শকুনি পাশা

শকুনির পাশা
দেবপ্রসাদ

মহাভারতের প্রধান খলনায়ক হলো গান্ধাররাজ সুবলের পুত্র ও গান্ধারীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শকুনি। সুবলের কোনো এক পাপের কারণে দেবতাদের অভিশাপে তাঁর বংশে শকুনির জন্ম হয়। শকুনির জন্ম কলির অংশে, তাই তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধূর্ত ও কপট। গান্ধারীর বিবাহের পর থেকে শকুনি ধৃতরাষ্ট্রের সংসারেই থাকতেন এবং ভাগিনেয় দুর্যোধনের সঙ্গে তার বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল।  অস্ত্রবিদ্যায় খুব একটা পারদর্শী ছিলেন না, তথাপি তাঁর কপট বুদ্ধিতেই সমগ্র কুরুবংশ ধ্বংস হয়েছিল।
পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে শকুনির কোনও বিদ্বেষ ছিল না, শকুনির প্রধান শত্রুতা ছিল  পিতামহ  ভীষ্মের বিরুদ্ধে।
যে সময় কৌরব মাতা গান্ধারী কুরু সংসারে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। সেই সময় একদিন পিতামহ ভীষ্মের কানে পৌঁছে গেল কেমন করে যে, গান্ধার রাজকন্যা বিবাহপূর্বে নাকি বিধবা ছিলেন। চারিদিকে গুপ্তচর ছুটল।
জ্যোতিষীদের ডাক পড়ল, সত্যাসত্য যাচাই করতে। জানা গেল গান্ধার রাজ সুবলকে রাজজ্যোতিষী বলেছিলেন, গান্ধারীর প্রথম স্বামীর আয়ু সীমিত, কিন্তু দ্বিতীয় স্বামীর আয়ু হবে অনেক। তাই তড়িঘড়ি তিনি একটি ছাগলের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দিয়ে সেই দোষ  স্খলন করেছিলেন, সত্যি সত্যিই ছাগ পুঙ্গবটি যথারীতি পরে পরেই সদাতি প্রাপ্ত হয়। তার কিছুদিন পরেই স্বয়ং ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে গান্ধারীর বিবাহ প্রস্তাব নিয়ে গান্ধার রাজ্যে পৌঁছে যান। আর সুবল দেরি না করে সেই প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে শুভকার্য সম্পন্ন করেন।

কিন্তু সেই কথা পেরে ভীষ্ম প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেন। এই সব কথা কেন তাকে জানানো হয়নি, ভীষ্ম কৌশলে শকুনির পরিবারের সকলকে ভোজনের জন্য আমন্ত্রণ করেন, সবল ও তার শতপুত্র সহ সকলে উপস্থিত হলে তাঁদের বন্দি করেন। এবং প্রতিদিন শুধু মাত্র একজনের খাবার দিতেন, 
তখন রাজা সুবল দেখলেন সকলে মিলে যদি এই খাবার খান তাহলে কেউ বেঁচে থাকবেন না, তাই সিদ্ধান্ত নেন, ভীষ্মের এই আচরণে ভীষ্ম এবং কুরু পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবেন, 
তাই তাঁর পরিবারের একজন সদস্যকে যে কোনও মূল্যে বাঁচতেই হবে। তাই শকুনি, সবচেয়ে ছোট এবং চতুর পুত্র, বেঁচে থাকার জন্য অন্য সকলের খাবার তাকে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হলো। রাজা সুবল তার মৃত্যুর আগে  শকুনির পায়ে ছুরিকাঘাত করেন এবং তাঁকে ব্যথা মনে রাখতে এবং কুরু পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের কথা স্মরণ রাখতে বললেন, "সৌবালা, এখন থেকে তুমি খুঁড়িয়ে হাঁটবে আর প্রতিবার খোঁড়ানোর সময় মনে পড়েবে আমাদের এই পরিনতির কথা, কৌরবরা ও ভীষ্ম আমাদের প্রতি কী ভীষণ অন্যায় করেছে, যার ক্ষমা নেই। কৌরবদের বিনাশেই আমার আত্মা শান্তি পাবে, সে কথা বিস্মরণ হয়ো না।"
"আমার মৃত্যুর পর আমার হাতের আঙুলগুলি তুমি নেবে, আর অস্থি দিয়ে তোমার দ্যূতক্রীড়ার ঘুঁটি তৈরি করে নেবে। এর মধ্যে আমার সমস্ত ক্রোধ ও প্রতিহিংসার বীজ লুকিয়ে থাকবে। পাশার খেলায় দান তুমি যাই দাও, তোমার ইচ্ছা অনুসারেই জয়ের ফল তুমি পাবে। লোকে তোমাকে কপট বললেও তাতে কান দিও না, কারণ এই গূঢ় গুপ্ত কথা কেউ জানবে না। তুমি যত শীঘ্র সম্ভব তোমার ভাগিনেয় সুযোধনের (দুর্যোধনের আর এক নাম) সঙ্গে যোগাযোগ করে কৌরবদের পক্ষে মিলিত হও! ভবিষ্যতে এই দ্যূতক্রীড়ার সাহায্যেই তুমি কুরু বংশের ধ্বংসের কারণ হবে। তোমার এই লক্ষ্য থেকে যেন কোনোদিন বিচ্যুত হবে না।"

