রাজা রামমোহন রায়
ভোরবেলায় মুগুর ভাঁজতেন | তারপর লড়তেন কুস্তি | তারপরে ল্যাঙোট পরে পালোয়ান দিয়ে তেলমালিশ | একবারে খেতে পারতেন গোটা পাঁঠা | প্রতিদিন খেতেন বারো সের দুধ | তারপরেও খেতে পারতেন পঞ্চাশটা আম কিংবা এক কাঁদি নারকেল | হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতা ও মৌলবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন যখন, তখন তাঁকে দেওয়া হয়েছিল খুনের হুমকি। ইসলামে গোঁড়ামির সমালোচনা করে প্রবন্ধ লিখে ইসলামী মৌলবাদীদেরও চক্ষুশূল হয়েছিলেন | কলকাতার কিছু লোক প্রায়ই তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়ত | নিরুপায় হয়ে বেশিরভাগ সময় গাড়ির জানালা বন্ধ করে রাখতেন | কেউ বা বাড়ির ভেতরে গরুর হাড় ফেলে দিত । এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে গান রচনা করে শহর কলকাতার রাস্তায় সেই গান গাইবার ব্যবস্থা অবধি তাঁরা করল | এখানেই শেষ নয় | তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা পর্যন্ত করেছিল বিরোধীপক্ষের লোকেরা | শুভানুধ্যায়ীরা বলতেন, 'একটু সাবধানে থাকবেন।' হেসে বলতেন , ‘‘কলকাতার লোক আমাকে মারবে? তারা কী খায়?’’
‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন | সেখান থেকে হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন | নিন্দুকেরা গুজব রটাল আত্মীয় সভায় লুকিয়ে লুকিয়ে গো মাংস খাওয়া হয় | অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু একথা শুনে তাঁকে ত্যাগ করলেন। কিন্তু তা সত্বেও তিনি নির্বিকার |
সেই সময় বেদ শূদ্র সম্প্রদায়ের শোনার অধিকার ছিল না | তা উচ্চারণ করলে নাকি জিহ্বা কেটে দেওয়ার রীতি ছিল | তিনি বেদ-কে অনুবাদ করে সাধারণ মানুষের কাছে উন্মুক্ত করে দিলেন | হিন্দু সমাজে চাঞ্চল্য ও উত্তেজনার সৃষ্টি হল। শুরু হল তাঁর প্রকাশ্য বিরোধিতা | কিন্তু তিনি নির্বিকার |
তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন আধুনিক এক ভারতের | দেশের মানুষকে অতীতমুখী, মধ্যযুগীয় মানসিকতার গণ্ডি থেকে বের করে এনে এক নতুন যুগের জীবন দর্শনের আলো দেখানোই ছিল তাঁর জীবনদর্শন | তিনি ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ | একই সঙ্গে হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মের গোঁড়ামির মুখেই ঝামা ঘষার আর এক নাম রামমোহন রায় | ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রতিবাদ করতে গিয়ে যিনি নিজের বাপকেও ছেড়ে কথা বলেননি | জীবনে প্রতিমুহূর্তে সহ্য করেছেন লাঞ্ছনা , বিরোধীপক্ষের হেনস্থা | কিন্তু তিনি ছিলেন বটবৃক্ষের মত অটুট | ইংরেজি বেদান্ত গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখলেন, “আমি ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করে বিবেক ও সরলতার আদেশে যে পথ অবলম্বন করেছি তাতে আমার প্রবল কুসংস্কারাচ্ছন্ন আত্মীয়গণের তিরস্কার ও নিন্দার পাত্র হতে হল। কিন্তু যাই হোক না কেন, আমি এই বিশ্বাসে ধীরভাবে সমস্ত কিছু সহ্য করতে পারি যে, একদিন আসবে, যখন আমার এই সামান্য চেষ্টা লোকে ন্যায় দৃষ্টিতে দেখবে।”
আপনি শুধু রাজা নন, আপনি রাজার রাজা । শ্রদ্ধাঞ্জলি রাজা রামমোহন রায় |
শ্রদ্ধার্ঘ্য |
Comments
Post a Comment