রবীন্দ্রনাথ

আজ সকালে  জাহাজের ছাদের উপর রেলিঙ ধরিয়া দাঁড়াইয়াছিলাম ।  আকাশের পান্ডুর নীল ও সমুদ্রের নিবিড় নীলিমার মাঝখান দিয়া   পশ্চিম দিগন্ত হইতে মৃদুশীতল বাতাস আসিতেছিল ।  আমার ললাট মাধুর্যে অভিষিক্ত হইল ।  আমার মন বলিতে লাগিল,  "এই তো  তাঁহার প্রসাদসুধার প্রবাহ ।”
 
        সকল সময়  মন এমন করিয়া বলে না ।  অনেক সময় বাহিরের সৌন্দর্যকে  আমরা বাহিরে দেখি —- তাহাতে চোখ জুড়ায়,  কিন্তু  তাহাকে অন্তরে গ্রহণ করি না ।  ঠিক যেন অমৃতফলকে আঘ্রাণ করি,  তাহার স্বাদ লই না ।
 
        কিন্তু  সৌন্দর্য  যেদিন  অন্তররাত্মাকে প্রত্যক্ষ স্পর্শ করে  সেই দিন  তাহার মধ্য হইতে  অসীম একেবারে উদ্ভাসিত হইয়া উঠে ।  তখনি  সমস্ত মন  এক  মূহূর্তে গান গাহিয়া উঠে,  " নহে, নহে,  এ  শুধু বর্ণ নহে,  গন্ধ নহে —- এই  তো অমৃত,  এই  তাঁহার  বিশ্বব্যাপী প্রসাদের ধারা ।”

        আকাশ ও সমুদ্রের মাঝখানে  প্রভাতের আলোকে  এই-যে অনির্বচনীয় মাধুর্য স্তরে স্তরে  দিকে দিকে  বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে,  ইহা আছে কোন্‌খানে ?  ইহা  কি জলে  ইহা  কি বাতাসে ?  এই  ধারণার অতীতকে  কে  ধারণ করিতে পারে ।
 
        ইহাই  আনন্দ,  ইহাই  প্রসাদ ।  ইহাই  দেশে দেশে, কালে কালে,  অগণ্য প্রাণীর  প্রাণ জুড়াইয়া দিতেছে, মন হরণ করিতেছে —- ইহা  আর  কিছুতেই ফুরাইল না ।  ইহারই অমৃতস্পর্শে  কত কবি  কবিতা লিখিল,  কত শিল্পী  শিল্প রচনা করিল,  কত  জননীর হৃদয় স্নেহে গলিল,  কত  প্রেমিকের চিত্ত প্রেমে  ব্যাকুল হইয়া উঠিল —- সীমার বক্ষ  রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভেদ করিয়া  এই অসীমের অমৃত-ফোয়ারা  কত লীলাতেই  যে লোকে লোকে  উৎসারিত  প্রবাহিত হইয়া চলিল  তাহার আর অন্ত দেখি না —- অন্ত  দেখি না ।  তাহা  আশ্চর্য, পরমাশ্চর্য ।

         ইহার  আনন্দরূপমমৃতম্ ‌।  রূপ  এখানে শেষ কথা নহে,  মৃত্যু  এখানে শেষ অর্থ নহে ।  এই-যে  রূপের মধ্য দিয়া আনন্দ,  মৃত্যুর মধ্য দিয়া অমৃত ।  শুধুই রূপের মধ্যে আসিয়া  মন ঠেকিল,  মৃত্যুর মধ্যে আসিয়া  চিন্তা ফুরাইল,  তবে  জগতে জন্মগ্রহণ করিয়া  কী পাইলাম !  বস্তুকে দেখিলাম  সত্যকে দেখিলাম না !
 
