শিবরাম
"তখন ইংরেজ আমল। ধরপাকড় চলছে বিপ্লবীদের। বিপ্লবীদের দমন করার জন্য স্পেশাল ব্রাঞ্চ তৈরি হয়েছে। পোস্ট অফিসেও সতর্ক দৃষ্টি গোয়েন্দাদের। সন্দেহজনক চিঠি খুলে গোপনে পড়ে দেখা হয়। জোড়াসাঁকো থানা এলাকার পোস্ট অফিসে যে গোয়েন্দার ডিউটি ছিল, তাঁর নজরে এল এক অদ্ভুত ঘটনা। এই এলাকার মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে একটা মেস আছে। সেই মেসের এক বোর্ডারের নামে প্রতি মাসে মানি অর্ডার আসে। কখনো ২০০, কখনো ৩০০ টাকা। যুবক বোর্ডারটির নাম শিবরাম। সে কিন্তু মানি অর্ডার গ্রহণ না করে প্রতি বার ফেরত দেয়। জানিয়ে দেয় যে তার টাকার দরকার নেই।
টাকার দরকার নেই এমন মানুষ আছে না কি? সন্দেহ হয় গোয়েন্দার। তিনি খোঁজখবর করেন গোপনে। জানতে পারেন, শিবরাম হতদরিদ্র মানুষ। দু-তিন মাস মেসের টাকা বাকি পড়েছে। সকালে খবরের কাগজ বিক্রি করে। পত্রপত্রিকায় লিখে কিছু পায়। ওসবে আর কত আয়, তাই ধার করতে হয়। অবশ্য ফেরেব্বাজ নয়, ধার শোধ করার চেষ্টা করে। উত্তরবঙ্গের মালদার দিকে তার বাড়ি। তার মামার বাড়ি বেশ ধনী। পুলিশের সন্দেহ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য শিবরাম বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। বিপ্লবীদের এরকম দুঃখবিলাসের কথা পুলিশ জানে। জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টাও হতে পারে। যে নিজে খেতে পায় না, সে আবার গরিব-দুঃখীদের দান করে! হতে পারে ছদ্মবেশও, এভাবে পুলিশের চোখে ধুলো দিচ্ছে।
এমনই সময়ে জোড়াসাঁকো থানায় বদলি হয়ে এলেন পঞ্চানন ঘোষাল। ইনিও পত্রপত্রিকায় লেখেন। তাই এক লেখককে দিয়ে আর এক লেখকরূপী বিপ্লবীকে ধরার পরিকল্পনা করলেন প্ুলিশকর্তারা। পঞ্চানন ঘোষালকে ডেকে বললেন, ছদ্মবেশে একজন লেখকের সঙ্গে ভাব জমাতে হবে। লেখক পরিচয় তার বাইরের, আসলে সে এক ভয়ংকর বিপ্লবী। জানতে হবে তার হাল-হকিকত। সফল হলে মিলবে পুরস্কার।
পরদিনই শিবরামের সন্ধান পেয়ে গেলেন ঘোষালমশাই। কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের একটা হোটেলে চেয়ারে বসে আছেন শিবরাম। একা। ঘোষালমশাই উলটো দিকের চেয়ারে বসলেন। শিবরাম তার দিকে ঘুরে হাসিমুখে বললেন, ‘আপনাকে চিনেছি।’
চমকে উঠলেন ঘোষাল। পুলিশ, গোয়েন্দাদের উপর বিপ্লবীদের খুব রাগ। বাগে পেলে আক্রমণে দ্বিধা করে না। ঘোষালমশাই আত্মরক্ষার জন্য পকেটের পিস্তলে হাত দিলেন। শিবরাম হেসে বললেন, ‘ভয় পাবেন না। আমি বাঘ-ভালুক নই। আপনার স্বগোত্র। আপনার মতো আমিও একজন লেখক।’
ঘোষাল বললেন, ‘আপনি কী করে জানলেন আমি লিখি?’
‘সেদিন মৌচাক-এর অফিসে দেখলাম যে আপনাকে!’
