রাজশেখর
☘️| রাজশেখরের পরশুরাম হয়ে ওঠা |☘️
বাংলা সাহিত্যে হাস্যধারার গল্পের ইতিহাসে ‘পরশুরাম’ ছদ্মনামে রাজশেখর বসুর (১৮৮০-১৯৬০) আত্মপ্রকাশ একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিল এবং শুধুমাত্র তাঁর ব্যক্তিত্বকে আশ্রয় করে দীর্ঘদিন ধরে এই ধারাটি অব্যাহত গতিতে এগিয়ে গিয়েছিল।
১৩২১ বঙ্গাব্দের ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় তাঁর বিখ্যাত ‘বিরিঞ্চি বাবা’ নামক গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, আর তাঁর তিরোধানের পরেও বেশ কিছুকাল ধরে প্রায় সব সাহিত্য-সাময়িক পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা তাঁর লিখিত রস-গল্পের শিরোনামাঙ্কন নিয়ে আত্মপ্রকাশে উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল যে, আশিবছর বয়সে পৌঁছে—নিজের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁর লেখনীতে হাসির উৎস কখনো ম্লান হয়ে যায়নি। আর এর থেকেও বড় বিস্ময় হল তাঁর প্রতিভার বিচিত্রমুখী দক্ষতা। আজও ‘চলন্তিকা’ অভিধান, এবং সংস্কৃত ভাষার রামায়ণ ও মহাভারতের বঙ্গানুবাদের ক্ষেত্রে তাঁর প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য, মননশীলতা ও গবেষণা-প্রবৃত্তির পরিচয় তো পাওয়া যায়ই, একইসঙ্গে তাঁর চিন্তা-দীপ্ত আরো ছোটবড় প্রবন্ধ ও প্রবন্ধসংগ্রহও এর ব্যতিক্রম নয় বলেই দেখতে পাওয়া যায়। একজন সাহিত্যিক হিসেবে নিজের জীবন শুরুর কথা প্রসঙ্গে তিনি নিজেই একবার জানিয়েছিলেন—
❝ জীবনে প্রথম লিখি বেয়াল্লিশ বছর বয়সে, ১৯২২ সালে। সে লেখাটা হচ্ছে শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড। লেখাটি প’ড়ে অনেকের ধারণা হয়েছিল যে, এটি কোনো উকিলের লেখা...।❞🩷🌻
অথচ এটি কোন আইনজীবীর নয়, বরং একজন বিজ্ঞানীর, বা আরও ভালো করে বললে একজন রসায়নবিদের লেখা ছিল। তবে একইসাথে একথাও উল্লেখ্য যে, রাজশেখর আইন পড়েছিলেন, এমনকি আইন পাসও করেছিলেন, কিন্তু কোনদিন ওকালতিকে নিজের পেশারূপে গ্রহণ করেন নি। নিজের ছাত্রজীবন প্রসঙ্গে তিনি একবার জানিয়েছিলেন—
❝ আমার পিতা ছিলেন দ্বারভাঙ্গা স্টেটের ম্যানেজার। দ্বারভাঙ্গা রাজস্কুল থেকে এনট্রান্স পাস করি, আর পাটনা থেকে ফার্স্ট আর্টস। তারপর বি. এ. আর কেমিস্ট্রি নিয়ে এম. এ. পাস করি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।❞🤎
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডক্টর রাজেন্দ্রপ্রসাদের দাদা মহেন্দ্রপ্রসাদ পাটনায় তাঁর সহপাঠী ছিলেন। তাহলে শুধু কি শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড লেখবার জন্যই তিনি তাঁর জীবনে প্রথমবারের মত একজন সাহিত্যিক হিসেবে কলম ধরেছিলেন, এর আগে কি কখনো কোনো দিন দু’-এক ছত্র লেখবার শখও কি তাঁর হয়নি? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি একবার জানিয়েছিলেন—
