রবীন্দ্রনাথ

১৯৩৯ সাল। ‘তাসের দেশ’ পুনরাভিনয়ের প্রস্তুতি চলছে। রবীন্দ্রনাথ তখন ‘কোনার্ক’ বাড়িতে থাকেন। সারা দুপুর কয়েকটি গানে সুর দিয়ে, ভৃত্যকে পাঠালেন তাঁর এক ছাত্রের কাছে। ছাত্রটি তখন ছাত্রছাত্রীদের গান শেখাচ্ছিল ক্লাসে। ভৃত্যটিকে দিয়ে সে গুরুদেবকে বলে পাঠাল, “আমি ক্লাস শেষ করেই যাচ্ছি। একটু দেরি হবে।”
গুরুদেবের কাছে ছাত্রটির যেতে প্রায় আধ ঘণ্টা দেরি হয়। গিয়ে সে দেখে, যে ঘরে বসে লিখতেন, সেখানেই লেখার টেবিলের উপরে গানের খাতা খুলে রেখে চুপ করে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ। মুখ গম্ভীর। কিছুই বলছেন না, তাকাচ্ছেনও না ছাত্রটির দিকে। কিছুক্ষণ পর গানের খাতাটি দিয়ে কবি তাঁকে পাশের মোড়াটিতে বসতে বললেন। বিরক্ত যে তিনি হয়েছেন সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কারণ জিজ্ঞেস করতেও ছেলেটির সাহস হচ্ছে না। মোড়ায় বসে সে গুরুদেবের কাছ থেকে একটি কলম ও কয়েকটি কাগজ চেয়ে নিয়ে যখন নতুন গান ক’টি কপি করে নিচ্ছে, তখন কবি গম্ভীর কণ্ঠে অনুযোগ জানালেন, সারা দুপুর নতুন সুর দেওয়া গানগুলি মনে রাখার জন্য গেয়ে গেয়ে ক্লান্ত তিনি। ছেলেটিকে খবর দেওয়া সত্ত্বেও সে এল দেরি করে! ক্লাস থাকলেও কেন সে তা বন্ধ করে আসেনি— তাই গুরুদেবের রাগ হয়েছে ছাত্রটির প্রতি। “সত্যি আমার অন্যায় হয়েছে!” বলে ছাত্রটি গুরুদেবের কাছে সব ক’টি গান শিখে নিয়ে গাইতে শুরু করল। তখন রবীন্দ্রনাথ খুব খুশি। ভৃত্যকে ডেকে ছাত্রটিকে ভাল করে খাইয়ে দিতে বললেন। খেতে খেতে নানা কথা হল দু’জনের মধ্যে।
দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রমা করের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ হাতে লেখা যাবতীয় নতুন গানের কপি যাঁর হাতে প্রথমে ধরিয়ে দিতেন, এ ছাত্রটিই সেই শান্তিদেব ঘোষ | জন্মের পর বাবা কালীমোহন ছেলের নাম রেখেছিলেন শান্তিময়। কালীমোহনের সঙ্গে তখন শান্তিনিকেতনের বেশ আত্মিক সম্পর্ক। জানা যায় শান্তিনিকেতনের পরিবেশই এমন নাম রাখার কারণ। ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি নিজের হাতে লেখা নৃত্য-গীত-আবৃত্তির একটি অনুষ্ঠানের কর্মসূচিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর শান্তিদেব নামকরণ করেন। কবি বলেছিলেন এটিই ভাল, এটিই থাকুক। তার পর থেকে শান্তিময় নামটি ধীরে ধীরে মুছে গিয়ে শান্তিদেব হয়ে যায়।
ম্যাট্রিকুলেশনের গণ্ডি পার না হলেও প্রবল ইচ্ছেশক্তির জোরে শান্তিদেব ভারতীয় নাট্যশাস্ত্র, নৃত্যশাস্ত্র ও সঙ্গীতশাস্ত্রে পারদর্শী হওয়ার পাশাপাশি নিজের চেষ্টায় সংস্কৃত, মালয়লম ও ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। নির্ভরযোগ্য স্বরলিপিকার, সঙ্গীত-শিক্ষক ও অসামান্য গায়ক শান্তিদেব সুরকার হিসেবেও দক্ষ ছিলেন। নৃত্য উপস্থাপনার ক্ষেত্রে কখনও কথাকলির সঙ্গে মণিপুরি, কখনও বা ডান্ডিয়া বা জারি নাচ একত্রিত করেছিলেন তিনি।
শান্তিদেব ঘোষের প্রথম রেকর্ডিং হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল পার্টির হয়ে ‘জনগণমন’ ও ‘যদি তোর ডাক শুনে’। পরে সেনোলায় রেবা মজুমদারের সঙ্গে ‘আমার প্রাণের মানুষ’ ও ‘বাকি আমি রাখব না’। রবীন্দ্রপ্রয়াণের পরে এইচ এম ভি থেকে তাঁর ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ ও ‘বসন্তে কি শুধু’-সহ বহু গান বিখ্যাত হয়ে আছে বাঙালি মনে।
রেকর্ডের পাশাপাশি তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়— রবীন্দ্রসঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত বিচিত্রা, জাভা ও বালির নৃত্যগীত, রূপকার নন্দলাল, ভারতীয় গ্রামীণ সংস্কৃতি, রবীন্দ্রনাথের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাদর্শে সঙ্গীত, নৃত্য ও অভিনয়ের স্থান, মিউজিক অ্যান্ড ডান্স ইন রবীন্দ্রনাথ টেগোর’স এডুকেশনাল ফিলজফি, জীবনের ধ্রুবতারা।
পদ্মভূষণে সম্মানিত, ললিতকলার অ্যাকাডেমির ফেলো, প্রবন্ধ সাহিত্যে আনন্দ পুরস্কারপ্রাপ্ত শান্তিদেব কবিগুরুর স্নেহধন্য ছিলেন। রাশিয়ার পদক, বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম, বর্ধমান ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আলাউদ্দীন পুরস্কার, টেগোর রিসার্চ সোসাইটির ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ সম্মানে সম্মানিত হয়েছিলেন শান্তিদেব ঘোষ।
বার্ধক্যজনিত কারণে শান্তিদেব ঘোষের মৃত্যু হয় ১ ডিসেম্বর ১৯৯৯ কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে। স্ত্রী ইলা দেবীর ইচ্ছানুযায়ী শান্তিনিকেতনে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় তাঁর।
প্রয়াণদিবসে শ্রদ্ধার্ঘ্য |

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