ওহ্
যারা বলে, মেয়েরা অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হলেই তারা হাত বাড়িয়ে ক্ষমতায়ন উচ্চাকাঙ্ক্ষা, স্বাধীনতা ছুঁতে পারে, আমি তাদের সঙ্গে একমত হই না। হই না এই জন্য নয় যে আমি মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের বিরুদ্ধে। শুধু অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হলেই যদি সমস্যা মিটে যেত, এই মেয়েটি মরত না। সে পরিষ্কার লিখেছে, তার স্বামী তার চাকরির টাকাটুকুর জন্য তাকে বিয়ে করেছিল। "চাকরি করতে দেব না", বলা আগ্রাসন, এখন "চাকরি করে টাকা এনে দাও" তে পরিণত হলে, চাকরি করা আদৌ মেয়েদের স্বাবলম্বী করবে কিনা সে প্রশ্ন ভাবায় কিন্তু। মেয়েরাও কর্মস্থলে বসে গর্ব করে বলবে, "আমার বর তো জল অবধি নিজে নিতে পারে না। আমার দামড়া মেয়ে তো আমি না খাইয়ে দিলে খেতেই পারে না।" চাকরি না করা ননদ জা'দের ছোট করবে নিজেদের আলোচনায়। এগোবে কি আদৌ? এক ইঞ্চিও।
নিজের শর্তে, নিজের স্পর্ধায় বাঁচতে জানা একটা সাহস। সেটা অর্জন করার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়া একটা সোপান, একমাত্র নয়।
আমার মা চাকরি করতেন না। উচ্চশিক্ষিতা M.A, B.ed(1st class) হয়েও চাকরি করতে পারবেন না, এই শর্তেই আমার প্রগতিশীল একদা নকশাল করা আজীবন বামপন্থী শিক্ষক পিতা তাকে বিয়ে করেছিলেন। অবশ্যই তার সৌন্দর্য ও গৃহকর্মে নিপুনতা দেখে। আমার মা এমন কোনও চেনাজানা রান্না নেই যা পারেন না। স্পঞ্জ রসগোল্লা থেকে বিরিয়ানি সব। আমার বাবার অর্থনৈতিক তো বটেই সংসার পরিজন সব বিষয়ের A to Z মা তদারক করতেন, যেহেতু বাবার বিন্দুমাত্র সাংসারিক জ্ঞান ছিল না। ট্যাক্সের হিসাব থেকে NSC, সমস্ত কিছু। যত দিন এগিয়েছে, মা তত সংসারটাকে শক্ত হাতে সামলেছেন। প্রচুর প্রতিকূলতা এসেছে। না, সেগুলো অর্থনৈতিক নয়। পরিবারের পুরুষটি সংসার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কনসাস না হলে যা যা সামলাতে হয় সব। মেয়ের পড়াশোনা থেকে চাকরি, সম্বন্ধ দেখে মনের মত বিয়ে দেওয়া সব। কিছুটা পরিস্থিতি সামলে নিয়ে মা পড়াশোনার প্রতিও সুবিচার করেছেন। প্রচুর টিউশন করেছেন, স্কুলে আংশিক সময়ের শিক্ষিকা হিসাবে পড়িয়েছেন। বাবার সাপোর্ট সিস্টেম ছিলেন মা। মায়ের কথাই শেষ কথা, আজও। তার বিচক্ষণতা ব্যক্তিত্ব জেদ স্মার্টনেস যে কোনও পুরুষ মানুষের সমকক্ষ।
অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের চেয়েও আমার মতে যে শিক্ষাটা জরুরি সেটা পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করার মানসিকতা। হার না মানার , আত্মমর্যাদায় দৃঢ় থাকার জেদ। আমার মাকে আমি কখনও কাঁদতে দেখিনি, এমনকি আমায় বিয়ে দিয়ে বিদায়ের দিনও নয়। আমার চাকরি না করা মা আমায় বিয়ে টিয়ের অনেক আগে বলে রেখেছিলেন, "যেখানেই বিয়ে হোক, যদি দেখো, তোমার কোনও ভুল না থাকলেও তোমায় নত হয়ে নিজস্বতা খোয়াতে হচ্ছে, সোজা ফিরে আসবে। গর্ভে জায়গা দিতে পেরেছি, ভিটেতেও পারব।" যেটা অনেক চাকরি করা মা আজও মেয়েকে বলতে পারেন না, দ্বিধা করেন। সেই বাঁধা বুলিতেই আটকে থাকেন, "মানিয়ে নে, চেষ্টা কর।" টাচ উড, আমার পরিস্থিতি সেরকম নয়, কিন্তু হলে, আমার সাপোর্টে সবচেয়ে আগে যাকে পেতাম, তিনি আমার মা।
সংসারের বাইরে আমি আজও পড়াশোনায় থাকতে পারি, এটাও আমার মাকে দেখেই শেখা। আমাকে ssc পরীক্ষার জন্য প্রিপেয়ার করেছিলেন যখন, তখন বুঝেছিলাম মা কতটা আপডেটেড তার নিজের বিষয়ে। বিয়ের পর, চাকরি বাকরি পেয়ে গেলে পড়ার অভ্যাস চলে যায়, এটা আমি আমার সমসাময়িক মেয়েদের কাছে, আলোকপ্রাপ্ত আধুনিকা মেয়েদের কাছে শুনি, আর গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে আমার ,সেকেলে, চাকরি না করা, গৃহবধূ মায়ের জীবনযাপনের সঙ্গে মেলাই। যখন চাকরি করা মেয়েদেরও নিজের শর্তে বাঁচতে দ্বিধা দেখি, অন্য মেয়ের সমালোচনায় নীচে নামতে দেখি, বস্তাপচা ধ্যানধারণার কুয়োর মধ্যে, তখন আমার মায়ের মুখটা মনে পড়ে এর বিপরীতে।
সত্যি বলছি, আমি বুঝতে পারি না কে আধুনিক! পুরুষতন্ত্র মাড়িয়ে গিয়ে কে মুক্ত আসলে!
Comments
Post a Comment