❝ হয়েছিল। শিশুদের যেমন একবার হাম-ডিপথেরিয়া হওয়াটা একটা নিয়ম। তেমনি প্রাকৃতিক নিয়মে কবিতা লেখার শখ হয়েছিল বাল্যকালে, তখন দু’-এক ছত্র লিখেছি। কিন্তু তা পনরো-ষোলো বছর বয়সের মধ্যেই চুকে যায়।❞🧡
তবে পাটনায় থাকবার সময়ে রাজশেখর কিন্তু নিজের সহাধ্যায়ী ও সতীর্থদের সঙ্গে রীতিমত সাহিত্যলোচনায় রত হতেন। পাটনায় তখন তাঁর সঙ্গে প্রায় ন’-দশজন বাঙালি ছাত্র পড়তেন। বাংলা সাহিত্যের সেই সময়টা ছিল বঙ্কিম-হেম-নবীনের প্রবল প্রতাপের যুগ; তাঁরাই তখন বাঙালির মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন। কিন্তু এসবের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ নিয়েও তখন রাজশেখর ও তাঁর সতীর্থদের মধ্যে আলোচনা হত। আর তাঁর সতীর্থদের মধ্যে অনেকে যেমন বলতেন যে, বঙ্কিমের মত প্রতিভা এদেশে তো বটে ইউরোপেও নেই, তেমনি কেউ কেউ আবার বলতেন যে, রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমকেও হারিয়ে দেবেন। পরবর্তীসময়ে একটি সাক্ষাৎকারে এপ্রসঙ্গে রাজশেখর জানিয়েছিলেন—
❝ রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ। তখন তিনি কেবল কবি বলেই পরিচিত ছিলেন, গল্প-উপন্যাস বেশি লেখেন নি। সে আমলে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে সাধারণ নালিশ ছিল এই যে, তাঁর লেখা কিছু বোঝা যায় না।❞💙
ছাত্রজীবনে সাহিত্যের সঙ্গে রাজশেখরের সম্পর্ক কম ছিল। তখন শুধুমাত্র সহাধ্যায়ীদের সঙ্গে সাহিত্য বিষয়ক কিছু আলোচনা এবং সেযুগের অন্য পাঁচজন ব্যক্তি যেমন করতেন, তেমনি অবসর সময়ে সাহিত্যগ্রন্থাদি পাঠ করা—এটুকুই ছিল তাঁর সাহিত্য-চর্চা। নিজের উত্তর-জীবনে তিনি যে কোনো দিন স্বয়ং সাহিত্যিক হয়ে উঠবেন এবং সাহিত্য-রসে নিজেকে জারিত করে নেবেন—এমন কোন সম্ভাবনা কিন্তু তাঁর মধ্যে তখন দেখতে পাওয়া যায়নি, এমনকি এবিষয়ে তিনি নিজেও তখন কখনো কোন কল্পনা করেননি। কারণ, নিজের ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি যে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছিলেন, সেই জীবন আর যাই হোক না কেন, সেটার সঙ্গে সাহিত্যের কোন ধরণের সম্পর্ক ছিল না। তাঁর কর্মজীবনকে রসময় জীবন বললেও ভুল কিছু বলা হয় না, কেননা তাঁর সে জীবন পুরাপুরিভাবে রসায়নশাস্ত্রেই জারিত ছিল। তিনি রসায়নে প্রথম স্থান অধিকার করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. পাস করেছিলেন। আর বলাই বাহুল্য যে, বিজ্ঞানে এহেন পারদর্শিতা লাভ করবার পরে উত্তরজীবনে বিজ্ঞানই তাঁর একমাত্র সাধনার ক্ষেত্র হবে—এ বিশ্বাস তাঁর মধ্যে তখন সম্ভবতঃ ছিল। আর একারণেই সেসময়ে তিনি এদিকেই নিজের মনকে চালিত করেছিলেন। এপ্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছিলেন—
❝ আমি কলেজ ছেড়েই এক রাসায়নিক কারখানায় যোগ দিই। এইখানে একাদিক্রমে ত্রিশ বছর অধ্যক্ষের কাজ ক’রে স্বাস্থ্যহানির দরুন ১৯৩২ সালের শেষের দিকে অবসর গ্রহণ করি।❞🖤
