অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়

একটি সাদা পাঞ্জাবী, নৌকার মতো একটি চটি পরে দিল্লিতে অ্যাকাডেমি পুরস্কার নিতে উঠছেন এক জন ছিপছিপে রোগাটে ছ’ফুট লম্বা মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুলের মানুষ। তাঁকে পুরস্কার নিতে উঠতে দেখে অনেকেই ভ্রূ কুঁচকেছিলেন। অনেকেরই মনে হয়েছিল চলতি হাওয়ার কাছে তিনি একেবারেই বেমানান। তবু তিনি সব ধরনের আড়ম্বর থেকে বহুদূরবাসী, নিজের সৃষ্টির মধ্যে ডুবে থাকা একজন সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব। তিনি কর্মে নিষ্ঠাবান, ভিতরে ভিতরে প্রবল ভাবপ্রবণ এবং শিশুর মতোই আবেগ সর্বস্ব। তবে তাঁর জেদ এবং নিয়ামানুবর্তিতার কথা লোকের মুখে মুখে ফেরে। জীবনে সিগারেট ছিল এই ব্যক্তিটির সব সময়ের সঙ্গী আর চেতনা ছিল মার্কসীয় তত্ত্বে জারিত। এই মানুষটিই অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।
 ১৯৬৬ সাল। বনফুলের ছোটগল্প অবলম্বনে ডাক্তার অনাদি মুখুজ্জের কাহিনি নিয়ে ছবি করবেন বলে মনস্থির করলেন তপন সিংহ। গল্পের ভিলেন জোতদার ছবিলালের ছেলে লছমনলাল। একে অমন দোর্দণ্ডপ্রতাপ খল চরিত্র, তার উপর অশোককুমার বৈজয়ন্তীমালার মতো তারকার পাশাপাশি দাপিয়ে অভিনয়, সে কি চাট্টিখানি কথা? কোথায় পাবেন এমন অভিনেতা? হঠাৎ করেই পরিচালকের মনে পড়ে গেল সাড়ে ছ’ফুট লম্বা, রোগাটে গড়ন আর মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুলের মানুষটার কথা। গল্প শুনে তো এককথায় রাজি
বাগুইআটির হিন্দু বিদ্যাপীঠ এর শিক্ষক । কিন্তু শ্যুটিংয়ের চাপে দীর্ঘদিন স্কুল আসতে পারবেন না যে। এদিকে ঠিকঠাক ক্লাস না পেলে পাছে ছাত্রদের পড়ার ক্ষতি হয়! সেই আশঙ্কায় সোজা গিয়ে ইস্তফা দিয়ে বসলেন ইস্কুলের চাকরিতে। তারপর তো বাকিটা ইতিহাস। 'হাটে বাজারে'র লছমনলালের ভূমিকায় কাঁপিয়ে দেওয়া সেই অভিনয়-অন্তপ্রাণ মানুষটির নাম অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পুরুলিয়া' র রোপো গ্রামে। বাবা ভুবন মোহন  বন্দ্যোপাধ্যায়, মা লক্ষ্মীরানী বন্দ্যোপাধ্যায়। গরিব পরিবার, বাবা ভূবনমোহন ছিলেন কয়লা খনির শ্রমিক। তাঁর ছেলে যে বড় হয়ে বাংলা থিয়েটারে আলোড়ন ফেলে দেবে তা কে জানত! কুলটি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক দেন অজিতেশ, তারপর বর্ধমান রাজ কলেজ থেকে আই এস সি এবং ইংরেজিতে স্পেশাল অনার্স নিয়ে কলকাতার মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজ থেকে বি এ পাশ করেন। বেশ কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন দমদমের মতিলাল বিদ্যায়তনে এবং পরে বাগুইহাটির হিন্দুবিদ্যাপীঠে।
ছাত্রজীবন থেকে অজিতেশ নাটক রচনা ও অভিনয়ে আগ্রহী। তরুণ বয়সে উপার্জন বলতে কিছু টিউশনি। আর গল্প লিখে একটি পত্রিকা থেকে কিছু রোজগার। সেই প্রবল অর্থকষ্টের মধ্যেও অজিতেশের অভিনয়ের খিদে ছিল আকণ্ঠ। ১৯৫৪ সালে লিখেছেন মৌলিক পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘সংঘাত । ১৯৫৭ সালে ২৩ বছরের তরুণ অজিতেশ যােগ দিলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘে। রাজনৈতিক মতাদর্শের সংঘাত লাগায় বেরিয়েও আসেন গণনাট্য ছেড়ে। তার ঠিক চার বছর পর ১৯৬০ সালের ২৯ জুন প্রতিষ্ঠা পেল নতুন নাটকের দল 'নান্দীকার’ ।এই নাট্যদলের ৩৪ টি নাটকে রূপান্তর, নির্দেশনা এবং অভিনয়সূত্রে যুক্ত ছিলেন অজিতেশ। সেতুবন্ধন', 'সওদাগরের নৌকো', 'মঞ্জরি আমের মঞ্জরি', 'তিন পয়সার পালা', শের আফগান, 'বিতৎস', 'পাপপুণ্য'-এর মতো নাটকের পাশাপাশি ৬৩ টি বাংলা ছবিতে কাজ করেছিলেন অজিতেশ।
আদ্যন্ত কমিউনিস্ট ছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় (Ajitesh Bandyopadhyay)। নাটকের জন্য নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করেছিলেন। নাটক তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল জীবনসংগ্রামের প্রতিরূপ। অভিনয়ের জন্য পেয়েছিলেন সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার সহ একাধিক সম্মাননাও। কিন্তু জীবনের সব থেকে আঘাতগুলোও পেয়েছেন অভিনয়জীবনেই৷ নান্দীকারের ভেঙে যাওয়া, কেয়া চক্রবর্তীর মতো শক্তিশালী প্রতিভার নিদারুণ পরিণতি, ক্ষুদ্র গোষ্ঠী রাজনীতির চাপ - সব মিলিয়ে ভিতরে ভিতরে কোথাও কি ভেঙে পড়েছিলেন অজিতেশ? তবু সারাজীবন আপোষহীনভাবে জড়িয়ে থাকতে চেয়েছেন মঞ্চের সঙ্গে, থিয়েটারের সঙ্গে। মাত্র ৫০ বছর বয়সে জীবনাবসান ঘটলেও, আজও বাংলা নাটকের অন্যতম স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সেই মানুষটি, যাঁর নাম অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় । 


Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

কাঙাল হরিনাথ