রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের সাথে রানুর প্রথম পরিচয় সম্ভবত তাঁর দশ বছর বয়সে যখন তাঁর পিতা ফনীভূষণ কলকাতায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। কবি তাঁকে দেখবার জন্য একটি কালো মটরে ওই ভাড়াবাড়িতে আসেন। ছোট্ট রানুকে তিনি দিয়েছিলেন একটি বিলিতি পুতুল। সেটাই রানুকে তাঁর ভাদুদার প্রথম উপহার। আর ফ্রান্স তাঁকে সম্মানিত করে ' লিজিয়ান অফ অনারে'। তিনি লেডি রানু মুখোপাধ্যায়।

অনেকেই বলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিয়েতে ঘটকালি করেছেন। তবে কথাটা সঠিক নয় রানুর বিয়ের ঘটক নির্মলকুমারী মহলানবিশ।  রবীন্দ্রনাথ বরং রানুর বিয়ের খবর শুনে অবাক হয়ে তাঁর জননী কে চিঠিতে লিখেছিলেন " চিঠি পেয়ে বজ্রাহত হলুম"। আর নির্মলকুমারী মহলানবিশ স্মৃতিচারণা করেছেন - ১৯২৩ - এ আমার বিয়ের পর প্রথম রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে গিয়ে দেখি একটা মেয়ে রবীন্দ্রনাথের পাশের চৌকিতে বসে চা খাচ্ছে, টেবিলে আরো অনেক লোক, কিন্তু রানুর যেন সকলের চেয়ে বেশি অধিকার কবির পাশে বসার। সেই থেকে আলাপ, তিনি ঘটকালি করে বিয়ে দিলেন বীরেন মুখার্জির সঙ্গে।রানুর বিয়ের পিঁড়ি এঁকে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী, বিয়ের পদ্য বা উপহার লিখে দেন অনুরূপা দেবী। 

রানু যখন লেডি হননি তখন তাঁর দুটো পারিবারিক পরিচয় ছিল। প্রথম পরিচয় তিনি অধ্যাপক ফণিভূষণ অধিকারীর কন্যা। একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা।  রানুর শ্বশুর বিখ্যাত বাঙালি শিল্পপতি স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় যাঁর তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়েছে পলতা ওয়াটার ওয়ার্কস, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল,মার্টিন কোম্পানির রেল লাইন স্থাপনের কৃতিত্বের মূলেও তিনি। স্যার রাজেন্দ্রনাথের পুত্র স্যার বীরেন্দ্রনাথের মানসপুত্র ইন্ডিয়ান আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি। পশ্চিমবঙ্গের শেষ স্যার তিনি। বিয়ে করে আনলেন রানু অধিকারীকে। তিনি ও এই রাজ্যের শেষ লেডি বটে।ফনিভূষণ বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক। তাঁর সহধর্মিণী সরযূবালা দেবী প্রবাসী বাঙালির কন্যা। সুগায়িকা এবং রবীন্দ্রকাব্য মুগ্ধা। কাশীতেই তাঁর কন্যাদের জন্ম। ভক্তি,আশা,প্রীতি,শান্তি।  প্রীতি রানু নামেই সবার পরিচিত। ছবির প্রতি রানু আজন্ম আলাদা আকর্ষণ অনুভব করেছেন। শান্তিনিকেতনে ছবি আঁকা শিখতেন সুরেন করের কাছে। অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ,যামিনী রায় সবাইকে দেখেছেন।যামিনী রায়ের আঁকা ১৬০ টি ছবি তাঁর সংগ্ৰহে ছিল। যখন স্কুলে পড়তেন ড্রয়িংয়ে প্রথম হতেন।

