দাদাঠাকুর
আজকের দিনে তিনি পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন আজকের দিনে তিনি প্রয়াত হয়েছিলেন। অনেকেই বলেন শিরদাঁড়া সোজা বাঙালির তালিকায় দাদাঠাকুর চিরকাল থাকবেন। দৃপ্ত মানুষ, নিজের বিশ্বাসের প্রতি অটুট বিশ্বাস নিয়ে চিরকাল বেঁচে ছিলেন।
যে বিয়েতে পাত্রপক্ষ বরপণ গ্রহণ করত সে বিয়েতে দাদাঠাকুর নিমন্ত্রণ পেলেও জলগ্রহণ করতেন না৷এই বিয়ের তিনি নাম দিয়েছিলেন 'বেটা বেচা বিয়ে'।
৬ আগস্ট ১৯৬১ তখন তাঁর বয়স আশী অতিক্রান্ত, সেদিন সকাল থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কাটিয়েছিলেন ঘনিষ্ট সাহিত্যিক,সম্পাদকের বাড়ি। বলেছিলেন এখনও আট -নয় মাইল হাঁটতে পারেন। চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য তিনি আজও বাঙালির শ্রদ্ধার পাত্র। এমন দৃঢ়তা আর জেদ বাঙালি চরিত্রে দুর্লভ। কঠোরতা ও কোমলতা দুদিকেই দাদাঠাকুর ছিলেন চরমপন্থী। কখনও কারও অনুগ্ৰহ ভিক্ষা করেন নি,দারিদ্র্য তাঁকে পরাভূত করতে পারে নি,এ এক আশ্চর্য পৌরুষ।
© ধ্রুবতারাদের খোঁজে
পুত্রবধূ করার জন্য দাদাঠাকুরের বিবাহযোগ্যা কন্যা কে দেখতে এসেছেন এক ভদ্রলোক। তাঁর দাবিদাওয়া দেখে শরৎ পণ্ডিত স্তম্ভিত৷ ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলেন 'মশাই ভাগা দেবেন'?
বিস্ফোরিত নেত্রে পাত্রের পিতা দাদা ঠাকুরের মুখের দিকে চেয়ে আছেন৷ বললেন — 'কিসের ভাগা'!
বেরিয়ে এসেছিল তেজস্বী,স্পষ্টবক্তা,রসিক,রসস্রষ্টা মানুষ শরৎ পণ্ডিতের আসল চরিত্র,যিনি কোনওদিন অন্যায় কে সমর্থন করেন নি৷ পাত্রের পিতাকে যা বলেছিলেন বোধহয় সেই ভদ্রলোকের সারাজীবনেও হজম হয় নি কথার সেই চাবুক৷
'দেখুন,আমরা গরীব গেরস্থ লোক,ইলিশ মাছ সস্তা হলে আস্ত একটা কিনি৷ কিন্তু আক্রার দিনে ভাগা কেনা ছাড়া তো উপায় নেই৷ আপনার ছেলের আস্ত দাম আমার সাধ্যাতীত,তাই ভাগার কথা বলেছি....'৷
দাদাঠাকুর অর্থাৎ সর্বজনপ্রিয় শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের নিজের বিয়েতে খরচ হয়েছিল ৪২টাকা৷ তাঁর সহধর্মিণীর নাম প্রভাবতী দেবী৷ পণ্ডিত বংশের অলিখিত নিয়ম ছিল বরপণ নেবেন না,দেবেন না৷ কিন্তু নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে দেখেছেন পাত্রের পিতাদের আসল ঝোঁক ওই দেনাপাওনার দিকে৷
আর একবার হল কি অন্য এক পাত্রের পিতা দাদাঠাকুরের বিবাহযোগ্য কন্যাকে দেখতে এসেছেন৷ মেয়েটি সুশ্রী এবং রীতিমত ফর্সা৷ আক্ষরিক অর্থে পছন্দ হবার মত পাত্রী৷ পাত্রের পিতা মুখে না বললেও বুঝিয়ে দিয়েছেন মেয়ে অপছন্দ হয় নি৷ তবে দাদাঠাকুরের সাথে কথা বলে পাত্রের বাবা যখন বুঝলেন এই ভদ্রলোকের সাথে দেনাপাওনার বিষয়ে মোটেও সুবিধে হবে না, তখন,বিনীত ভাবে তিনি দাদাঠাকুর কে বললেন 'মেয়েটির রং আরো একটু ফর্সা হলে ভালো হত'৷ বিচক্ষণ দাদাঠাকুরের একথার তাৎপর্য বুঝে নিতে একটু বিলম্ব হল হয় নি৷ প্রত্যুত্তরে বলেদিলেন 'বর্নে মিলছে স্বর্ণে মিলছে না,আপনি নিশ্চিন্ত মনে ফিরতে পারেন,আমি ধবল কুষ্ঠ আশ্রমে খবর দিয়ে দেবো,তারা আপনার পছন্দমত ফর্সা মেয়ে পাঠাবে'৷
© ধ্রুবতারাদের খোঁজে
পনপ্রথা একটি ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধি৷ যে বিয়েতে পাত্রপক্ষ বরপণ গ্রহণ করত সে বিয়েতে দাদাঠাকুর নিমন্ত্রণ পেলেও জলগ্রহণ করতেন না৷এই বিয়ের তিনি নাম দিয়েছিলেন 'বেটা বেচা বিয়ে'৷ সমাজ হতে পণপ্রথার মত বর্বর একটি প্রথা দূর করতে বহু কবিতা,গান তিনি 'বিদূষক' ও 'জঙ্গিপুর সংবাদ' পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন৷
আর একটি দৃষ্টান্ত যার তুলনা কোথাও হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। মৃত পুত্র চিতায়। শরৎচন্দ্র প্রশান্ত মূর্তিতে কর্তব্য করে চলেছেন। বেদনার বহিঃপ্রকাশ নেই। এক বন্ধু মনকে অন্যদিকে ফিরিয়ে বেদনার উপশম হবে ভেবে তাঁকে বললেন এখন যদি মুখে মুখে রচনা করে গান করতে পারেন তবে বুঝব আপনার মনের জোর।
শরৎচন্দ্র তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে সেই অভাবিত অনুরোধ পালন করতে লাগলেন:
দুঃখ দিয়ে বুক ভাঙবে তুমি
তাই ভেবেছো ভগবান।
আমি মার খাব তাও কাঁদব না কো
পরাণ খুলে গাইব গান।
অদ্ভুত মনোবলের মানুষ,আর সঙ্গে সোজা মেরুদণ্ড আজও দাদাঠাকুর আছেন বাঙালির শ্রদ্ধায়,ভালবাসায়।
Comments
Post a Comment