তারা বাঈ

‘তারাবাঈ’


তারাবাঈ ছিলেন মহারাষ্ট্র-সূর্য ছত্রপতি শিবাজীর তেজস্বতী পুত্রবধূ; এবং গবেষকদের মতে, মধ্যযুগের মহারাষ্ট্রের রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে তাঁর মত অন্য কোন নারীই এত প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। শুধু তাই নয়, তাঁর জীবনের মত বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন সেযুগের খুব কম নারীরই ছিল।
শিবাজীর মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র শম্ভাজী মারাঠা-রাজ্যের সিংহাসনের অধিকারী হয়েছিলেন। যদিও তিনি কাপুরুষ ছিলেন না, বরং কখনও কখনও বীরত্বের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন, তাঁর হৃদয়ও উদার ছিল, এবং তিনি শিক্ষিতও ছিলেন, কিন্তু তবুও তাঁর চরিত্রে মেরুদণ্ড বলে কিছু ছিল না। আচার্য যদুনাথ সরকারের লেখা থেকে জানা যায় যে, তিনি তাঁর পিতার জীবদ্দশাতেই তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। আর তাঁর ন’বছরের কু-শাসনে দেশ বিশৃঙ্খলায় ভরে উঠেছিল, রাজকোষ প্রায় শূন্য হয়ে গিয়েছিল এবং মারাঠাদের রাষ্ট্রীয় শক্তি দিনে দিনে ক্ষয় পেতে শুরু করেছিল। মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব স্বয়ং তখন দাক্ষিণাত্যে অবস্থান করছিলেন, তাঁর বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা অধিকার-পর্ব তখন শেষ হয়ে গিয়েছিল, এবং এরপরে তিনি মারাঠা-রাজ্য ধ্বংস ও গ্রাস করতেও কৃতসঙ্কল্প হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ইতিমধ্যে মহারাষ্ট্রের কতগুলি গিরিদুর্গ মোঘল বাহিনী অধিকারও করে নিয়েছিল। ঠিক এমনই একসময়ে একদিন শম্ভাজী মোঘল সম্রাটের কোন এক সেনানায়কের হাতে বন্দী হয়েছিলেন, এবং এরপরে সম্রাটের আদেশে মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে অতি নিষ্ঠুরভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল।
বলাই বাহুল্য যে, শম্ভাজীর জীবনের এই শোচনীয় ও মর্মান্তিক পরিণতির পরে তখন মোঘলদের সঙ্গে মারাঠাদের সন্ধির কোন কথা ওঠা সম্ভব ছিল না, এবং ওঠেও নি। তাঁর স্ত্রী ও রাজ্য-প্রধানদের একটি মিলিত সভায় তখন ঠিক হয়েছিল যে, এরপরে শম্ভাজীর শিশুপুত্রই মারাঠা-রাজ্যের শাসক বলে বিবেচিত হবেন, কিন্তু আপাততঃ তাঁর কোন রাজ্যাভিষেক করা হবে না, এবং শম্ভাজীর বৈমাত্রেয় ভাই রাজারাম রাজপ্রতিনিধি হিসেবে শাসনকার্য চালিয়ে যাবেন ও যুদ্ধ-বিগ্রহে মারাঠাদের নেতৃত্ব দেবেন। এর আগে রাজারাম রায়গড় দুর্গে বন্দি অবস্থায় নিজের দিন কাটাচ্ছিলেন, শম্ভাজীই তাঁকে সেখানে বন্দি রেখেছিলেন। সেখান থেকে মুক্তিলাভ করবার পরে রাজানুগত্যের শপথ করে প্রথমেই প্রতাপগড়ে গিয়ে তিনি কুলদেবতা ভবানীর কাছে বরাভয় প্রার্থনা করেছিলেন, আর তারপরে নতুন উৎসাহে নিজের কৰ্মক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। অন্যদিকে শম্ভাজীর মৃত্যুতে ঔরঙ্গজেব যদিও তখন একথা ভেবে প্রায় আশ্বস্ত হয়ে গিয়েছিলেন যে, তাঁর দাক্ষিণাত্য বিজয় একপ্রকার সম্পন্নই হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তবুও মারাঠা রাজ্যের তৎকালীন রাজধানী রায়গড়ের পতন না হওয়া পর্যন্ত তিনি দিল্লী ফিরে যেতে পারছিলেন না। সুতরাং এরপরেই তিনি রায়গড়ের বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভিযান পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে শক্তিশালী মোঘল বাহিনীর পক্ষে এই সহজ ব্যাপারটা রীতিমত