মদনমোহন তর্কালঙ্কার

‘মদনমোহন তর্কালঙ্কার ও বাংলা কাব্যসাহিত্য’


“পাথী সব করে রব রাতি পোহাইল।
কাননে কুসুম-কলি সকলি ফুটিল॥
রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে।
শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে॥”

শিশুপাঠ্য, সহজ সরল ও ক্ষুদ্রকায় এই কবিতাটি অতীতে প্রায় দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলার সমস্ত বালকবালিকার কণ্ঠে কণ্ঠে ফিরেছিল; এমনকি বর্তমানেও এই রচনার সঙ্গে অনেকেই হয়ত পরিচিত রয়েছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে যত সংখ্যক মানুষ এই কবিতাটির রচয়িতার নামের সাথে পরিচিত, তার থেকে বেশি সংখ্যক মানুষ আবার এর রচয়িতার নামের সাথে আদৌ পরিচিত নন। অর্থাৎ—রচনা রয়েছে, কিন্তু রচয়িতা বিস্মৃতির মহাপ্রান্তরে হারিয়ে গিয়েছেন। তবে ইতিহাস বলে যে, এমনটা নতুন কিছু নয়। মানুষ বরাবরই প্রতিভাবানদের মনে রাখে, এবং লোকস্মৃতিতে অন্যান্য সব নাম ক্রমশঃ অস্পষ্ট হয়ে যায়। বর্তমান যুগের বাংলায় এধরণের প্রায়-বিস্মৃত একজন ব্যক্তির নাম হল মদনমোহন (চট্টোপাধ্যায়) তর্কালঙ্কার। তিনি তাঁর নিজের জীবদ্দশায় খ্যাতি অর্জন করতে পেরেছিলেন। তাঁর সময়কার বাংলায় তিনি একজন কবি, রসিক, পণ্ডিত, এবং সমাজসংস্কারকরূপে পরিচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর যশোলাভের এই সৌভাগ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কারণ, মদনমোহনের মধ্যে যে প্রতিভা ছিল, সেটা আসলে একজন কর্মীপুরুষের প্রতিভা ছিল। আর একারণেই বাস্তবের কর্মোদ্যম একসময়ে তাঁর সাহিত্যসাধনাকে বিঘ্নিত করেছিল। তাছাড়া এক্ষেত্রে তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার মত সুযোগও পাননি, এর আগেই তিনি অকালে লোকান্তরিত হয়েছিলেন। এই পৃথিবীতে, এই বাংলায় মাত্র একচল্লিশটি বছর তাঁর আয়ু ছিল। তবে এর থেকেও বড় কথা হল যে, তাঁর জীবদ্দশাতেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অসামান্য খাতি স্বক্ষেত্রে তাঁর কীর্তিকে গ্রাস করে নিয়েছিল। অনেকের মতে, বিদ্যাসাগরের সমকালবর্তী না হয়ে তিনি যদি কিছুটা দূরকালবর্তী সময়ের মানুষ হতেন, তাহলে বাঙালি সমাজ হয়ত আজও তাঁকে মনে