এই কারখানার নাম ছিল বেঙ্গল কেমিক্যালস। এখানে তিনি একজন রাসায়নিক হিসাবে যোগ দিলেও অল্পদিনের মধ্যেই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনভার তাঁকেই গ্রহণ করতে হয়েছিল। প্রসঙ্গতঃ একথাও উল্লেখ্য যে, তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ছাত্র ছিলেন। আর এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করবার সময়েই বাংলা ভাষার উপরে তাঁর আন্তরিক টানের নমুনা দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। তিনিই বেঙ্গল কেমিক্যালসে বাংলা ভাষায় হিসাবপত্রাদি রাখবার নিয়ম চালু করেছিলেন; শুধু সেটাই নয়, তাঁর সময় থেকেই এই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগের নাম বাংলা ভাষায় করা হয়েছিল, এমনকি এখানে তৈরি হওয়া ওষুধপত্রের নামও সংস্কৃত-ইংরেজি মিশিয়ে রাখা হয়েছিল। বেঙ্গল কেমিক্যালস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর সাহিত্যচর্চা শুরু হওয়ার প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছিলেন—
❝ বাল্যের কবিতা রচনার শখের কথা বাদ দিলে এই প্রতিষ্ঠানেই আমার সাহিত্যচর্চার আরম্ভ। এখানেই তার হাতে-খড়ি বলতে পারা যায়। অবশ্য, মূল্যতালিকা তৈরি করা বা বিজ্ঞাপন লেখাকে যদি কেউ সাহিত্য বলে গ্রাহ্য করে। কেননা শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেডের আগে আমার যা-কিছু বাংলা রচনা তা এ ছাড়া আর কিছু না।❞💚
এই শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড গল্পটি আসলে তিনি সেযুগের জনক’য়েক ধুরন্ধর ব্যবসায়ীকে ব্যঙ্গ করবার জন্য লিখেছিলেন, এবং এটি লেখবার পরেই তাঁর লেখা হয়ত শেষ হয়ে যেত। কারণ, এরপরে আর কিছু লেখবার ইচ্ছা ও প্রেরণা—কোনোটাই তাঁর মধ্যে ছিল না। কিন্তু ঠিক এসময়েই জলধর সেন প্রেরণা হয়ে তাঁর সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন। জলধর সেন সম্পাদিত ভারতবর্ষ পত্রিকায় শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড ছাপা হওয়ার পরে তিনি তাঁকে আরও লেখবার জন্য চাপ দিতে শুরু করেছিলেন। এরফলে তাঁর তাগাদায় এবং প্রেরণায় রাজশেখরকে একে একে চিকিৎসা-সংকট, মহাবিদ্যা, লম্বকর্ণ, ভুশণ্ডীর মাঠে ইত্যাদি হাস্যকাহিনীগুলি লিখতে হয়েছিল। আর এভাবেই যখন তাঁর লেখা কয়েকটি গল্প পাঠক-পাঠিকা মহলে সমাদৃত হয়ে উঠতে শুরু করেছিল, ঠিক তখনই তাঁকে প্রেরণা দিতে যিনি এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁর নাম হল ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এসময়ে রাজশেখরের লেখা গল্পগুলি হয়ত আজও সাময়িকপত্রের পাতার মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে পড়ে থাকত, কিন্তু উৎসাহী ব্রজেন্দ্রনাথের উদ্যোগেই তাঁর এই ক’টি গল্প একত্রিত করে ১৩৩২ বঙ্গাব্দে ‘গড্ডালিকা’ নামক তাঁর প্রথম গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল।