রানু পড়তেন কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে বি এ ভর্তি হন। অনতিকালের মধ্যে বিয়ে হয়ে যায়, প্রথাগত শিক্ষার জীবনে ছেদ পড়লেও এইসময়ে রুশ ও ফরাসি ভাষা চর্চা করেছেন। ফ্রান্স তাঁকে সম্মানিত করে ' লিজিয়ান অফ অনারে'। সুন্দরী রানুর বিয়ের জন্য বাবা- মায়ের চিন্তা স্বাভাবিক।  রানুর বিয়ের ঘটক নির্মলকুমারী মহলানবিশ । তিনি ঘটকালি করে বিয়ে দিলেন বীরেন মুখার্জির সঙ্গে। লেডি রানু যখন লেডি হননি তখনই তিনি সুপরিচিত হয়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সাথে গভীর স্নেহ - সম্পর্কের জন্য। তাদের পত্রালাপ সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। 
ছবি আঁকা শিখতে রানু যখন শান্তিনিকেতনে এসে কিছুকাল ছিলেন কবির নাটকে বেশ কয়েকবার অংশগ্রহণ করেন। ১৯২৩ সালে শান্তিনিকেতনের অর্থকষ্ট সাহায্যের জন্য কবি ' বিসর্জন' নাটক মঞ্চস্থ করলে ' অপর্ণার' ভূমিকায় রানু অভিনয় করেন। সেই অভিনয়ের প্রবল প্রশংসা করে ইণ্ডিয়ান ডেলি নিউজে অমৃতলাল বসু চিঠি লিখেছেন।

একবার এলমহার্স্ট কাশীতে এলে কবি তাঁকে বলেছিলেন রানুর বাড়িতে তিনি যেন অবশ্যই যান একবার ‌। এলমহার্স্ট ফিরে এলে কবি জিজ্ঞেস করেছিলেন - সখে,রানু নামধারিণী কাশীবাসিনী বালিকাকে কেমন দেখলে আমার কাছে প্রকাশ করে বল। এলামহার্স্ট বলেছিলেন - বন্ধু সি লুকড ভেরি হ্যাপি।রানু রবীন্দ্রনাথ কে বালিকা বয়স থেকে চিঠি লিখতেন। সম্বোধন করতেন কবির স্বনামকৃত ' ভানুদাদা' কখনও রবিদাদা নামে। গোটা গোটা অক্ষরে স্পষ্ট করে চিঠি দিতেন, তারিখ উল্লেখ থাকত না। শেষের দিকের চিঠিতে অবশ্য তারিখ থাকত।

লেডি রানুর জীবনটাই এমনি ছবির জগৎ।, তাঁর প্রথম পোট্রেট আঁকেন বিখ্যাত শিল্পী হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার। পরে অতুল বসু ‌। সেই ছবি একটা এগজিবিশনে দিতে চাইলেন অতুল বসু তবে স্যার বীরেন আপত্তি জানান। পরে স্কেচ সহ সমস্ত কাজ অতুল বসু অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস কে দিয়ে দেন।

রানুর সংগ্ৰহে যেমন ছিল বালুচরী শাড়ি, শিল্পীদের ছবি, তেমন সাজতে ভালবাসতেন ‌। কাশীতে থাকার সময় পরতেন হাঁটুর নীচে অবধি পাজামা ও ঢোলা কুর্তা। পরে বীরেন মুখার্জির বউ হয়ে ধনেখালি,শান্তিপুরী,ডুরে শাড়ি। একবার দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে গরম প্যান্ট পরলেও বিদেশে কিন্তু শাড়ি ছাড়া কিছুই পরতেন না। অবশ্য সেট করে গয়না পরতেন। বাসে- ট্রামে কখনও চড়েন নি,ভাল ভাবে চা- টা নাকি করতে পারতেন না!

