আমার রবি

মাত্র আঠারো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গেল আমার।
ফুলশয্যার খাটে বত্রিশ বছরের স্বামী বলল,
দেখো, 'তোমার বাবা গরিব,তাই উদ্ধার করেছি
কেবল, মনে আমার অন্য সোহাগ।
থাকবে, খাবে, দাবে... শাড়ি গয়না সব পাবে কিন্তু,
আমাকে চেও না কখনো।'
বিবাহের নানা নিয়ম কানুনে ক্লান্ত আমার চোখে
নেমে এল ঘুম।

আমার স্বামী ভীষণ বড় ব্যবসায়ী, আমার ঘরের
সঙ্গে লাগোয়া ঘরেই রাত্রিবাস করেন।
আমি ঠাকুর-শাশুড়ির বেঁধে দেওয়া খোঁপায়
ফুল লাগিয়ে বিছানায় বসে থাকি একা।

দিন দশেক পরে আমি তোমাকে পেলাম হঠাৎ জানো।
আমার ছোট দেওর এসে আমার হাতে গীতবিতান
দিয়ে বললো, 'বৌদি নাও। এ তোমার উপহার!'
আমি হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে ঘরে নিয়ে এলাম।
তারপর তুমি আমার হলে।
যুবতীর প্রেম হলে।
প্রত্যেক বিকেলে দেওর পাঠ করে শোনাতো তোমায়।
আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। 
বৈশাখে বৃষ্টি আসতো।
আমার সমবয়সী দেওর ওর দুহাত দিয়ে আড়াল করতো
আমায়।
তারপর সকালে তোমার গান দিয়ে ধুইয়ে দিত
আমার দু চোখ।
আমি একদিন ওকে জড়িয়ে ধরি আমার অবশ মূর্ছনায়।
ও আমায় ওর খোলা বুকে আশ্রয় দেয় সেই প্রথম।
ঠোঁটে ভিজিয়ে দেয় তোমার কবিতা, তোমার গান, তোমার প্রেম, প্রকৃতি, পূজা।
আমি আমার দেওরের নতুন বৌঠান হয়ে উঠলাম কখন যেন।

আমার স্বামীর ব্যস্ততা বাড়তে বাড়তে আমার সঙ্গে
দেখা সাক্ষাতও কম হয়ে গেল।
শাশুড়ি ঠাকুর-শাশুড়ি আমাকে গঞ্জনা দিতে শুরু করলো।
দেওরের অন্যত্র বিবাহ পাকা হয়ে গেল কয়েক মাসের
মধ্যেই।

একলা ছাদের বৃষ্টি মাখতে মাখতে যখন কান্না বুনতে
ব্যস্ত আমি ভীষণ,
আমার দেওর এসে আমার দু চোখ চেপে তোমাকে
শোনালো শেষবারের মত-
'মতিয়া যখন উঠেছে পরান
কিসের আঁধার, কিসের পাষান!'
আমি অভিমানে মুখ লুকিয়ে ফেলি ওর বিপরীতে।
সেই খোলা বুক, ভিজে ঠোঁট, উদাত্ত কণ্ঠের আবৃত্তি
মিলিয়ে গেল প্রচন্ড বজ্রপাতের শব্দে।

আমার প্রিয় বন্ধু আমার রবি দেওরের বিয়ে হয়ে গেল
ধুমধাম করে।
আমার উপর ভার পড়লো নতুন বউকে ফুলশয্যার সাজে
প্রস্তুত করার জন্য।

আমি তোমাকে সেই গীতবিতান থেকে আঁকড়ে
ধরেছিলাম কবি।
তোমার সোনার তরী তে ডুবেছি একলা দুপুর,
তোমার বলাকা ভাসিয়েছে বিকেল-অভিমান,
তোমার সঞ্চয়িতা মুখের উপর চেপে ঘুমিয়েছি রাতে।
আমার খোপার ফুল লুটিয়েছে বালিশের আনন্দে,
ঠাকুর-শাশুড়ি ভেবেছে আচারের বন্দোবস্ত করার কথা।

আমার দেওর আমার সামনে দিয়ে সুসজ্জিত বউকে
নিয়ে গেল ঘরে, হাতে তুলে দেবে গীতবিতান,
বুকে পূর্ন আদর।
আমার খোঁপার চারিদিকে গজিয়ে উঠবে বিষাদ।
আমার ঠোঁটে দেওরের এঁকে দেওয়া রবীন্দ্রনাথ
নেমে যাবে ধুলোয়, খুঁজবে আফিম।
কবি, আমি তোমার নতুন বৌঠান হয়ে গেলাম
তোমায় বুকে নিয়ে!
ডাক্তার দেওরের ঘর থেকেই জোগাড় করে রেখেছিলাম
ঘুমের ওষুধ গুলো।
ওদের ফুলশয্যার পরিতৃপ্ত মুখ দেখে
তবেই না মৃত্যু সহজ হবে আমার!
অপেক্ষা করছি ভোর রাতের,
ঝমঝম করে বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে জানলার ওপার।

হঠাৎ আমার ঘরের লাগোয়া ঘরের দরজা খুলে গেল।
আমার ব্যবসায়ী বর বেরিয়ে এসে আমার খাটের
কোণে বসলো অপরাধীর মুখ নিয়ে,
তারপর ফিসফিস করে বললো, 'মাপ করো।'
জড়িয়ে ধরলো আমার শরীর, শূন্য মন।
ঘুমের ওষুধ গলে গেল তোমার গানে…
আমার গা দিয়ে নেমে আসছে অনুতপ্ত বরের আদর
আর দেওরের ঘর থেকে বয়ে আসছে তোমার গান,
'এমন দিনে তারে বলা যায়…'

আমার আর নতুন বৌঠান হওয়া হলো না।
সস্ত্রীক দেওর বিদেশ চলে গেল।
আমার বর সোহাগ-যাপনে আমার কালো মুখখানা
আদর করে তুলে ধরে গাইলো…
কৃষ্ণকলি আমি তারই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক
…   …  ...
কবি, তোমাকে

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