথা। অথচ, রবীন্দ্রনাথের ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ প্রবন্ধে তো আমাদের সব অহংকারে কাঁপুনি ধরে যায়।
‘চোখের বালি’র বিনোদিনী এখনো আমাদের সমাজে বিষময় ‘স্বাধীনতা’...যাকে আমরা ভয় পাই। ‘শেষের কবিতা’র অমিত এখনো প্রশ্ন করে, জীবনের উপসংহার কি প্রেমের অতৃপ্তি? ‘গোরা’ বা ‘যোগাযোগ’ কোনো পুরনো সময়ের দলিল নয়...এগুলো আজও আমাদের ভিতরের অন্ধ বিশ্বাস, পরিচয়ের সংকট আর স্বাধীনতার ব্যর্থ আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কথা বলে। গোরা জানে না সে কে, আর মাধবীলতা জানে না কাকে ভালোবাসা যায়...এই দ্বন্দ্ব আজও আমাদের আছে, শুধু আমরা তা অন্য নামে ডাকি।
রবীন্দ্রনাথের গানে আমরা যাকে দেখি, সে কি কেবলই ছবি? তিনি লিখেছেন, “তুমি কি কেবলি ছবি”...এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে আমাদের সাহস লাগে। তাঁর গানে প্রেম শুধু বিলাস নয়, “ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখ”...এই নিবেদনের চিত্র।
‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’...এই একাকীত্ব বোধহয় আমাদের সাহস নয়, আত্মপ্রত্যয়ের অনুশীলন। আর তাই ‘তুমি রবে নীরবে’ হয়ে ওঠে আমাদের অন্তরের নীরব স্বর। তাঁর গান “বরিষ ধারা মাঝে শান্তির বাণী”...এখনও আমাদের অশান্ত হৃদয়ের একমাত্র অবলম্বন। তিনি আমাদের শেখান, “আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর”...এই আনন্দ বাহ্য নয়, অন্তরের। তিনি বলেন, “আমি পুজোর ছলে তোমায় ভুলে থাকি”...সম্ভবত এই ছলনাকে স্বীকার করি না । ‘খেলাঘর বাঁধতে এসেছি’, অথচ আমরা হয়তো বুঝি না, এই খেলা জীবন-মরণ-আত্মার।
“জগৎজুড়ে উদার সুরে আনন্দ গান বাজে”...এই গানই আজ থেমে গেছে। কারণ, আমরা এখন চেয়েছি রুদ্ধ, বদ্ধ, কৃত্রিম উল্লাস। ঠাকুর বলেন, “নাচে জন্ম, নাচে মৃত্যু পাছে পাছে”...এই জীবন তো এক চলমান রসের উৎসব। কিন্তু আমরা ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু’...এই অশ্রুপাতকে ঘৃণা করি।
তাঁর কবিতা...‘বর্ষাযাপন’, ‘দুই পাখি’, ‘যেতে নাহি দিব’, ‘বসুন্ধরা’, ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’, ‘শঙ্খ’, ‘বলাকা’...সবই আমাদের ক্লান্ত সমাজচেতনাকে ঝাঁকি দেয়। ‘দুই পাখি’ কবিতায় আমরা দেখি দুই জীবনের দুই প্রবণতা...বন্ধন ও মুক্তি। ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ যেন আজকের তরুণ প্রজন্মের নিরুদ্দেশতার প্রতীক।
তাঁর প্রবন্ধ...‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’, ‘রায়তের কথা’, ‘নবযুগ’, ‘পঞ্চভূত’...সবই সমাজের ব্যাধিকে নির্মম স্পষ্টতায় তুলে ধরে। ‘রায়তের কথা’ আজও কৃষকের মুখে ধ্বনিত হয়, ‘নবযুগ’ আজও ভবিষ্যতের মেঘে রং লাগায়।
তবুও আমরা রবীন্দ্রনাথকে পড়ি না। কারণ তিনি আমাদের মুখোশ খুলে দেন। আমাদের চকমকে আত্মপ্রতিমা ভেঙে দেন। তাঁর উপস্থিতি আমাদের বিব্রত করে। তিনি আমাদের বলতে চান...সৌন্দর্য মানে আলংকারিকতা নয়, তা সত্যের চোখে চোখ রাখা। আমরা এখন ভয় পাই সত্যকে। তাই বলি, “রবীন্দ্রনাথকে পড়া কঠিন।” আসলে, রবীন্দ্রনাথকে পড়া মানে নিজেকে পড়া...এই ভয়টাই অসহ্য।
অবশ্য--, রবীন্দ্রনাথকে এখন পড়া উচিত নয়। তিনি আমাদের আত্মবিশ্লেষণে বাধ্য করবেন। তিনি আমাদের আত্মম্ভরিতা ভাঙবেন। তিনি আমাদের দূরে সরিয়ে দেবেন বাহ্যিক বিলাস থেকে। কারণ তিনি আমাদের কমফোর্ট জোনে থাকতে দেবেন না। তিনি আমাদের মুখোশ খুলে দেখাবেন...আমরা ভিতরে কতটা শূন্য।
তাঁর কাছে গেলে জানতে হবে...
“তুমি কার মতো বাঁচছো,......... নিজে কবে বাঁচবে?
Comments
Post a Comment