গয়নার কথা বলতে গিয়ে রানুর বাড়িতে চুরির কথা বলতে হয় ,সেখানে আছে আংটি রহস্য। ১৮হিরেখচিত নীলার আংটিও চুরি হয়। ওই আংটি রবীন্দ্রনাথ তাঁকে উপহার দেন বলে দাবি লেডি রানু মুখার্জির। ওই আংটি কবির পারিবারিক গহনা। পুলিশ সেই আংটি উদ্ধার করে। আদালতে মামলা হয়। আদালতের নির্দেশে রানু অবশ্য সেই আংটি ফেরত পেয়েছিলেন, তখন তাঁর দুচোখ স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে ওঠে।

মজার বিষয় হল এই সংবাদের সত্যতা নিয়ে প্রবল আপত্তি জানান কবির ঘনিষ্ঠ,আর এক স্নেহধন্যা মৈত্রেয়ী দেবী। বিশেষত ১৯৪১ সালে কবি যখন প্রবল অসুস্থ তখন তো গয়না দেবার প্রশ্ন ওঠে না। মৈত্রেয়ী দেবীর দাবি তাঁকে ছাড়া কবি কাউকে এমারেল্ডের আংটি দেননি ‌। অথচ রানুকে আংটি দেওয়ার কথা কবি 
ছাড়াও নাকি জানতেন এলমহার্স্ট!
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে রানু বলেছিলেন " আমি আমার জীবনকে তাঁরি কাজে উৎসর্গ করেছি"।


তিন মাস জাপান ঘুরে আমেরিকা এসেছে রবীন্দ্রনাথ। জাপানে ওর বিদায়বেলা বিশেষ সুখকর হয়নি। সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের চেয়ে বিশ্ব মানবতাবাদ কত মহৎ সেটা সে জাপানীদের বোঝাবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু যুদ্ধের সময় রবীন্দ্রনাথের জাতীয়বাদবিরোধী বক্তব্য জাপানীদের পছন্দ হয়নি। তাই জাপান ছেড়ে আসার সময় ওদের মনোভাব ছিল শীতল। ওকে  বিদায় জানাতে তেমন কোন বড় নেতা বন্দরে আসেনি। 

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লাইসিয়াম নামের একটা প্রতিষ্ঠানের চুক্তি হয়েছে ও আমেরিকায় মোট চল্লিশটা বক্তৃতা দেবে। প্রতি বক্তৃতার জন্য পাঁচশ ডলার করে পাবে। শান্তিনিকেতনে আর্থিক সংকট চলছে। এই টাকাটা শান্তিনিকেতনের জন্য খুবই জরুরী। সিয়াটল সানসেট ক্লাবে বিরাট জোব্বা পরা শুভ্র শ্মশ্রুমন্ডিত কবি যখন ডায়াসের সামনে দাঁড়াল, সবাই আবেগে উদ্বেল হয়ে গেলো।  শ্রোতারা ভেবেছিল পুব থেকে আসা এই ঋষি মানুষটি রহস্যময় ভাবালুতা আর মরমিয়াবাদ নিয়ে ধোঁয়াশামাখা ললিত বাণী শোনাবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলল, আজকে আমার বক্তৃতার বিষয় কাল্ট অফ ন্যাশনালিজম। একের পর এক যুক্তি আর উপমা দিয়ে কবি জাতীয়তাবাদের ভয়ঙ্কর দিকটি উন্মোচন করল। জাতীয়তাবাদকে আক্রমণ শেষে রবীন্দ্রনাথ এবার বস্তুবাদকে ধরল। গম্ভীর গলায় বলল, পশ্চিমা বস্তুবাদ একদিন নিজের ভারে নিজেই পিষে যাবে।  






রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মা সারদাসুন্দরী দেবীর স্মৃতি খুবই কম। মাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেনও খুব কম। সারদা দেবী যখন মারা যান তখন রবীন্দ্রনাথ নিতান্তই বালক। 
.
.শিশুকালে যখন যাত্রা শুনতে যেতেন, ঘুম পাওয়া মাত্র বাড়ির চাকর আসর থেকে তুলে নিয়ে মায়ের কাছে ঘুম পাড়িয়ে দিত। যাত্রা শুরু হওয়ার পর মা স্বয়ং তাঁকে জাগিয়ে দেবেন, এই ভরসায় তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন মায়ের কোলে কিংবা মায়ের পাশের বিছানায়। মিথ্যে অসুখের নাম করে রবীন্দ্রনাথ যখন মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়তে যেতে চাইতেন না, তখন মা দাঁড়াতেন রবীন্দ্রনাথের উকিল হয়ে। 
.
.তবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মায়ের মৃত্যু স্মৃতি নিয়ে "জীবনস্মৃতি" গ্রন্থে 'মৃত্যুশোক' পরিচ্ছদে লিখেছিলেন। 
.
."মা'র যখন মৃত্যু হয় আমার তখন বয়স অল্প ৷ অনেকদিন হইতে তিনি রোগে ভুগিতেছিলেন, কখন যে তাঁহার জীবন-সংকট উপস্থিত হইয়াছিল তাহা জানিতেও পারি নাই ৷ এতদিন পর্যন্ত যে-ঘরে আমরা শুইতাম সেই ঘরেই স্বতন্ত্র শয্যায় মা শুইতেন ৷ কিন্তু, তাঁহার রোগের সময় একবার কিছুদিন তাঁহাকে বোটে করিয়া গঙ্গায় বেড়াইতে লইয়া যাওয়া হয় — তাহার পরে বাড়িতে ফিরিয়া তিনি অন্তঃপুরের তেতালার ঘরে থাকিতেন ৷ যে-রাত্রিতে তাঁহার মৃত্যু হয় আমরা তখন ঘুমাইতেছিলাম, তখন কত রাত্রি জানি না, একজন পুরাতন দাসী আমাদের ঘরে ছুটিয়া আসিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, " ওরে তোদের কীসর্বনাশ হল রে !" 
.
.তখনই বউঠাকুরানী তাড়াতাড়ি তাহাকে ভৎর্সনা করিয়া ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়া লইয়া গেলেন— পাছে গভীর রাত্রে আচমকা আমাদের মনে গুরুতর আঘাত লাগে এই আশঙ্কা তাঁহার ছিল ৷ স্তিমিত প্রদীপে, অস্পষ্ট আলোকে ক্ষণকালের জন্য জাগিয়া উঠিয়া হঠাৎ বুকটা দমিয়া গেল, কিন্তু কী হইয়াছে ভালো করিয়া বুঝিতেই পারিলাম না ৷ প্রভাতে উঠিয়া যখন মা'র মৃত্যু সংবাদ শুনিলাম তখনো সে- কথাটার
অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না ৷ বাইরের বারান্দায় আসিয়া দেখিলাম, তাঁহার সুসজ্জিত দেহ প্রাঙ্গনে খাটের উপরে শয়ান ৷ কিন্তু, মৃত্যু যে ভয়ংকর সে-দেহে তাহার কোনো প্রমাণ ছিল না ; - 
সেদিন প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে- রূপ দেখিলাম তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর ৷ 
.
.জীবন হইতে জীবনান্তের বিচ্ছেদ স্পষ্ট করিয়া চোখে পড়িল না ৷ কেবল যখন তাঁহার দেহ বহন করিয়া বাড়ির সদর-দরজার বাহিরে লইয়া গেল এবং আমরা তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ শ্মশানে চলিলাম তখনই শোকের সমস্ত ঝড় যেন একেবারে এক দমকায় আসিয়া মনের ভিতরটাতে এই একটা হাহাকার তুলিয়া দিল যে, এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর-একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকরনার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না ৷
.