        আমার কি  কেবলই চোখ আছে,  কান আছে ।  আমার মধ্যে  কি সত্য নাই,  আনন্দ নাই ।  সেই  আমার সত্য দিয়া  আনন্দ দিয়া  যখন  পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে  জগতের দিকে চাহিয়া দেখি  তখনি  দেখিতে পাই,  সম্মুখে  আমার  এই তরঙ্গিত  সমুদ্র —- এই  প্রাবাহিত বায়ু —- এই  প্রসারিত আলোক —- বস্তু নহে,  ইহা  সমস্তই আনন্দ,  সমস্তই লীলা,  ইহার  সমস্ত  অর্থ  একমাত্র  তাঁহারই  মধ্যে আছে ;  তিনি  এ  কী  দেখাইতেছেন,  কী  বলিতেছেন,  আমি  তাহার  কী-ই বা জানি ! 

        এই  আকশপ্লাবী আনন্দের  সহস্রলক্ষ ধারা  যেখানে  এক মহাস্রোতে মিলিয়া  আবার  তাঁহারই  এই হৃদয়ের মধ্যে ফিরিয়া যাইতেছে  সেইখানে  মূহূর্তকালের জন্য দাঁড়াইতে পারিলে  এই সমস্ত-কিছুর  মহৎ অর্থ,  ইহার  পরম পরিণামটিকে দেখিতে পাইতাম ।  এই-যে  অচিন্তনীয় শক্তি,  এই-যে  অবর্ণনীয় সৌন্দর্য,  এই-যে  অপরিসীম সত্য,  এই-যে  অপরিমেয় আনন্দ,  ইহাকে  যদি কেবল মাটি  এবং  জল বলিয়া জানিয়া গেলাম  তবে  সে  কী  ভয়ানক ব্যর্থতা,  কী  মহতী বিনষ্টি । 

        নহে  নহে,  এই তো  তাঁহার প্রসাদ,  এই  তো  তাঁহার প্রকাশ,  এই  তো  আমাকে  স্পর্শ করিতেছে,  আমাকে  বেষ্টন করিতেছে,  আমার  চৈতন্যের তারে তারে  সুর বাজাইতেছে,  আমাকে  বাঁচাইতেছে,  আমাকে  জাগাইতেছে,  আমার মনকে  বিশ্বের নানা দিক দিয়া  ডাক দিতেছে,  আমাকে পলে পলে  যুগযুগান্তরে  পরিপূর্ণ করিতেছে ;  শেষ নাই,  কোথাও  শেষ নাই,  কেবলই  আরও  আরও  আরও ;  তবু  সেই  এক,  কেবলই  এক,  সেই  আনন্দময়  অমৃতময় এক !  সেই  অতল  অকূল  অখণ্ড  নিস্তব্ধ  নিঃশব্দ  সুগম্ভীর  এক —- কিন্তু,  কত  তাহার ঢেউ,  কত  তাহার  কলসংগীত !

 
                                 প্রাণ ভরিয়ে,  তৃষা হরিয়ে
                মোরে     আরো  আরো  আরো  দাও  প্রাণ !
                                 তব ভুবনে,  তব ভবনে
                মোরে      আরো আরো আরো দাও স্থান!
                                     আরো আলো  আরো আলো
                      মোর         নয়নে, প্রভু, ঢালো !
                                      সুরে সুরে বাঁশি পূরে
                তুমি       আরো আরো  আরো দাও তান ! 
                                     আরো বেদনা,  আরো বেদনা,
                     মোরে        আরো আরো  দাও চেতনা !
                                     দ্বার ছুটায়ে,  বাধা টুটায়ে
                মোর      করো ত্রাণ,  মোরে করো ত্রাণ !
                                     আরো প্রেমে,  আরো প্রেমে
                     মোর         আমি ডুবে যাক নেমে !
                                     সুধাধারে আপনারে
                তুমি     আরো আরো করো দান ।

লোহিত সমুদ্র
২২ জ্যৈষ্ঠ  ১৩১৯
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 আনন্দরূপ ( প্রবন্ধ )
( আনন্দরূপ < পথের সঞ্চয় < প্রবন্ধ < রবীন্দ্র-রচনাসমগ্র )

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