জটিল হয়ে উঠেছিল। কারণ, ঠিক এসময়েই একজন মারাঠা সেনা-নায়ক হাজার দুই সৈন্য নিয়ে গোধূলি-বেলায় যাত্রা করে পাহাড়ের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে এগিয়ে এসে গভীর রাতে তুলাপুর নামক জায়গায় স্বয়ং মোঘল সম্রাটের শিবিরের উপরে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন ভাগ্য ঔরঙ্গজেবের উপরে সুপ্রসন্ন ছিল বলে, তিনি নিজের শিবিরে না থেকে অন্যত্র বিশ্রাম করছিলেন বলে এই আক্রমণ থেকে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। এরফলে যদিও মারাঠাদের এই নৈশ অভিযানের আসল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তবুও এই ঘটনা তখন সমগ্র মারাঠা জাতির মধ্যে নিবিড় উৎসাহ ও আস্থার সঞ্চার করেছিল। ওদিকে মোঘল বাহিনীর হাতে রায়গড়ের পতন হতে দেরি হয়নি, এবং শম্ভাজীর স্ত্রী ও ন’বছর বয়সী পুত্র সাহু মোঘলদের হাতে বন্দি হয়ে সম্রাটের শিবিরে প্রেরিত হয়েছিলেন। রাজারাম তখন পানহালা দুর্গে অবস্থান করছিলেন। আর এরপরে যখন পানহালাও মোঘল বাহিনীর হাতে আক্রান্ত হয়েছিল, রাজারাম তখন প্রথমে বিশালগড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, এবং তারপরে সেই জায়গাও নিরাপদ নয় বুঝতে পেরে মহারাষ্ট্র ত্যাগ করে দক্ষিণ-ভারতের পূর্বউপকূলের পণ্ডিচেরীর কিছু পশ্চিমে অবস্থিত জিঞ্জিতে গিয়ে সেখানেই মারাঠা-রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। ঔরঙ্গজেব আশা করেছিলেন যে, সাহু তাঁর শিবিরে বন্দি হওয়ার ফলে মারাঠা-শক্তি খণ্ডিত হয়ে পড়বে, কিন্তু বাস্তবে সেটা ঘটেনি। বাস্তবে মারাঠারা তখন শিবাজীর আদর্শকে নিজেদের সামনে তুলে ধরে স্বদেশের জন্য জীবনপণ করে আরও অতুলনীয় পরাক্রমে মোঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ন হয়েছিলেন। এসময়ে মারাঠা নায়ক রামচন্দ্র বাবড়েকর, সান্তাজী ঘোরপড়ে, ধনাজী যাদব প্রমুখ যুদ্ধ বিশারদদের নেতৃত্বে মারাঠারা কখনও সম্মুখ সমরে, তো কখনও আবার গিরিদুর্গগুলিতে আত্মগোপন করে মোঘল বাহিনীকে যত্রতত্র বিব্রত ও বিপন্ন করে তুলেছিলেন। শুধু তাই নয়, মোঘলদের অধিকৃত কতগুলি গিরিদুর্গও তাঁরা পুনরায় অধিকার করে নিয়েছিলেন। অন্যদিকে মোঘলরাও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিলেন না। এরফলে কিছুদিন পরেই দীর্ঘ অবরোধ ও দীর্ঘ প্রতিরোধের পরেই জিঞ্জি দুর্গের পতন হয়েছিল, এবং রাজারাম তখন একজন ব্যাধের ছদ্মবেশে কোনক্রমে সেখান থেকে পালিয়ে অবশেষে মহারাষ্ট্রে পৌঁছেছিলেন। যদিও জিঞ্জির পতনে রাজারামের বিস্তর ক্ষতি হয়েছিল, সেখানকার রাজকোষে সঞ্চিত বহু ধনরত্ন তাঁর হস্তচ্যুত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তবুও এই পরাজয়ের গ্লানি তখন মারাঠা-জাতিকে একটুও অভিভূত করতে পারেনি। জলের উপরে আঘাতের দাগের মতোই মারাঠাদের এই পরাজয়ের দাগ সাময়িকমাত্র হওয়ার ফলে মিলিয়ে যেতে দেরি হয়নি। এধরণের শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করা যে, বিড়ম্বনামাত্র—একথাটা তখন সম্রাট ঔরঙ্গজেবের বুঝতেও দেরি হয়নি। অথচ মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধি করে দাক্ষিণাত্য অভিযান সমাপ্ত করে দিল্লী ফিরে যাওয়াও তখন তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না।
