সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

😀 যমরাজ ও বাঙালী 
   ( শ্রদ্ধেয় সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়) 

--- নেক্সট ..........
কি হে চিত্রগুপ্ত, লাইনে হৈচৈ কেন ?

--- আজ্ঞে, একজন আত্মহত্যা করে এসে বলছে স্বর্গে যাবে। তাকে কতবার বলেছি আত্মহত্যা মহাপাপ, সাত পুরুষ নরক বাস, শুনছে না।

লঘুটঘুর মধ্যে পড়ে ?

--- না হুজুর। বলছে স্বর্গে না যেতে দিলে আন্দোলন করবে।

--- মাল টা কি বাঙালি ?

--- কি করে বুঝলেন ?

--- আমার কি কম অভিজ্ঞতা ? একমাত্র বাঙালি মরে গিয়েও এই কথাটা ভুলতে পারে না। ওকে ভেতরে আসতে বল।

--- আসুন। নাম কি ?

--- আজ্ঞে তপন ভট্টাচার্য।

--- বাড়ি কোথায় ?

--- মেদিনীপুর।

--- বয়েস কত ?

--- চল্লিশ স্যার।

--- বউ বাচ্চা ?

--- একটা বউ, দুটো বাচ্চা।

--- কি করে মারা গেলে ?

--- আজ্ঞে উত্তমকুমার এ গলা দিলাম।

--- এ আবার কি হেঁয়ালি ?

--- আজ্ঞে মেট্রো স্টেশন এর নাম। আমি ট্রেন এ গলা দিয়েছি।

--- তোমার ওখানে লোকাল ট্রেন ছিল না?

--- না স্যার, আজ আন্দোলনের জন্য বন্ধ ছিল।

--- শিক্ষাগত যোগ্যতা কি?

--- আজ্ঞে বি.এ পাস।

--- এবার বল, মরলি কেন?

--- আজ্ঞে স্যার, ধার দেনা থেকে বাঁচতে। পাওনাদাররা দিনরাত পেছনে ঘুরতো।

--- তুই কাজ করতিস না?

--- করতাম , টুকটাক। একশো দিনের কাজ। তিন মাস কাজ নয় মাস বেকার।

--- টুকটাক কাজে বিয়ে করেছিস? সাহস তো কম নয় তোর !!

--- আজ্ঞে স্যার, বংশবৃদ্ধির জন্য।

--- চাকরি পেলি না ভালো ?
(কিঞ্চিৎ নরম গলায় বললেন যমরাজ)

--- স্যার প্রচুর চেষ্টা করেছি। টেট দিয়েছি, আরো অনেক কিছু। ঘুষ দিতে পারিনি।তার পরে কোনো পার্টি করতাম না, কে চাকরি দেবে বলুন ?
--- কেন? চপ, পকোড়া , চা এইসব কিছু .......

------না লোন পেলাম না ব্যাঙ্ক বলল সব টাকা নাকি নীরবে দেশ থেকে চলে গেছে।
------চিত্রগুপ্ত কালোধন ও নীরব সহ সব ব্যাটাকে ধরে আনতে হবে।

-------তা শুনেছি এখন অনেক কল সেন্টার হয়েছে, চেষ্টা করিস নি ?

--- আজ্ঞে ইংরিজি বলতে পারি না।

--- সেকি রে ? অনেক বাঙালি তো ভালোই ইংরিজি বলে !!

--- আজ্ঞে স্যার আমি সরকারি স্কুল এ পড়েছি।

--- ওহ, আগে বলবি তো। এই জন্য আমি জ্যোতিবাবুকে পুনর্জন্ম দিইনি। আবার কোথায় গিয়ে ভুলভাল কাজ করবে।

--- খুব ভালো করেছেন স্যার।

--- তার পর বল।
(উৎসাহী যমরাজ। কেস স্টাডি লিখে চলেছেন চিত্রগুপ্ত)

--- স্যার, তার পর জুতোর শুকতলা খুইয়ে একাজ সেকাজ করলাম। যেমন ট্রেনে বই বিক্রি। সে কাজও ভালই চলছিল কিন্তু স্যার জুকারবার্গ এসে তারও বারোটা বাজিয়ে দিল।

--- কি ভাবে ? কি ভাবে ?

--- স্যার যতক্ষন সিট এ ততক্ষন ফেসবুক। বই-এর দিকে নজর কোথায় ?

--- শোনো চিত্রগুপ্ত, জুকেরবার্গ এর নামে একটা এডভান্স FIR লেখো। ও ব্যাটাও দায়ী।

--- স্যার, তার পর আমি ভুল করলাম মানে স্যার বিয়ে করলাম। সংসারের খরচও অনেক বেড়ে গেল। বাচ্চাও হলো। আমার মতো তারা যাতে না পস্তায় তাই তাদের ইংরিজি স্কুল এ ভর্তি করলাম। বউ সেলাই এর কাজ করছিল টুক টাক ...চলে যাচ্ছিল, তারপর হঠাৎ.......

