রবীন্দ্র নাথ

গীতবিতান 
পূজা ৭ 

তোমার বীণা আমার মনোমাঝে
কখনো শুনি, কখনো ভুলি, কখনো শুনি না যে।
আকাশ যবে শিহরি উঠে গানে
গোপন কথা কহিতে থাকে ধরার কানে কানে—
তাহার মাঝে সহসা মাতে বিষম কোলাহলে
আমার মনে বাঁধনহারা স্বপন দলে দলে।
হে বীণাপাণি, তোমার সভাতলে
আকুল হিয়া উন্মাদিয়া বেসুর হয়ে বাজে।
চলিতেছিনু তব কমলবনে,
পথের মাঝে ভুলালো পথ উতলা সমীরণে।
তোমার সুর ফাগুনরাতে জাগে,
তোমার সুর অশোকশাখে অরুণরেণুরাগে।
সে সুর বাহি চলিতে চাহি আপন-ভোলা মনে
গুঞ্জরিত-ত্বরিত-পাখা মধুকরের সনে।
কুহেলী কেন জড়ায় আবরণে—
আঁধারে আলো আবিল করে, আঁখি যে মরে লাজে।

রচনা ১৬ মার্চ ১৯২৬ 
আলিপুর, কলকাতা 

এ গানটি রচনার সময় রবীন্দ্রনাথ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের আলিপুর সরকারি কোয়ার্টারে অতিথি । রচনাপ্রসঙ্গে নির্মলকুমারী মহলানবীশ লিখেছেন; 
--- ওঁর জন্য ফলের রস নিয়ে গিয়ে দেখি একটি ছেলে একখানা মোটা খাতা নিয়ে ওঁর পায়ের কাছে বসে কী যেন পড়ে শোনাচ্ছে আর উনি অত্যন্ত বিষণ্ণ  মুখে গালে হাত দিয়ে আরামচৌকিতে বসে গম্ভীর হয়ে শুনছেন। আমি নিজে অপরিচিত লোকের সামনে না গিয়ে চাকরের হাত দিয়ে রস পাঠিয়ে দিলাম।

 রোজই স্নানের বেলা হয়ে গেলে আমি গিয়ে তাগিদ দিয়ে লেখার টেবিল থেকে ওঠাই ; সেদিনও সময়মতো গিয়ে দেখি তখনও ছেলেটি বসে আছে। আরো একটু অপেক্ষা করে আবার যখন ফিরে গেলাম দেখি উনি গম্ভীর হয়ে একা বসে , আগন্তুক চলে গেছে। আমি ঘরে ঢুকতেই বলে উঠলেন, " জানো, ও পাগল? বেচারির জন্যে আমার ভারি মন খারাপ হয়ে গেছে। মস্ত একটা কবিতার খাতা নিয়ে এসেছিল আমাকে শোনাবে বলে। এত কাজ হাতে জমে আছে , তবু বলতে পারলুম না যে , আমার সময় নেই। ওর যদি মাথা খারাপ না হত তা হলে একজন উঁচু দরের কবি হতে পারত। বেচারার কবিতাগুলোর আরম্ভ বেশ পাকা রকমেরই হয় , কিন্তু কয়েক লাইন লিখতে লিখতে সূত্র ছিঁড়ে যায়, আর শেষ করতে পারে না। ও নিজে জানে না যে ও পাগল , তাই ভেবে পায় না কেন যে শেষ পর্যন্ত ওর লেখা পৌঁছয় না ।তাই এসেছিল আমার কাছে যদি কিছু সাহায্য করতে পারি। ওর এরকম ভাগ্য কেন হল বল তো? ও বেচারার জন্য আজ আমার এত কষ্ট হয়েছে যে , সমস্ত সকালটা কাজ ফেলে দিয়ে ওর অনুরোধ রক্ষা করে লেখাগুলো শুনলুম।কিন্তু মনে ব্যথা দিয়ে বলতে পারলুম না যে, আমার কাজ আছে , এখন যাও। হতভাগ্য  একটুর জন্য বাণীর প্রসাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছে ।আমাদের সকলের ভিতরেই তো একটা পাগল আছে ।তা না হলে কবিতা লিখি কেমন করে ? কিন্তু ওর পাগলামির ডিগ্রিটা একটু বেশি, এই যা তফাত। 

সেদিন দুপুরবেলাও কাজে বসলেন না। বিকেলে চায়ের সময় ঘরে গিয়ে দেখি টেবিলে বসে একটা কবিতা  লিখছেন। এই কবিতাই " তোমার বীণা আমার মনোমাঝে"।

বিকেলবেলাতেই সুর বসিয়ে গানটা আমাকে শেখালেন।গাইবার সময় বললেন, " সারাদিন ওর কথা ভুলতে পারছিলুম না বলে মনের মধ্যে গানটা তৈরি হয়ে উঠল।ও বেচারার কেবলই তার ছিঁড়ে যায় তাই বীণাপাণির দরবারে ঢুকতে পারল না।"

[[সূত্র---- "বাইশে  শ্রাবণ "

রোগশয্যায় বিশ্বকবি তখন চার দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ। তাঁর গভীর ঘুমের সময় সকলে তটস্থ হয়ে দূর থেকে দেখে, শ্বাস-প্রশ্বাস যথাযথ হচ্ছে কি না। ফিসফিস করে খবর চালাচালি হতে থাকে। বেশির ভাগ সময় সোফায় আচ্ছন্ন ভাবে দীর্ঘ ক্ষণ বসে থাকেন। এক সময় নিজের অজান্তেই বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। এক দিন রাত বারোটার পর তন্দ্রা ভেঙে গেলে জানতে চান, ‘‘দারোয়ানের যেন পেটে ব্যথা হয়েছিল। কেমন আছে সে?’’ কোনও দিন কুকুরটাকে খাবার দিয়ে আদর করতেন। কৌতূহল নিয়ে দেখতেন চড়ুইটাকে। তাদের নিয়ে তাঁর অজস্র প্রশ্ন। মৃত্যুভয় তাঁকে কখনও কাবু করতে পারেনি। এক দিন মজা করে তাঁকে বলা হয়েছিল, বুড়ো বয়সে সবাই ঠাকুরদেবতার নাম জপে, আর আপনি পশুপাখি লোকজন নিয়ে হাসি গল্প করছেন। লোকে কী বলবে আপনাকে? কবি আরও মজা পেয়ে ছদ্মগাম্ভীর্যে বললেন, ‘‘সত্যিই তো লোকে কী বলবে!’’

জোড়াসাঁকোয় অসুস্থ কবিকে সারা ক্ষণ দেখাশোনা করতেন নির্মলকুমারী মহলানবিশ (রানী)। কবি তাঁকে মজা করে বলতেন ‘হেডনার্স’। কবির শেষ দিনগুলির রোজনামচা লিখে গেছেন ‘বাইশে শ্রাবণ’ বইটিতে। শ্রীমতি মহলানবিশের কোথাও যাওয়ার কথা উঠলেই কবি হুমকি দেন ‘‘শেষ পর্যন্ত এমন একটা অসুখ করবে, তখন দেখি আমার হেডনার্স কি করে যায়।’’ ]]

প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ ও নির্মলকুমারী মহলানবিশের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ.
.

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