অমৃতকথা
অমৃত
হে মহারাজ, ভুবনপালক, সর্বশক্তিমান সেই ঈশ্বর অসুরবিনাশের জন্য কালরূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন। ভূভার হরণ ও অসুরনিধনরূপ দেবকার্য সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু এখনো কিছু কাজ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাকি আছে। সুতরাং যতক্ষণ তিনি পৃথিবীতে বর্তমান, ততক্ষণ তোমরাও অপেক্ষা কর। যুধিষ্ঠির নারদমুনির কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তাঁর পিতৃব্যগণ কোথায় গেছেন। নারদ তাই জানাচ্ছেন, ধৃতরাষ্ট্র ভ্রাতা বিদুর ও পত্নী গান্ধারীকে সঙ্গে নিয়ে হিমালয়ের দক্ষিণদিকে কোন ঋষির আশ্রমে গেছেন। সেইস্থানে মরীচি, অত্রি প্রভৃতি প্রখ্যাত সাতজন ঋষির সন্তোষবিধানের জন্য প্রসিদ্ধ গঙ্গানদী নিজেকে সাতটি ধারায় বিভক্ত করে, মরীচি গঙ্গা, অত্রিগঙ্গা ইত্যাদি সাতটি নাম ধারণ করেছেন।
সেইজন্য স্থানটির নাম সপ্তস্রোত। পুত্র-বিত্ত, নাম-যশ প্রভৃতি সকল এষণা পরিত্যাগ করে, প্রশান্তচিত্ত ধৃতরাষ্ট্র সেই তীর্থক্ষেত্রে নিত্য ত্রিসন্ধ্যা স্নান করে, অগ্নিতে আহুতি দিয়ে ও কেবলমাত্র জলপান করে অবস্থান করতে লাগলেন।
ধৃতরাষ্ট্র আসনে স্থিরভাবে উপবিষ্ট হয়ে, প্রাণায়ামের দ্বারা শ্বাসপ্রশ্বাস সংযত করে, বিষয় থেকে ইন্দ্রিয়গুলিকে প্রত্যাহৃত করে, ত্রিগুণজাত মলিনতা মন থেকে বিদূরিত করে ভগবৎ চিন্তায় নিমগ্ন হলেন। ধৃতরাষ্ট্র অহঙ্কারের উৎপত্তিস্থল স্বরূপ মনকে বিজ্ঞানাত্মায় অর্থাৎ বুদ্ধিতে সংযুক্ত করে, তারপর সেই শুদ্ধমনকে জীবাত্মায় বিলীন করলেন। তারপর ধীরে ধীরে সেখান থেকে সরে এসে আশ্রয়স্বরূপ পরমাত্মায় নিজেকে লয় করে দিলেন, যেমনভাবে ঘটাকাশ লয় হয়ে যায় মহাকাশে। ধৃতরাষ্ট্র এখন মায়া-গুণের প্রভাব থেকে ঊর্ধ্বে উঠে, ইন্দ্রিয় ও মন বশীভূত হওয়ায় সকল বিষয়বাসনা পরিত্যাগ করে স্থাণুর মতো অচলভাবে অবস্থান করছেন।
হে রাজন, সর্বকর্মপরিত্যাগী ধৃতরাষ্ট্রের মোক্ষলাভের পথে তুমি বাধা সৃষ্টি করো না। আজ থেকে পরবর্তী পঞ্চম দিবসে তিনি নশ্বর কলেবর পরিত্যাগ করবেন। শুধু তাই নয়, যোগপ্রভাবে সেই দেহটি আপনা থেকেই ভস্মীভূত হয়ে যাবে। পর্ণকুটীর সহ স্বামীর দেহটি ভস্মীভূত হলে, বাইরে অবস্থিত গান্ধারী পতির পরেই সেই অগ্নিতে আত্মবিসর্জন দেবেন। হে কুরুনন্দন যুধিষ্ঠির, সেই অলৌকিক দৃশ্য দেখে বিদুরও যুগপৎ আনন্দ ও শোকে অভিভূত হয়ে সেই স্থান ছেড়ে তীর্থপরিক্রমায় বহির্গত হবেন। এই কথাগুলি বলে নারদ বীণাসহ স্বর্গে গমন করলে, যুধিষ্ঠির তাঁর কথা হৃদয়ঙ্গম করে শোক পরিত্যাগ করলেন। সুত বললেন, ঋষিগণ, জিষ্ণু অর্জুন যদুকুলের বন্ধুগণের সহিত সাক্ষাৎ করার বাসনায় এবং পুণ্যশ্লোক কৃষ্ণের মনের ইচ্ছা ও কার্যাদি জানার জন্য দ্বারকানগরীতে যাবার পর কয়েকমাস অতিবাহিত হয়ে গেল। কিন্তু তখনো অর্জুন ফিরলেন না। এদিকে কুরুরাজ যুধিষ্ঠির চারিদিকে নানাপ্রকার ভয়ঙ্কর অশুভ চিহ্ন দেখতে লাগলেন। মহারাজ যুধিষ্ঠির দেখলেন কালের গতি অত্যন্ত দুর্লক্ষণযুক্ত হয়েছে। শীতগ্রীষ্মাদি ঋতুর স্বাভাবিক ধর্ম বিলুপ্ত। ক্রোধ-লোভপরায়ণ জনসাধারণের জীবন মিথ্যাভাষণ ও অশাস্ত্রীয় আচরণে পূর্ণ। তাই শুধু নয়, মানুষের ব্যবহার ছলনাময়, মিত্রতা শঠতামিশ্রিত, পিতা-মাতা-ভ্রাতা-বন্ধু-দম্পতি সকলেই পরস্পর কলহে রত।
Comments
Post a Comment