সৌজন্যের খাতিরে ঘোষাল বলেন, ‘আপনার লেখা আমি পড়েছি। সুন্দর লেখা।’
শিবরাম হেসে বলেন, ‘ঠিক বলেছেন। আমি সুন্দর লিখি। কিন্তু “সুন্দরী” লিখি না। সেইজন্য ভুগতে হয় অর্থকষ্টে।’
‘চাকরি-বাকরি করেন না?’
‘না মশাই। আমি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। পরের গোলামি আমার নাপসন্দ।’ তারপর একটু থেমে শিবরাম বললেন, ‘আজ আপনি আমার অতিথি। আমরা আজ একসঙ্গে ডিনার খাব।’
খাওয়া-দাওয়ার পর বিল এল। ১১ টাকা। ঘোষালমশাই অবাক। এত টাকা! শিবরাম খোলসা করে বললেন, ‘এটা শুধু আজকের বিল নয়, এর আগে কয়েক দিন ধার-বাকি খেয়েছি। সব মিলিয়ে ১১। আমি আপনাকে খাওয়ালাম, এবার বিল মেটানোর ভার আপনার। আমার কাছে পয়সা থাকলে বিলটা আপনাকে দিতাম না। তবে হ্যাঁ, আগাম একথা বলে দিচ্ছি, পয়সা যেদিন থাকবে সেদিন আপনাকে ধরে এনে খাওয়াব।’
ঘোষালমশাই বুঝলেন, শিবরাম আর যাই হোন, বিপ্লবী নন। তবে আরও নিশ্চিন্ত হওয়া দরকার, নইলে উপরওয়ালাদের বিরাগভাজন হতে হবে। তাই আরও ক-দিন ঘুরলেন শিবরামের পিছনে। হয়তো শিবরাম তা বুঝতে পেরেছিলেন। নিজেই একদিন থানায় এসে হাজির। বললেন, ‘মশাই আপনি যে শুধু লেখক নন, আপনার যে আর একটা পরিচয় আছে সেটা আমি জানতাম। তাই সেদিন হোটেলে ইচ্ছে করেই আপনাকে বিল ধরিয়ে দিয়েছি। বিদেশি ইংরেজদের লুঠ করা টাকা কিছু খরচ হোক না!’
শিবরামের কথা শুনে ঘোষাল স্তম্ভিত। হাসতে হাসতে শিবরাম বলেন, ‘আজ আমার কিছু টাকা সত্যই প্রয়োজন। আপনার নিজের উপার্জিত কিছু টাকা বিনা সুদে ধার দিন আমাকে। এ ক-দিন আপনাদের দৌরাত্ম্যে আমার কিছু লেখা হয়নি। তাই উপার্জন শূন্য। না মশাই, ক্ষতিপূরণ চাইছি না। ধার চাইছি। একজন লেখক আর একজন লেখকের পাশে দাঁড়াবে না!’
থানায় পঞ্চাননবাবুর এক সহকর্মী শিবরামের ব্যাপারটা জানতেন। তিনি বললেন, ‘আপনি তো ইচ্ছে করলে আজই বাড়ি থেকে টাকা আনাতে পারেন। একটা টেলিগ্রাম করলেই হল। আমাদের কাছে ধার চাইছেন কেন? আমরা তো ঘুষ খাই না যে সবসময় পকেট-ভরতি টাকা থাকবে?
শিবরাম বললেন, ‘দেখুন পুলিশ ঘুষ খায় কি না অথবা ছাগলে ঘাস খায় কি না এটা আলোচনার বিষয় নয়। আমি এখানে এসেছি কোনো পুলিশের কাছে নয়, এসেছি আমার এক লেখক-বন্ধুর কাছে। বন্ধুর কাছে সাহায্য চাইতে লজ্জা নেই। টেলিগ্রামের কথা বলছিলেন আপনি। হ্যাঁ, পৈতৃক সম্পত্তি আমাদের আছে। তবে সেটা তো পরোপার্জিত। আমি আমার স্ব-উপার্জিত অর্থে বাঁচতে চাই। আমি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী।’
ঘোষালমশাই এসব কথা বিস্তারিত জানিয়েছিলেন পুলিশকর্তাদের। তারপর বন্ধ হয়েছিল শিবরাম চক্রবর্তীর পশ্চাদ্ধাবন।"
Comments
Post a Comment