রাজশেখর তখন কলকাতার বকুলবাগানের বাসিন্দা ছিলেন না, তিনি তখন পার্শিবাগানে তাঁর পৈতৃক ভবনে বাস করতেন। সেখানে তাঁদের একটা আড্ডা বসত, যেটার নাম ছিল আরবিট্রারী ক্লাব; পরে এর বাংলা নাম রাখা হয়েছিল—উৎকেন্দ্র। এই উৎকেন্দ্র সংঘের সদস্যদের মধ্যে জলধর সেন, প্রবাসীর কেদারনাথ মুখোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিরা প্রধান ছিলেন। শিল্পী যতীন্দ্রকুমার সেন এটির সভাপতি ছিলেন। এছাড়া শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রভাতচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং আরও অনেকেই এখানে মাঝে মাঝে যোগ দিতেন।
আসলে বাংলা সাহিত্যে রাজশেখর বসুকে যাঁরা দান করেছিলেন, তাঁরা অন্য কেউ নন, সেযুগের ঐ ব্যবসায়ী-ধুরন্ধর ব্যক্তিরা ছিলেন; যাঁদের ঠাট্টা করতে গিয়েই বিংশ শতকের বাংলার একজন অখ্যাত রাসায়নবিদ রাতারাতি বাংলা সাহিত্যের একজন প্রখ্যাত রসসাহিত্যিক হয়ে উঠেছিলেন। আরও ভালো করে বললে, এটাকে একজন রসায়নশাস্ত্রীর রসশাস্ত্রী হয়ে উঠবার কাহিনী বলা যেতে পারে। এত ছোট একটা উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে এমন-একটা মহোৎসব বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে খুব একটা পাওয়া যায় না। তাছাড়া জলধর সেন ও ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের যে বিশেষ চারাগাছটির সন্ধান পেয়েছিলেন, এবং নিজেদের স্নেহের জলে ও উৎসাহের রৌদ্রে সেই শিশুবৃক্ষটিকে একটি বিরাট মহীরুহে পরিণত করবার জন্য যে চেষ্টা তাঁরা করেছিলেন, এজন্য বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য তাঁদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।
রাজশেখর তাঁর সমস্ত রচনাগুলির জন্য দুটি নাম ব্যবহার করেছিলেন,—গল্প রচনা করেছিলেন পরশুরাম নামে, আর অন্যান্য রচনাগুলি লিখেছিলেন স্বনামে। কিন্তু গল্পরচনার ক্ষেত্রে তিনি যে পরশুরাম ছদ্মনামটি ব্যবহার করেছিলেন, এর তাৎপর্য সম্পর্কে আজও অনেকের মনে বিভ্রান্তি রয়েছে; এ পরশুরাম আসলে কোন পরশুরাম? অতীতে এপ্রসঙ্গে তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন—
❝ এ একটি স্যাকরা। পৌরাণিক পরশুরামের সঙ্গে এর কোনো সম্বন্ধ নেই।❞❤
আসলে তিনি যখন শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড গল্পটি লিখেছিলেন, এবং তাঁদের পার্শিবাগানের বাড়িতে উৎকেন্দ্র সংঘে সেটি পাঠ করা হয়েছিল, তখনই এটিকে জলধর সেন সম্পাদিত ভারতবর্ষ পত্রিকায় ছাপাবার কথা উঠেছিল। কিন্তু নিজের নামে তখন কোন লেখা ছাপানোর বিষয়ে তাঁর মধ্যে সংকোচ ছিল বলে, সকলে মিলে লেখালেখির ব্যাপারে তাঁকে অন্য একটা নামের সন্ধান দিতে সচেষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। পরবর্তীসময়ে এপ্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছিলেন—
