রবীন্দ্রনাথ ও নন্দলাল বসু
জোড়াসাঁকো, ১৯০৬।
‘‘না হে, তোমার দ্বারা আঁকাজোকা হবে না! তুমি বরং...’’
ধমক খেয়ে কালোপানা ছেলেটির চারপাশে যেন আঁধার নেমে এল। মুখ নিচু। মাটির দিকে চোখ।
ছবির কিছুই হয়নি!
ছেলেটি আকাশপাতাল ভাবছে। ভেবেই চলেছে। সব ভুল?
রঙের মেদুরতা-রেখার বাঁক, উত্তর কলকাতার এ দোকান- সে দোকান ঘুরে ঘুরে সচিত্র দেশি-বিদেশি পত্রিকার পাতায় রাফায়েল, বিলাসী রেমব্রান্টের মতো ধ্রুপদী চিত্রকরদের ছবি দেখা... সব, সব বৃথা? হবে না! কলকাতা শিল্প বিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে হেভেল সাহেব, অবনঠাকুরের পায়ের কাছে বসে নেওয়া হবে না শিল্পের দীক্ষা?
‘‘কাল বরং একটি সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি এঁকে এনো।’’
শিল্পের পাঠ নিতে আসা লাজুক, স্বল্পবাক ছেলেটিকে ফিরিয়ে দিলেন ঠাকুরবাড়ির অবনঠাকুর!
এই ছেলেটিরই নাম নন্দলাল!
হেভেল সাহেবের প্রণোদনায় ও ভগিনী নিবেদিতার আগ্রহে ১৯০৯-এ তিন বিদেশিনী শিল্পীর সঙ্গে তিনি বেরিয়ে পড়লেন অজন্তার পথে।
অজন্তার ভিত্তিচিত্রের অনুকৃতি করতে। তিন বিদেশিনী চিত্রকরের একজন হলেন হেভেল সাহেবের বন্ধু সি জি হেরিংহোমের স্ত্রী ক্রিশ্চিয়ানা। এ দেশে আসার সময় তিনিই সঙ্গে করে আরও দুই শিল্পী— কুমারী ডরোথি লারচার ও কুমারী লুককে এনেছিলেন।
অজন্তা তখনও এদেশে এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। নন্দলালরা থাকতেন অজন্তার বিজনে। শহর থেকে দূরে। নিভৃত গুহার অন্ধকারে থামের পর থাম, দেওয়ালের পর দেওয়ালে সুডৌল শিল্প ঐশ্বর্য দেখে নির্বাক নন্দলাল।
পাঁচ শিল্পীর অজন্তায় দিন গড়াত গুহা-গহ্বরে, রাত-তাঁবুতে!দেশে ফিরে অজন্তার সেই অনুকৃতির দিনকালের সাতমহলা ঐশ্বর্যের কথা লিখেছিলেন লেডি সি জে হেরিংহোম। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘অজন্তা, ভল্যুম অফ টেক্সট’।
কলকাতায় ফিরে অজন্তায় আঁকা স্কেচের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। একদিন ডেকে পাঠালেন রবীন্দ্রনাথ।
দায়িত্ব দিলেন তাঁর নতুন কবিতার বই ‘চয়নিকা’-র ছবি আঁকার।
কিন্তু সঙ্কোচে-লজ্জায় পড়লেন চিত্রকর। কবিকে বললেন, ‘‘সত্যি কথা কি, আমি আপনার বই পড়িনি বললেই হয়!’’
সঙ্কোচ কাটিয়ে দিলেন কবি।— ‘‘তাতে কী, তুমি পারবে ঠিক।’’
নন্দলাল বসুর জন্ম হয় ১৮৮২সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি । তাঁর পিতার কর্মস্থল অধুনা বিহার রাজ্যের মুঙ্গের জেলার হাবেলী খড়্গপুরে। আদিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার হরিপাল-তারকেশ্বর সন্নিকটস্থ জেজুর গ্রাম৷১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত হরিপুরা সম্মেলনে তিনি লোকচিত্রের ধারাবাহী ৮৩টি পট প্রদর্শন করেন যা হরিপুরা পট নামে খ্যাত। ১৯৪৩ সালে তিনি বরোদার মহারাজের কীর্তিমন্দির অলঙ্কৃত করার দায়িত্ব লাভ করেন। এই কীর্তিমন্দিরের চারিদিকের এবং শ্রীনিকেতন ও শান্তিনিকেতনের দেয়ালচিত্র নন্দলাল বসুকে খ্যাতিমান করে তুলে। ভারতীয় সংবিধানের সচিত্র সংস্করণও নন্দলাল বসু অলংকৃত করেন। তার আঁকা ছোট ছোট ছবিগুলোতেও তার প্রতিভার এবং স্বাতন্ত্রের পরিচয় মেলে। শেষ জীবনে নন্দলাল বসু তুলি-কালি এবং ছাপচিত্রের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হন এবং এক্ষেত্রে সাফল্যের পরিচয় দেন। রবীন্দ্রনাথের সহজপাঠের ছবিগুলিও তার আঁকা। তার বিখ্যাত চিত্রগুলির মধ্যে অন্নপূর্ণা, সতী, দার্জিলিং প্রভৃতি উল্লেখ্য।
১৯৫২ সালে বিশ্বভারতী তাকে দেশিকোত্তম উপাধিতে ভূষিত হন।
১৯৫৪ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মবিভূষণ উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯৫৬ সালে ললিত কলা একাডেমির দ্বিতীয় ফেলো নির্বাচিত হনI
জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা 🙏🏻
Comments
Post a Comment