রাখত। সুতরাং একথা বলা যেতে পারে যে, বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে আপন মহিমায় বিরাজমান থাকবার অধিকার থেকে অদৃষ্টদেবতাই হয়ত মদনমোহনকে বঞ্চিত করেছিলেন। তবে আজও মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে কিছু বাঙালি মাঝে-মধ্যে তাঁর তরুণ বয়সে রচিত দুটি কাব্যের জন্য, তাঁর কয়েকটি সংস্কৃতকাব্যের প্রশংসনীয় সম্পাদনাকর্মের জন্য, আর তাঁর সমাজকল্যাণমূলক কাজগুলির জন্য স্মরণ করে থাকেন।
১৮১৭ সালে নদীয়া জেলায় মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জন্ম হয়েছিল। এরপরে মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, এবং এখানেই তিনি লোকশ্রুত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিজের সহপাঠী ও বন্ধুরূপে পেয়েছিলেন। সংস্কৃত কলেজে তাঁরা দু’জনে একই শ্রেণীতে পড়েছিলেন, এবং একই সময়ে, অর্থাৎ—১৮৪২ সালে তাঁদের উভয়ের ছাত্রজীবন শেষ হয়েছিল। এরপরে মদনমোহন অধ্যাপক জীবনে প্রবেশ করে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ, সংস্কৃত কলেজ, কৃষ্ণনগর কলেজ প্রভৃতি সেযুগের কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেছিলেন। অধ্যাপকবৃত্তি ত্যাগ করবার পরে ১৮৫০ সালে তিনি মুর্শিদাবাদের জজ-পণ্ডিত পদে নিযুক্তি পেয়েছিলেন এবং শেষে ১৮৫৫ সালে তিনি মুর্শিদাবাদের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এরপরেই ১৮৫৮ সালে তাঁর অকাল মৃত্যু হয়েছিল। তিনি যদি আরো কয়েক বছর জীবিত থাকতে পারতেন, তাহলে হয়ত আরও বেশি উজ্জ্বলতা নিয়ে বাংলা সাহিত্য জগতে প্রকাশিত হতেন।
এখনও পর্যন্ত সব সাহিত্য সমালোচকই একথা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, মদনমোহনের মধ্যে কবিশক্তি বিদ্যমান ছিল। কৈশোরের দিনগুলিতে তিনি প্রথম তাঁর নিজের কবিত্বক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিলেন। মাত্র সতেরো বছর বয়সে তিনি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রসতরঙ্গিনী’ রচনা করেছিলেন। যদিও তাঁর এই পুস্তকটি প্রাচীন সংস্কৃত কবিতার একটি অনুবাদ সঙ্কলন ছিল এবং এতে আদিরসের আধিক্যও ছিল, তবুও সেযুগের সাহিত্য সমালোচকরা কিন্তু এটির প্রশংসাই