--- কি হল? কি হলো?

--- স্যার, বউ এর কঠিন অসুখ ধরা পড়ল। প্রচুর ধার হল বাজারে। প্রায় পঞ্চাশ হাজার। স্যার দুটো বাচ্চা কে নিয়ে প্রায় রাস্তায়।

চোখ মুছে যমরাজ বললেন তারপর ?

--- হাতে কোনো টাকাপয়সা নেই .....বউও কাজ করার মতো সুস্থ নয়। তাই বেকার হয়ে গেলাম প্রায়। ট্রেনে বই বিক্রি থেকে যা আসত তাতে একবেলা খাওয়া হত। সবার কথা ভেবে ট্যাক্সি চালানো শিখলাম। কলকাতায় গেলাম...... কিন্তু পারলাম না, বিহারি টাক্সিওলাদের মতো এত পরিশ্রম করতে পারলাম না। আবার গাঁয়ে ফিরে এলাম। বাবার এক বিঘে জমি ছিল। আবার কিছু টাকা ধার করে ধান চাষ করলাম। কিন্তু কপাল খারাপ, অতি বর্ষণ সব নষ্ট করে দিলো।

যমরাজ : চিত্রগুপ্ত, বরুন কে নোটিশ পাঠাও, শো কজ করো। সারা দিন ওর ফেসবুক করা আমি বার করছি।
তার পর কি হলো?

--- স্যার দুদিন আগে মহাজন এলো আমার বাড়িতে আর আমাকে যা নয় তাই বলল পরিবারের সামনে। লাঠি দিয়ে মারল।

--- মহাজন ?

--- আজ্ঞে স্যার উনি নেতা।

--- কোন দলের ?

--- স্যার ফুলগুলি ও ঘাস।
--- ও......আমার একটা বড়ো ভুল হয়ে গেছিল, আমি মহম্মদ বিন তুঘলককে মেয়েদের শরীর দিয়ে পাঠিয়েছিলাম । ভেবেছিলাম মেয়ে করে পাঠালে হয়তো শুধরে যাবে।

--- হয়নি স্যার। আপনি দয়া করে আর এক্সপেরিমেন্ট করবেন না।
যা বলছিলাম স্যার তার পর আমার খুব অপমানিত লাগল। বামুনের ছেলে, বলে কিনা স্টেশন এ বসে জুতো পালিশ করে খা। যাই হোক, সেটা প্রায় হজম করে এনেছিলাম, তার পর সেই ঘটনা টা ঘটলো।

--- কি ? কি ?
একসঙ্গে বলে উঠলো যমরাজ আর চিত্রগুপ্ত।

--- আমি কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট এ সিকিউরিটি গার্ড এর চাকরির জন্য এসেছিলাম। ফিরবো বলে স্টেশন এ দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ পাড়ার মহাজনের সামনে পড়ে গেলাম। স্টেশন ভর্তি লোকের সামনে চড় থাপ্পড় .....চোর, চোর বলতে লাগল। একজন বলল, পুলিশের হাতে দিন। আমার মাথা আর কাজ করছিল না । হঠাৎ দেখলাম ট্রেন ঢুকছে । মাথা আর ঠিক রাখতে পারলাম না। একটা ঝাঁপ আর সব অন্ধকার।

সব চুপ। যমরাজ বলল, তার পর ?

--- তারপর দেখলাম এখানে এসে গেছি। বুঝলাম আমি মরে গেছি। কিন্তু স্যার বলুন আমি নরকে কেন যাবো?
আমার গল্পে কি কোথাও মনে হল আমি আমার মরে যাওয়ার জন্য দায়ী?

যমরাজ গম্ভীর হয়ে বললো সবই তো বুঝলাম কিন্তু এখানকার সংবিধানে সেই বন্দোবস্ত নেই। নতুন বিল আনতে হবে। তার জন্য সময় লাগবে । তবে তুই একা নোস, তোর মতো কেস এখন খুব বেশি আসছে।

চিত্রগুপ্ত বলল, স্যার কেন ওনাকে আশা দিচ্ছেন?
তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর ভোট করতে কি কম সময় লাগবে?

এই শুনে তপন বাবু জ্ঞান হারালেন। জল ছিটিয়ে সুস্থ করার পর যমরাজ প্রশ্ন করলেন, কি হলো আপনার?

--- স্যার এখানেও ভোট হয় ? স্যার বুথ দখল, nomination করতে না দেয়া, ছাপপা এ সবও আছে নাকি..
চিত্রগুপ্ত - তা আছে বৈকি

....আমি বরং নরকেই যাই।

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