উৎপল দত্ত
অনেকেই বলেন অনেকে ব্রিটিশের থেকেও তিনি ভাল ইংরেজি বলতেন! ইংরেজি ভাষা ও শেকসপিয়ার যদি উৎপল দত্তের শ্বাস-প্রশ্বাস হয়,তবে বাংলা ভাষা আর বাংলার প্রতি ছিল অদম্য টান। সেই টান কেমন দেখিয়ে গিয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে।
নাটকের জন্য জেল খেটেছেন অনেকদিন।
বাংলা ছবির পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের ঘোষণা ইংরেজিতে হচ্ছে দেখে পুরস্কার মঞ্চে একপ্রকার বোমা ফাটিয়েছিলেন৷ দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন 'বুঝতে পারছি না কোথায় আছি লন্ডন না আমেরিকায়....আমি এখানে যে উপস্থিত তাতেই আমি লজ্জিত'৷ তারপর স্টেজ থেকে নেমে এসে হনহন করে প্রেক্ষাগৃহ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন৷
© ধ্রুবতারাদের খোঁজে
চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য মৃত্যুর এক বছর আগে বি.এফ.জে.এর লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার পেয়েছিলেন উৎপল দত্ত,এর আগের বছর 'আগন্তুক' ও 'পথ ও প্রসাদ' এ অভিনয়ের জন্য ওই সংস্থার সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিলেন৷ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান ১৯৯২-এর রবীন্দ্রসদনে৷ পুরস্কার ঘোষণার পর্ব চলছে,সবটাই হচ্ছে ইংরেজিতে৷ উৎপল দত্তের নাম যথারীতি ঘোষিত হল সেই ইংরেজিতে,মঞ্চের ওপরে উঠে কার্যত একপ্রকার কার্যত বোমা ফাটানো- 'বুঝতে পারছি না কোথায় আছি লন্ডন না আমেরিকায়....আমি এখানে যে উপস্থিত তাতেই আমি লজ্জিত'৷
কতটা মূল্যায়ন উৎপল দত্ত সম্পর্কে হয়েছে বলা বেশ কঠিন তবে চলচ্চিত্র সমালোচক,বোদ্ধারা বলেন তিনি বানিজ্যিক হোক বা তথাকথিত আর্টফিলম,বাংলা অথবা হিন্দি, অভিনয়ের সুত্রে তিনি সত্যিই সব্যসাচী৷ অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী,জীবনের জেগে থাকা সময়ের যেকোনও মুহূর্তে বই ছিল চিরসঙ্গী,শুটিং করছেন,সেখানেও বই,শট রেডি হলে বইটা কিছুক্ষনের জন্য বন্ধ করে পরিচালকের নির্দেশ মত অনবদ্য অভিনয়,প্রায় সিঙ্গল টেক আর ওকে৷ শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধ এক মানুষ,যখন ১৮বছর তখন থেকে পেশাদার অভিনেতা৷ সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ার সময় তৈরি করেছিলেন 'দ্য শেকসপিয়ারানস',অভিনয় করেছিলেন ইংরেজি নাটক 'রিচার্ড দ্য থার্ড'৷ শেকসপিয়ার বা ইংরেজি ভাষা যদি হয় তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস তবে বাংলা ভাষা আর বাংলার প্রতি ছিল অদম্য টান,সেই টান কেমন তিনি দেখিয়েছেন বাংলা চলচ্চিত্রের পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে৷
