তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়
সুইডিশ নোবেল কমিটি ২০২২ সালের নোবেল প্রাপকদের নাম প্রকাশ করেছিল,যারা নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন তাদের নাম প্রকাশ করার পাশাপাশি যাদের নাম মনোনীত হয়েছিল তাদের নামও প্রকাশ করার হয়েছে। ৫১ বছর পর সেই তালিকাতেই দেখা যায় নোবেল পদকের জন্য নাম ছিল কথা সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
বাংলা ও বাঙালির দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি বলা যায়! রবীন্দ্রনাথের পর সাহিত্যে আর একটি নোবেল বাংলায় আসার উজ্জল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কথা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নোবেল পুরস্কারের জন্য ১৯৭১ সালে সাহিত্যে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের সবার দুর্ভাগ্য সেই বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর তিনি প্রয়াত হন। যেহেতু মরণোত্তর নোবেল দেওয়া হয় না সেহেতু পুরস্কারের জন্য তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম আর বিবেচিত হয় নি। ওই বছর নোবেল পেয়েছিলেন পাবলো নেরুদা। যদি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বেঁচে থাকতেন,কে বলতে পারে তিনি সেবার সাহিত্যে নোবেল পেতেন না!
© ধ্রুবতারাদের খোঁজে
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য যাঁর নাম মনোনয়ন পায়,সেই তারাশঙ্কর কে একসময় সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে জীবনে অনেক সংগ্ৰাম করেছেন তারাশঙ্কর। পাইস হোটেলে খেতেন, তাঁর নির্দিষ্ট কোনও ঠিকানা ছিল না,খিদের সময় পথের ধারে যেটি চোখে পড়ত সেখানেই বসতেন৷ হাতে তিনটি টাকা থাকলে লাভপুর যেতেন৷ কিছু লিখে দশটা টাকা জোগাড় হলেই কলকাতায় ফিরে আসতেন৷ বিভিন্ন-পত্রিকা সম্পাদকের কাছে নিজের লেখা গল্পগুলো দিয়ে করুণ আবেদন, যেন ওই গল্পগুলো প্রতিমাসে প্রকাশিত হয় তাহলে তিনি কিছু টাকা পাবেন,কারণ চুড়ান্ত আর্থিক অনটন৷
১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছ'মাস জেল খেটে কথা সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে বলেছিলেন 'সাহিত্যে সেবার পথেই দেশের সেবা'৷ নিজের প্রথম উপন্যাস 'চৈতালী ঘূর্ণি' নিজের খরচে ছাপিয়েছিলেন শুধু তাই নয়,বইগুলি বিক্রির জন্য যে দোকানে রেখেছিলেন সেই দোকানের কর্মচারী বলেছিলেন 'বইগুলো নিয়ে যান আপনি৷ ঝাঁকামুটে ডেকে আনুন,বিক্রি হয় না৷ ও দিয়ে জায়গা জুড়ে রাখতে পারব না আমরা'৷ সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে তারাশঙ্কর কে সহ্য করতে হয়েছে অনেক অবহেলা,অবজ্ঞা,এই ঘটনা তার এক উদাহরণ।
একদিন হঠাৎ দেখা হয়েছিল শিল্পী যামিনী রায়ের সঙ্গে,তিনি তারাশঙ্কর কে অনুপ্রাণিত করে বলেছিলেন কেন দেশে? কলকাতায় চলে আসুন৷ তারাশঙ্কর কলকাতায় এসে আত্মীয়ের বাড়ি উঠেছিলেন,তবে সেখানে আত্মসম্মান নিয়ে বেশিদিন কী করে থাকা যায়! অশ্বিনী দত্ত রোড,মহানির্বাণ রোড ও মনোহরপুকুর রোডের সংযোগস্থলে একটি টিনের ঘর ভাড়া করলেন৷ গাঁয়ের জমিদার সেদিন হয়েছিলেন মহানগরীর একটি টিনে ছাওয়া বাড়ির পাঁচ টাকার ভাড়াটে৷
তারাশঙ্করের বউবাজারের মেস ছিল ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের মেস৷ এই মেস প্রবাসে বিচিত্র সব মানুষের সঙ্গে পরিচয় কিংবদন্তি কথা সাহিত্যিকের শিল্পিমানসকে বিপুল সমৃদ্ধ করেছে৷ ১৩৪৪সালের বসন্ত কালে বউবাজারের বিচিত্র অভিজ্ঞতার মেস থেকে চলে এলেন হ্যারিসন রোডের 'শান্তিভবন'বোডিংয়ে৷ ততদিনে তাঁর মুদ্রিত গল্পের সংখ্যা পঁচাত্তর,প্রকাশিত গ্রন্থ ।
© ধ্রুবতারাদের খোঁজে
'গনদেবতা' ,হাঁসুলবাঁকের উপকথা', সহ অনেক উপন্যাসের স্রষ্টা তারাশঙ্কর ' বেদেনী', ' অগ্ৰদানী', 'নাগিনকন্যা' প্রভৃতি অমর ছোটগল্পের অমর স্রষ্টা। অনেকগুলো নাটক তিনি লিখেছিলেন। ' আরোগ্য নিকেতন ' উপন্যাসের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার ও সাহিত্য অ্যাকাডেমি পেয়েছেন। ১৯৬৭ সালে পেলেন 'জ্ঞানপীঠ'। তাঁর অনেক রচনা বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। পেয়েছেন পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ সম্মান। তবু মনে হয় যদি আরও কয়েকটি বছর তিনি বেঁচে থাকতেন। অন্তত ১৯৭১ এর ১৪ সেপ্টেম্বর যদি তাঁর মৃত্যু না হত বাঙালি অন্তত জানতে পারত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে আরও একজন বাঙালি সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কার পেলেন কিনা। বলা বাহুল্য নোবেল পুরস্কারের ওয়েবসাইট থেকে জানা যাচ্ছে, তারাশংকরের নাম প্রস্তাব করেছিলেন সাহিত্য অ্যাকাডেমির তৎকালীন সম্পাদক কৃষ্ণ কৃপালনি। ওই ওয়েবসাইট থেকে আরও জানা যায় তারাশংকর ও নেরুদা ছাড়া সেবার সাহিত্যের নোবেলের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন গুন্টার গ্রাস, বোর্হেস, আর্থার মিলারের মতো সাহিত্যিকরা।
Comments
Post a Comment