করেছিলেন। তখন সতেরো বছরের এই কবিকিশোর তাঁদের বিস্মিত করতে তো পেরেছিলেনই, এমনকি ‘রসতরঙ্গিনী’ সেযুগের পাঠক সমাজের কাছে সমাদৃতও হয়েছিল। তবে এটি এখন একটি অচলিত কাব্যগ্রন্থ। এরপরে ১৮৩৬ সালে তাঁর লিখিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বাসবদত্তা’ প্রকাশিত হয়েছিল। এসময়ে কবির কবির বয়স হয়েছিল ঊনিশ বছর। তাঁর ছাত্রজীবন শেষ হতে তখনও ঢের দেরি ছিল। মদনমোহনের এই ‘বাসবদত্তা’ কোন মৌলিক কাব্যগ্রন্থ ছিল। প্রাচীন ভারতের সংস্কৃত সাহিত্যের কবি সুবন্ধুর গল্প-আখ্যায়িকা বাসবদত্তায় বর্ণিত কথাবস্তুকেই মদনমোহন তাঁর এই কাব্যগ্রন্থে সংক্ষেপে ছন্দোবদ্ধ করেছিলেন। তবে এটি আসল গ্রন্থের অবিকল বঙ্গানুবাদ ছিল না। সমালোচকদের মতে, ছন্দের ওপরে মদনমোহনের যে বেশ ভালোই অধিকার ছিল, এই কাব্যগ্রন্থে সেটার প্রমাণ পাওয়া যায়। এতে তাঁর কলাচাতুর্যের পরিচয় ফুটে উঠেছিল। তবে এই গ্রন্থে তিনি যে ছন্দোবৈচিত্র্য দেখিয়েছিলেন, সেটার উজ্জ্বল আদর্শ আসলে মধ্যযুগের বাংলার কবি-শিল্পী ভারতছন্দ্র ছিলেন। এমনকি এতে ভাষা প্রয়োগ করতে গিয়েও মদনমোহন ভারতচন্দ্রের দিকে ঝুঁকেছিলেন। এছাড়া মদনমোহনের হাতে বাসবদত্তার কাহিনী বর্ণনায় রায় গুণাকরের কাব্যের ভাবানুসরণও অনায়াসলক্ষ্য। এথেকে সহজেই বুঝতে পারা যায় যে, মদনমোহনের সময়কার বাঙালি কাব্যানুরাগীর দল তখনও পর্যন্ত ভারতচন্দ্র রায়ের কাব্যরীতির মোহকে কাটিয়ে উঠতে পারেননি। প্রসঙ্গতঃ একথাও স্মরণীয় যে, ১৮৩৬ সালের বাংলাতেও ভারত-কবির কৃত বিদ্যাসুন্দর নাটকের অভিনয় অনুষ্ঠিত হত, এবং গোপাল উড়ের বিদ্যাসুন্দর যাত্রা শুনবার জন্য সাধারণ মানুষ দলে দলে বিভিন্ন আসরে ভিড় জমাতেন। সুতরাং সেযুগের সাধারণ মানুষের মধ্যে তখনও যে বিদ্যাসুন্দর কাব্যের প্রভাব থেকে গিয়েছিল, একথা অনস্বীকার্য। কিন্তু নবীনযুগের মানুষ ও সংস্কৃত কলেজের কৃতী ছাত্র, বিদ্যাসাগরের সতীর্থ মদনমোহন তর্কালঙ্কারও তখন কাব্যনির্মাণ করতে উৎসাহী হয়ে যে ভারতচন্দ্রের মতোই কবিতা রচনা করবার দিকেই নিজের ঝোঁক দেখিয়েছিলেন—এটাকে একটা অদ্ভুত ঘটনা বলেই মনে হয়। এমনকি ঊনিশ শতকের তৃতীয় দশকের শেষের দিকে পৌঁছেও মদনমোহন নিম্নরূপ কাব্যপঙক্তি নির্মাণ করতে দ্বিধান্বিত হননি—