❝ দৈবক্রমে সেই সময় তারাচাঁদ পরশুরাম নামে এক কর্মকার-কোম্পানির অন্যতম পার্টনার পরশুরাম সেখানে উপস্থিত হয়। হাতের কাছে তাঁকে পেয়ে তাঁর নামটা নিয়ে নেওয়া হল। এই নামের পিছনে অন্য কোনো গুঢ় উদ্দেশ্য নেই। পরে আরো লিখব জানলে ও-নাম হয়তো দিতাম না।❞💛
এই স্যাকরা পরশুরাম হয়ত কোনদিন জানতেও পারেননি যে, রাজশেখরকে নিজের নামটি ধার দিয়ে তিনি কতটা বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন।
আশ্চর্যের বিষয় হল যে, বহির্জগতের সঙ্গে রাজশেখর বসুর কিন্তু খুব কমই যোগাযোগ ছিল। তাঁর নিজের ভাষায়—
❝ জীবনে আমি খুব কম লোকের সঙ্গে মিশেছি, তাই আমার অভিজ্ঞতাও খুব কম। গ্রাম বেশী দেখি নি। কর্মক্ষেত্রে যাদের সঙ্গে মিশেছি তাঁরা সব ব্যবসায়ী আর দোকানদার ক্লাস।❞💜
কিন্তু এই সামান্য অভিজ্ঞতাকেই তিনি যে অসামান্য কাজে লাগিয়েছিলেন, এর প্রমাণ তাঁর প্রথম গল্পেই পাওয়া গিয়েছিল। রাজশেখরের প্রথম গ্রন্থ গড্ডলিকা প্রকাশিত হওয়ার পরে প্রমথ চৌধুরী তাঁর সবুজ পত্রে এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ প্রবাসীতে এবিষয়ে সমালোচনা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। আর এসব ঘটনার পরে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় একটি পত্রে রবীন্দ্রনাথকে কৃত্রিম অভিযোগ জানিয়ে লিখেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধে পরশুরামের এত সুখ্যাতি করবার জন্য তাঁকে যে অসুবিধায় পড়তে হবে এই আশঙ্কা তাঁর হয়েছে; কেননা, তাঁর এই প্রশংসার কারণে বেঙ্গল কেমিক্যালস ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে, এরফলে গড্ডলিকা হয়ত হাজার বারো কপি বিক্রি হবে, এবং কোম্পানির ম্যানেজার তখন কেমিস্ট্রি ছেড়ে গল্প নিয়েই মত্ত হয়ে পড়বেন। আচার্যের এই অভিযোগের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে যে পত্রটি লিখেছিলেন, সেটা নিম্নরূপ ছিল —
— ❝ শান্তিনিকেতন
সুহৃদ্বর, বসে বসে Scientific American পড়ছিলুম, এমন সময় চিঠির খামের কোণে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান-সরস্বতীর পদাঙ্ক দেখতে পেয়ে সন্দেহ হল আমার হৃৎপদ্ম থেকে কাব্যসরস্বতীকে বিদায় করে তিনি স্বয়ং আসন নেবেন এমন একটা চক্রান্ত চলে। খুলে দেখি, যাকে বলে ইংরেজিতে টেবিল-ফেরানো—আমারই পরে অভিযোগ যে, আমি রসায়নের কোঠা থেকে ভুলিয়ে ভদ্রসন্তানকে রসের রাস্তায় দাঁড় করাবার দুষ্কর্মে নিযুক্ত। কিন্তু আমার এই অজ্ঞানকৃত পাপের বিরুদ্ধে নালিশ আপনার মুখে শোভা পায় না; একদিন চিত্রগুপ্তের দরবারে তার বিচার হবে। হিসাব করে দেখবেন কত ছেলে যাঁরা আজ পেটমোটা মাসিক পত্রে ছোট গল্প আর মিলহারা ভাঙা ছন্দের কবিতায় সাহিত্যলোকে একেবারে কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড বাঁধিয়ে দিতে পারত, এমন কি, লেখাদায়গ্রস্ত