এরপর শুরু হয় শকুনির সেই চাল, পাশার চাল, তাই তিনি ভাগিনেয় দুর্যোধনকে নানা কুবুদ্ধি দিতেন। তাঁর কপটতার তালিকা বারবার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে মহাকাব্যের আখ্যান। কালকূট বিষ প্রয়োগ করে ভীমকে হত্যার চেষ্টা, জতুগৃহে কুন্তী সহ পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারা, ইত্যাদি ষড়যন্ত্রে শকুনির সক্রিয় ভূমিকা ছিল। দ্যূতক্রীড়ায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্থ। যুধিষ্ঠির দ্যূতপ্রিয় হলেও, ক্রীড়া পটু ছিলেন না। তাই তাঁকে পণ-দ্যূতে আমন্ত্রণ করে সর্বস্বান্ত করার পরামর্শটা তিনিই দুর্যোধনকে দিয়েছিলেন। যুধিষ্ঠির খেলতে এলে কৌরবদের পক্ষ হয়ে দুইবার তিনিই খেলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে শকুনির পুত্র উলুক দুর্যোধনের দূত হিসেবে দুর্যোধনের শিখিয়ে দেওয়া অভদ্র অশ্লীল কথাগুলো পাণ্ডব পক্ষকে গিয়ে শোনালেন। কনিষ্ঠ পাণ্ডব সহদেব সেই শুনে ক্রোধান্বিত হয়ে শপথ করলেন যে, শকুনির সামনে প্রথমে উলুককে হত্যা করে, তারপর তিনি শকুনিকে বধ করবেন। যুদ্ধের শেষ দিনে সহদেবের হাতেই শকুনি-পুত্র উলুক ও শকুনির মৃত্যু হয়।
মহাভারতের যুদ্ধের ১৮ তম দিনে সহদেব শকুনিকে বধ করেন। দ্রৌপদীর প্রতি সমস্ত দুর্ব্যবহারের নেপথ্যে মূলত যে শকুনিই ছিল, সেকথা অনুভব করেন সহদেব। সেই কারণে তিনি শকুনিকে হত্যা করার প্রতিজ্ঞা করেন। অনেক দেশি-বিদেশি পণ্ডিত মনে করেন, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ আসলে কৌরব ও পাঞ্চালদের যুদ্ধ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধ বলা হলেও এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের নেপথ্যে কতই না কপটতার কাহিনি ডালপালা মেলেছে!

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