“ভালে ভাল বিকসিত অলকা বিলাসে।
মুখপদ্ম-মধু-আশে অলি আসে পাশে॥
শশাঙ্ক সশঙ্ক হেরি সে-মুখসুষমা।
ভাবি দিন দিন ক্ষীণ অন্তরে কালিমা॥”

সমালোচকদের মতে, উপরোক্ত কাব্যাংশটিতে রায়গুণাকরের রচনার প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। এছাড়া তিনি যখন লিখেছিলেন—

“খেলই নাগর নাগরীকোলে।
চুম্বই বিম্বাধর দু-কপোলে॥”

—তখন এতেও ভারতচন্দ্রীয় কাব্যকৌশলের ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। আসল কথা হল, যে কোনো ক্ষেত্রেই নতুনের পথে পদক্ষেপ প্রতিভাসাপেক্ষ ব্যাপার; প্রতিভার অভাব হলেই মানুষ নতুনের ভাবনায় মগ্ন না হয়ে পুরোনো রাস্তায় পা বাড়ায়। আর তাই অনেকের মতে, মদনমোহনের মধ্যে অভিনব বস্তুনির্মাণের ক্ষমতা ছিল না বলেই তিনি পুরোনো কাব্যপন্থাকে নিজের নির্ভরযোগ্য আশ্রয় করে তুলেছিলেন। অথচ সমাজচিন্তার ক্ষেত্রে এই মদনমোহনই কিন্তু আবার যুগচেতনায় সঞ্জীবিত ছিলেন, তিনি কখনোই যুগধর্মকে পাশ কাটিয়ে যাননি। ঊনিশ শতকের বাংলায় স্ত্রীশিক্ষা বিস্তার ও বিধবাবিবাহ প্রচলন করবার বিষয়ে তাঁর উৎসাহ-উদ্যমকে কিছুতেই বিস্মৃত হওয়া যায় না। এমনকি এসব কাজে সমাজবিপ্লবী বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর সহযোগিতা কখনো শিথিল হয়নি। ১৮৪৯ সালে বেথুন সাহেব যখন কলকাতায় ‘হিন্দুবালিকা বিদ্যালয়’ বা বর্তমান বেথুন কলেজ স্থাপনের বিষয়ে প্রয়াসী হয়েছিলেন, তখন সমকালীন আরো দু’-চারজন শিক্ষিত বাঙালিসহ মদনমোহন তর্কালঙ্কারও বেথুনকে এই শুভকার্যে সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রী জানিয়েছিলেন—
“তিনি নিজের দুই কন্যা ভুবনমালা ও কুন্দমালাকে হিন্দুবালিকা বিদ্যালয়ে পাঠাইয়া সৎসাহসের পরিচয় দিয়াছিলেন। শুধু তাহাই নহে, তিনি বিনা-বেতনে প্রতিদিন এই বিদ্যালয়ের বালিকাদের শিক্ষাদান করিয়াছেন, এবং শিশু-শিক্ষা রচনা করিয়া তাঁহাদের পাঠ্যপুস্তকের অভাব অনেকটা মোচন করিয়াছিলেন।”
এখানে যে ‘শিশুশিক্ষা’ নামক পুস্তকের কথা বলা হয়েছে, সেটাই মদনমোহনের সাহিত্য জীবনের তৃতীয় উল্লেখযোগ্য রচনা ছিল। এই কিছুকাল আগে পর্যন্ত যে ‘পাখী সব করে রব’ কবিতাটি বাংলার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নিজেদের শ্রুতি-মধুর কণ্ঠে আবৃত্তি করতেন, সেটা অতীতে এই ‘শিশুশিক্ষা’ নামক পুস্তকেরই অন্তর্গত ছিল। এখনও পর্যন্ত সকলেই একথা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, এই পুস্তকটির মত শিশুরঞ্জক বর্ণপরিচায়ক গ্রন্থ সেযুগে তো বটেই, এমনকি পরবর্তীযুগেও খুব বেশি লেখা হয়নি। এছাড়া বাংলায় স্ত্রীশিক্ষার প্রসারের জন্য তিনি কিছু কিছু প্রবন্ধও লিখেছিলেন।
কিন্তু যে মদনমোহন এহেন কালসচেতন ব্যক্তি ছিলেন, কাব্যভাবনার ক্ষেত্রে তিনি নিতান্ত অনগ্রসরই থেকে গিয়েছিলেন। তাঁর কবিতায় ভারতচন্দ্রের জগতের পুনরাবৃত্তি শুনতে আধুনিক সময়ের পাঠক-পাঠিকার ভালোলাগা সম্ভব ছিল না, এবং ভালো লাগেও নি। কিন্তু এমন কিছু করা ছাড়া তখন মদনমোহনের অন্য কোন উপায়ও ছিল না। কারণ, তিনি কোন সৃষ্টিপ্রক্রিয়াশীল কবি-ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন না। অবশ্য শুধু মদনমোহন নন, সমকালীন ঈশ্বর গুপ্ত আর রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ও রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের প্রভাবকে অতিক্রম করতে পারেননি বলেই সমালোচকরা মনে করে থাকেন। তবে এঁরা দু’জন যদিও বা তাঁদের কাব্যে নবযুগের কিছু কিছু বাণী উচ্চারণ করেছিলেন, মদনমোহন তর্কালঙ্কার কিন্তু তাঁর কাব্যে সবসময়েই পুরাতনের প্রতিধ্বনি করে গিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি কোনভাবেই স্বকীয় বৈশিষ্ট্য দেখাতে পারেননি। আর তাই একালের কাব্যামোদীদের কাছে তাঁর রচনা শুধুমাত্র জীর্ণ অতীতের বস্তুরূপেই থেকে গিয়েছে।

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