নজরুল

কাজী নজরুল ইসলামের স্কুলের শিক্ষক ছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন, একদিন নজরুল হঠাৎ করে জানতে পারলেন কুমুদরঞ্জন তাঁকে দেখতে এসেছেন, ফুটপাতে অপেক্ষা করছেন। শুনেই খালি পায়ে নজরুল ছুটলেন তাঁর শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করতে, প্রথমে কুমুদরঞ্জেনের পায়ের ধুলো নিলেন,তারপর তাঁকে সসম্মানে সঙ্গে করে দোতলায় নিয়ে এলেন। অনেকে আলাপ গল্প হল শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে।কথায় কথায় নজরুল, কুমুদরঞ্জন কে বলে বসলেন 'স্যার আমিও আপনার মত পাগল '। নজরুলের মুখে একথা শুনে মুজজফর আহমেদ হতবাক, কিন্তু তিনি দেখলেন সেকথা শুনে কুমুদরঞ্জনের চোখে মুখে নজরুলের প্রতি স্নেহ ঝরে পড়ছে।

কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক পিতার প্রস্তাবে সম্মত হন নি। তাঁর অর্থাভাব থাকলেও গ্ৰামের প্রতি ভালবাসা কোনওদিন কমেনি,কুমুদরঞ্জনের পিতা পূর্ণচন্দ্র, ছেলেকে লিখেছিলেন -তুমি মাথরুণ স্কুলের হেডমাস্টার,৮০টাকা বেতন পাও। কাশ্মীরে ইংরেজি ও ইতিহাসের অধ্যাপনা করার সুযোগ আছে। রাজি থাকলে সে জননী কে সঙ্গে নিয়ে সেখানে চলে আসুক।
আজন্ম লালিত গ্ৰামের প্রতি ভালবাসায় কোনওদিন কমেনি,তাই হয়ত তিনি লিখতে পেরেছেন- 'আমি নর্মদা মর্মরতটে বাঁধিতে চাহি না ঘর,
উচ্চপ্রসাদ অলিন্দে হেরি 'ভীত মোর মধুকর'।

 কুমুদরঞ্জন যখন শিক্ষক হিসেবে স্কুলে যোগ দেন তখন বয়সে বেশ ছোট,এই প্রসঙ্গে রসিকতা করে লিখেছেন' একে আমার বয়স কম,তাহাতে আবার বালকের মত বলিয়া লোকে প্রথমে বলাবলি করত মহারাজা এক কালদমনের বালককে হেডমাস্টার করেছেন '। কুমুদরঞ্জনের ছাত্রদের অনেকেই স্মৃতিচারণায় লিখেছেন তিনি শুধু প্রধান শিক্ষক ছিলেন না, তিনি তাদের পরম স্নেহময় পিতৃতুল্য অভিভাবকও ছিলেন। 

কবি হিসেবে কুমুদরঞ্জন রবীন্দ্রনুসারী, তাঁর কাছে কবিতা রচনা ও পূজার্চনা সমার্থক। বলতেন 'আমার মধ্যে যে কবিতার ফুল ফোটে,তাই দিয়েই আমি তাঁর পুজো করি।সব ফুল সুন্দর নয়,সব ফুল সুগন্ধি নয় তবু সে তো ফুল '।
সেই কারণে কুমুদরঞ্জন লিখতে পারেন - 'গ্ৰাম ছেড়ে কি থাকতে পারি? আমার এ গ্ৰাম ভুলতে নারি
আমার মুখে স্তন্য দিল-এ গ্ৰাম তাহার বুক নিঙাড়ি।
থাকবো গ্ৰামের সবার মাঝে
লাগবো সবার কাজে'।
অথবা-
'অজয় পারে ওই যে ভাঙ্গা দেয়াল আছে পড়ি,
শিউলি এবং শ্যামলতাতে করছে জড়াজড়ি-
বছর বিশেক আগে
মনের অনুরাগে
থাকতো হোথায় পল্লী কবি অনেক দিবস ধরি'।
সব কবিতা যেন বলে দেয় কবির নিজস্বতা,গ্ৰাম বাংলা তাঁর কবিতার প্রধান উপাদান।
এর সঙ্গে তাঁর কবিতায় ভিড় করে এসেছেন গ্ৰামের সাধারণ মানুষ।অখিল মাঝি থেকে গোলাম মেটে,রসিক বাগদি,ডানপিটে চারুর মত চরিত্র।

কুমুদরঞ্জন মল্লিকের কবিতায় দেহকামনার উদ্দাম তীব্রতা নেই,কবির প্রেয়সী একান্ত কাছের সব মানুষ।
'ভারতবর্ষ'প্রথম স্ংখ্যায় সচিত্র প্রকাশিত 'মাঝি -তরী হেথা বাঁধব নাকো আজকে 'সাঁজে' কবিতাটি তাঁকে  সেকালে প্রভূত জনপ্রিয়তা এনে দেয় পরে কাজী নজরুলের উদ্যোগে এইচ এম ভি এই গানের রেকর্ড বের করে। রবীন্দ্রনাথ সেই গান শুনে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন 'ওহে তোমার গান যে আমার উপর চাপিয়াছে '। কবিতার মত কুমুদরঞ্জনের গান চিরন্তন বাংলার মাটি জল আকাশ আর দেশের মাটি মানুষের গভীর হৃদস্পন্দন থেকে ঝংকারিত।এই সব কবিতা, গানের আবেদন চিরন্তন। কুমুদরঞ্জন অসংখ্য কবিতা লিখেছেন,প্রায় সব পত্রিকায় লেখা পাঠাতেন প্রতিলিপি ছাড়া। কোহিনুর পেন্সিলে লিখতেন, প্রতিলিপি না রেখে সর্বত্র লেখা পাঠিয়েছিলেন বলে তাঁর অনেক কবিতা কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে। পরিশেষে বলা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিভাবী প্রভাবে থেকেও কুমুদরঞ্জন অনন্য,আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। আজ কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের জন্মদিবসে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।।

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