.বেলা হইল, শ্মশান হইতে ফিরিয়া আসিলাম ; গলির মোড়ে আসিয়া তেতালায় পিতার ঘরের দিকে চাহিয়া দেখিলাম—তিনি তখনো তাঁহার ঘরের সম্মুখে বারান্দায় স্তব্ধ হইয়া উপাসনায় বসিয়া আছেন ৷
.
.ছেলেবেলা’ বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘পেট কামড়ানি বলে ভিতরে ভিতরে বদহজমের যে একটা তাগিদ পাওয়া যায় সেটা বুঝতে পাইনি পেটে, কেবল দরকার মতো মুখে জানিয়েছি মায়ের কাছে। শুনে মা মনে মনে হাসতেন, একটুও ভাবনা করতেন বলে মনে হয়নি। তবু চাকরকে ডেকে বলে দিতেন, “আচ্ছা, যা, মাস্টারকে জানিয়ে দে, আজ আর পড়তে হবে না’। আমাদের সেকেলে মা মনে করতেন, ছেলে মাঝে মাঝে পড়া কামাই করলে এতই কী লোকসান। এখনকার মায়ের হাতে পড়লে মাস্টারের কাছে তো ফিরে যেতেই হতো তার উপরে খেতে হত কানমলা। হয়তো বা মুচকি হেসে গিলিয়ে দিতেন ক্যাস্টর অয়েল। চিরকালের জন্য আমার হতো ব্যামোটা।’ 
.
.মায়ের একটা নিজস্ব মহিলা মহল ছিল অন্দরে। রবীন্দ্রনাথ একটু বড় হওয়া মাত্র ডাক পড়ত সেখানে। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন –‘মনে পড়ে বাড়ি-ভিতরের পাঁচিলঘেরা ছাদ। মা বসেছেন সন্ধ্যেবেলায় মাদুর পেতে, তাঁর সঙ্গিনীরা চারদিকে ঘিরে বসে গল্প করছে। ... এই সভায় আমি মাঝে মাঝে টাটকা পুঁথিপড়া বিদ্যের আমদানি করেছি, শুনিয়েছি, সূর্য পৃথিবীর থেকে ন’কোটি মাইল দূরে। ঋজুপাঠ দ্বিতীয় ভাগ থেকে স্বয়ং বাল্মিকী রামায়ণের টুকরো আউড়ে দিয়েছি অনুস্বার-বিসর্গ-সুদ্ধ। 
.
.মা জানতেন না তাঁর ছেলের উচ্চারণ কত খাঁটি, তবু তার বিদ্যের পাল্লা সূর্যের ন’ কোটি মাইল রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে তাঁকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এ সব শ্লোক, স্বয়ং নারদমুনি ছাড়া আর কারও মুখে শোনা যেতে পারে, এ কথা কে জানত বলো।’ 
.
.জীবনস্মৃতির প্রত্যাবর্তন পরিচ্ছদেও সারদা দেবীর কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন।
পাহাড় হইতে ফিরিয়া আসার পর ছাদের উপরে মাতার বায়ুসেবনসভায় আমিই প্রধানবক্তার পদ লাভ করিয়াছিলাম। মা’র কাছে যশস্বী হইবার প্রলোভন ত্যাগ করা কঠিন এবং যশ লাভ করাটাও অত্যন্ত দুরূহ নহে।’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর পাঠ্য বইয়ের দু-চারটে কবিতা পড়ে মা-কে অবাক করে দিতেন। শুধু তাই নয় অন্যের মুখে শোনা পাঁচালির গানও তিনি মা-কে শুনিয়ে বাহবা আদায় করেছেন। তারপর এলো মূল রামায়ণ পাঠ। 
.
.‘পৃথিবীসুদ্ধ লোকে কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ণ পড়িয়া জীবন কাটায়, আর আমি পিতার কাছে স্বয়ং মহর্ষি বাল্মিকীর স্বরচিত অনুস্টুভ ছন্দের রামায়ণ পড়িয়া আসিয়াছি, এই খবরটাতে মাকে সকলের চেয়ে বেশি বিচলিত করিতে পারিয়াছিলাম। তিনি অত্যন্ত খুশি হইয়া বলিলেন, ‘আচ্ছা, বাছা, সেই রামায়ণ আমাদের একটু পড়িয়া শোনা দেখি’।
.মা মনে করিনেন, আমার দ্বারা অসাধ্যসাধন হইয়াছে; তাই আর- আমাকে বিস্মিত করিয়ে দিবার অভিপ্রায়ে তিনি কহিলেন, "একবার দ্বিজেন্দ্রকে শোনা দেখি।" তখন মনে-মনে সমূহ বিপদ গনিয়া প্রচুর আপত্তি করিলাম। মা কোনমতেই শুনিলেন না। বড়দাদাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন।"

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