সম্পাদকমণ্ডলীর আশীর্বাদে যাঁরা দীপ্তশিখা সমালোচনায় লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত বড় বড় লাফে ঘটিয়ে তুলত, তাঁদের আপনি কাউকে বি. এস-সি. কাউকে ডি. এস-সি. লোকে পার করে দিয়ে ল্যবরেটরির নির্জন নিঃশব্দ সাধনায় সন্ন্যাসী করে তুললেন। সাহিত্যের তরফ থেকে আমি যদি তার প্রতিশোধ নিতে চেষ্টা করে থাকি কতটুকুই বা কৃতকার্য হয়েছি। আপনার রাসায়নিক বন্ধুটিকে বলবেন মাসিকপত্র বলে যেসব জীবাত্মা হয়ত বা সাহিত্যবীর হতে পারত ভুশণ্ডীর মাঠে তাঁদের অঘটিত সম্ভাবনার প্রেতগুলির সঙ্গে আপনার মোকাবিলার পালা যেন তিনি রচনা করেন।
আমার কথা যদি বলেন আপনার চিঠি পড়ে আমি অনুতপ্ত হই নি, বরঞ্চ মনের মধ্যে একটু গুমর হয়েচে। এমন কি ভাবচি স্বামী শ্রদ্ধানন্দের মত শুদ্ধির কাজে লাগব, যেসব জন্মসাহিত্যিক গোলেমালে ল্যাবরেটরির মধ্যে ঢুকে পড়ে জাত খুইয়ে বৈজ্ঞানিকের হাটে হারিয়ে গিয়েছেন তাঁদের ফের একবার জাতে তুলব। আমার এক-একবার সন্দেহ হয় আপনিও বা সেই দলের একজন হবেন, কিন্তু আর বোধ হয় উদ্ধার নেই। যাই হোক, আমি রস-যাচাইয়ের নিকষে আঁচড় দিয়ে দেখলাম আপনার বেঙ্গল কেমিক্যালের এই মানুষটি একেবারেই কেমিক্যাল গোল্ড নন, ইনি খাঁটি খনিজ সোনা।
এ অঞ্চলে যদি আসতে সাহস করেন তাহলে মোকাবিলায় আপনার সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করা যাবে।
ইতি, ১৮ অঘ্রান, ১৩৩২
আপনার
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর...।❞🌿
প্রফুল্লচন্দ্রকে লেখা রবীন্দ্রনাথের এই চিঠিটি রাজশেখর আমৃত্যু নিজের কাছে সযত্নে সংরক্ষিত করে রেখেছিলেন। এছাড়া তাঁর কাছে আরো একটি চিঠি সযত্নে রক্ষিত ছিল, যেটি চক্রবর্তী রাজা রাজাগোপালাচারী তাঁর একটি লেখার তামিল অনুবাদ দেখে অযাচিতভাবেই প্রশংসাপত্ররূপে তাঁর কাছে পাঠিয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, অতীতে রাজশেখরের রচনা কিন্তু হিন্দি, তামিল, তেলুগু, এমনকি কানাড়ী ভাষাতেও অনূদিত হয়েছিল।
১৯৩২ সালে রাজশেখর বেঙ্গল কেমিক্যালস থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। আর অবসর গ্রহণের পরে সাত-আট বছর ধরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিভাষা ও বানান-সংস্কার সমিতির সভাপতিত্ব করেছিলেন; এছাড়া নিজের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সরকারি কার্যের পরিভাষা-সমিতির সভাপতি ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪৫ সালে তাঁকে সরোজিনী পদক ও ১৯৪০ সালে জগত্তারিণী পদক দিয়ে সম্মানিত করেছিল। ১৯৫৫ সালে বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। ১৯৫৬ সালে ভারত সরকার তাঁকে ❝ পদ্মভূষণ ❞ উপাধিতে ভূষিত করেছিল, এবং ১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি. লিট. উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছিল..🌷
Comments
Post a Comment