© ধ্রুবতারাদের খোঁজে
উৎপল দত্তের কাছে নাটক ছিল প্রতিবাদের ভাষা। হাতিয়ার হিসেবে নাটককে ব্যবহার করতেন।নিজের সম্পর্কে উৎপল দত্ত বলতেন আমি শিল্পী নই। নাট্যকার বা অন্য যেকোনও আখ্যা লোকে আমাকে দিতে পারে। তবে আমি মনে করি আমি প্রোপাগান্ডিস্ট।
গননাট্য সংঘের কলকাতা শাখায় যোগ দিয়ে প্রথম বাংলা নাটক অভিনয় 'ভাগবন্দর'-এ,পরে 'ম্যাকবেথ' বাংলায় অভিনয় করেন,আমৃত্য ইংরেজি ভাষা চর্চা করেছেন। কল্লোল' এক কালজয়ী নাটক,জন্ম দেয় গণ আন্দোলনের।নিষিদ্ধ হয় কল্লোল নাটক। ১৯৬৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মহালয়ার দিন গ্রেফতার করা হয় উৎপল দত্তকে। জেল খাটলেন অনেকদিন।নাটকটি অমর হয়ে রয়েছে গণমানুষের নাটক হয়ে, সাথে সাথে অমরত্ব দিয়েছে মহান নাট্যকার উৎপল দত্তকেও।
নাটকের দৃশ্যে উনি মঞ্চে ঢুকেই নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলতেন, ‘নামগুলো পড়ো…নামগুলো পড়ো’। নামগুলো পড়া হত… 'কল্লোলে'র জন্য উৎপল দত্ত কে জেলে ভরে দিয়ে শাসক ভেবেছিল নাটক বন্ধ করা যাবে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অনেক শিল্পী-সাংস্কৃতিক কর্মী উৎপলের মুক্তি চেয়ে বিবৃতি দেন। শ্লোগান উঠেছিল 'কল্লোল চলছে, চলবে '। ভারতবর্ষ শুধু নয় নাটকের কথা, পৌঁছে গিয়েছিল বিদেশেও।
© ধ্রুবতারাদের খোঁজে
ভারতীয় নাটকে প্রথমবারের জন্য স্টেজে এসেছিলেন শ্রমিকরা এবং নায়কের ভূমিকায়, নতুন করে বলার দরকার হয়না নাটকের নাম উৎপল দত্তের 'অঙ্গার'। রবিশংকরের আবহসঙ্গীত নাটকে আলাদা মাত্রা যোগ করেছিল, সঙ্গে তাপস সেনের আলো।প্রতি শোয়ে গান করে যেতেন নির্মলেন্দু চৌধুরী, সেজন্য তিনি কোনও পারিশ্রমিক নিতেন না,উৎপল,শোভারা সম্ভব হলে কখনও কিছু যাতয়াতের ভাড়া দিতেন। সেইসময় ধানবাদে কয়ালাখনিতে দুর্ঘটনা ঘটে। বহু শ্রমিক মারা গিয়েছিলেন, খবর পেয়েই কয়লাখনিতে ছুটে গিয়েছিলেন উৎপল দত্ত,সেই নিয়েই তিনি‘অঙ্গার’ নাটকটি লেখেন। টিম ওয়ার্ক আদপে কি বস্তু বুঝিয়ে দিয়েছিল 'অঙ্গার'-এর অসমান্য সাফল্য।মিনার্ভা থিয়েটার প্রেক্ষাগৃহে লিটল্ থিয়েটার গ্রুপ কর্তৃক উৎপল দত্তর রচনায় ও পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয় 'অঙ্গার' নাটক। নাটকে তুলে ধরা হয়েছিল ভারতের কয়লাখনি শ্রমিকদের প্রতি শোষণের কাহিনী এবং অন্ধকার খনিগর্ভের মধ্যে জলবন্দী হয়ে আটকে থাকা কয়েকজন শ্রমিকের ভয়াবহ বিভীষিকাময় দিনের ঘটনা।
সত্যজিৎ রায়ের মত প্রবাদপ্রতিম চিত্র পরিচালকের অভিমত উত্তমকুমার ছাড়া 'নায়ক' ছবি করা সম্ভব হত না,তেমন উৎপল দত্তের অভিনীত প্রথম হিন্দি ছবি 'ভুবন সোম' চরিত্রে তিনি ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প ভাবা যায় না৷ কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায় তাঁর ২১নম্বর ছবিতে প্রথম উৎপল দত্তকে সুযোগ দিলেন, ১৯৭৬ সালে মুক্তি প্রাপ্ত ছবি 'জন অরণ্যে'৷ 'জয় বাবা ফেলুনাথ'-ছবির ভিলেন মগনলাল মেঘরাজের চরিত্রের অন্যতম তরুপের তাস অবাঙালির বাংলা উচ্চারণ,উৎপল দত্তের অভিনয় গুনে অনবদ্য,আবার ' হীরক রাজার দেশে' সেখানে উৎপল দত্ত স্বয়ং হীরক রাজা৷ 'আগন্তুকে' তিনি কেমন অভিনয় করেছেন সেকথা বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করতে গেলে উল্লেখ করতেই হবে কেমন ছিল উৎপল দত্তের অভিনয়ের দ্যুতি,বৈচিত্র্য৷
মানিকবাবুর তুলনায় আরেক কিংবদন্তি চিত্র পরিচালক মৃণাল সেনের ছবিতে বেশি অভিনয় করেছেন উৎপল দত্ত,ছবির সংখ্যা সাত,তবে সবটি বোধহয় রাজনৈতিক ইমেজের চরিত্র! তপন সিংহের তিনটি ছবিতে অভিনয় করেছেন৷ আবার একটু মনে করুন তরুণ মজুমদারের 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজ' ছবির সেই দৃশ্য 'কৃপা করি কর মোরে রাজবাহাদুর' কমেডি কাকে বলে!যেন দর্শককে দেখালেন,মুগ্ধ করে রাখলেন অনন্য আবেশে৷ মধু বসু পরিচালিত 'মাইকেল মধুসূদন' উৎপল দত্তের চলচ্চিত্র অভিনয়ের প্রথম ছবি,'ছায়ানট' নামে প্রথম যে মৌলিক নাটক তিনি লিখেছিলেন সেটার পটভূমি কিন্তু বাংলা সিনেমা জগৎ৷
বহুমুখী প্রভিতার মানুষ উৎপল দত্ত সম্পর্কে যেটুকু বোধহয় সাহস করে বলা যায় সিনেমার ক্ষেত্রে মামুলি,বৈচিত্র্যহীন চরিত্রকে তিনি অভিনয় গুনে হিট করাতে পারতেন,একই কথা প্রযোজ্য তাঁর ডায়লগ বলার ভঙ্গিমায়,আর চোখ-মুখের অভিব্যক্তিতে৷
শক্তি সামন্তের 'অমানুষ' বোধহয় একটা উদাহরণ,হিন্দি সিনেমায় খলনায়ক চরিত্র নতুনভাবে কেমন হতে পারে,এই ছবি বলা যেতে পারে একটা নতুন দখিনা হাওয়া নিয়ে এসেছিল,চরিত্র যে শুধুমাত্র ভিলেন নয় এর গণ্ডি আরও অনেকটা বিস্তৃত,হিন্দি ছবিতে সেটা বোধহয় প্রথম দেখিয়ে গিয়েছেন উৎপল দত্ত,পরে তাঁকে অনুকরণ করার চেষ্টা করেছেন অনেকে৷
কমিক অথবা ভিলেন দুটো প্যাটার্নের চরিত্রে অভিনয় করেও কি অনায়াস দক্ষতায় ভেঙে ফেলেছেন চেনা ছক,শুধুমাত্র কমেডিকে ভেঙে দিয়ে গড়েছিলেন কমিক ভিলেনি জনপ্রিয়তার নতুন ব্যকরণ, বিরল দক্ষতায়,অমোঘ আকর্ষণীয় ক্ষমতায়৷
তবে এতকিছুর মধ্যেও শেষ পর্যন্ত তিনি আপাদমস্তক একজন ‛থিয়েটারওয়ালা’ হিসাবেই বিশ্বব্যাপী পরিচিত ছিলেন।
Comments
Post a Comment