এরপরে ১৭০০ সালে বেরার অভিযানের সময়ে কোন এক যুদ্ধক্ষেত্রে রাজারাম অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, এবং এই অসুস্থতাই পরিশেষে তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর এক বালক পুত্রকে মারাঠা রাজ্যের শাসক বলে ঘোষণা করা হলেও, মাত্র তিনসপ্তাহ রাজত্ব করবার পরেই তিনিও বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণত্যাগ করেছিলেন। আর ঠিক এসময়েই মহারাষ্ট্রের রাজনীতি-ক্ষেত্রে রাজারামের প্রধানা স্ত্রী তারাবাঈয়ের আবির্ভাব ঘটেছিল। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, রায়গড়ের দুর্গে রাজারাম যখন বন্দি ছিলেন, তখন তারাবাঈ ও তাঁর সপত্নী রাজসবাঈও সেই একই দুর্গে অবস্থান করছিলেন। নিজের বন্দিদশা মোচনের পরে রাজারাম যখন রায়গড় থেকে প্রতাপগড়ের ভবানী-মন্দিরে গিয়েছিলেন, তখন এঁরা দু’জনেই তাঁর সঙ্গে ছিলেন। পরবর্তীসময়ে জিঞ্জি দুর্গের পতনের পরে তাঁরা আবার কোনক্রমে পশ্চিম-উপকূলে গিয়ে রাজারামের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। বর্তমানে এবিষয়ে কোন বিতর্ক নেই যে, সেযুগের নিরিখে তারাবাঈ এক অদ্ভুত নারী ছিলেন। নিজের স্বামীর জীবদ্দশাতেই তিনি প্রখর বুদ্ধিমত্তার ও পুরুষোচিত তেজের অসংখ্য পরিচয় দিয়েছিলেন, এবং এসব যোগ্যতার জন্যই মারাঠা শাসনক্ষমতার অনেকটাই নিজের হাতে ধরে রাখতে পেরেছিলেন। একইরকমভাবে স্বামীর মৃত্যুর পরে তিনি নিজের নাবালক পুত্রকে সামনে রেখে সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন একাজে তাঁকে তাঁর সপত্নী রাজসবাঈ প্রথম বাধা দিয়েছিলেন। কারণ, রাজসবাঈয়ের মনেও তাঁর পুত্রের ও নিজের জন্য অনুরূপ বাসনা একইপরিমাণে ছিল। কিন্তু ক্ষমতা ও সামর্থ্যর দিক থেকে রাজসবাঈ কখনোই তারাবাঈয়ের নাগাল পাননি। তারাবাঈ অচিরেই তাঁর ন’বছরের শিশুপুত্র দ্বিতীয় শিবাজীর পক্ষে শাসন-পরিষদের একটি সভা আহ্বান করে তাঁকে মহারাষ্ট্রের শাসক বলে স্বীকার করে নেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। গবেষকদের মতে, তাঁর এই প্রস্তারটি অনুরোধের হলেও স্বর কিন্তু অনুজ্ঞার ছিল। সেসময়ে দু’-একজন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেও তারাবাঈর তেজস্বিতার খরস্রোতে তাঁদের এই প্রতিবাদ খড়কুটোর মতোই ভেসে গিয়েছিল। এসময়ে নিজের পুত্রকে মহারাষ্ট্রের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করবার জন্য তাঁর জেদ কঠিনতর মূর্তি ধারণ করেছিল। তিনি সবাইকে উপলব্ধি করাতে চেয়েছিলেন যে, ইনিই হলেন সেই শিবাজী যাঁর সম্বন্ধে তখন পাঞ্জাব থেকে রামেশ্বর-সেতুবন্ধ পর্যন্ত বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী শোনা গিয়েছিল। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, সেযুগের মারাঠা জনশ্রুতি অনুযায়ী একদা দেবী ভবানী নাকি ছত্রপতি শিবাজীর কাছে তাঁর নামধেয় কোনও বংশধরকে উদ্দেশ্য করে এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তখনকার মারাঠারামাত্রেই একথা জানতেন, এবং এই পুরুষের আগমন প্রতীক্ষায় উদ্‌গ্রীব ছিলেন। ইতিমধ্যে তারাবাঈ মারাঠা মন্ত্রিমণ্ডলীর মধ্যে কাউকে কাউকে অপসারিত করে সেই জায়গায় নিজের আস্থাভাজন ব্যক্তিকে বসিয়ে দিয়েছিলেন। এরফলে অন্যান্যরা তাঁকে আর বাধা দিতে ভরসা পাননি। অবশেষে ১৭০১ সালের শুরুর দিকে পানহালায় মহাসমারোহে তারাবাঈয়ের পুত্র দ্বিতীয় শিবাজীর অভিষেকক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল। আর এরপরে তারাবাঈ প্রথমেই রাজসবাঈ ও তাঁর পুত্রকে কারারুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু তবুও তাঁর মনের ভয় দূর হয়নি, এবং সমস্যাকীর্ণ জীবনের সূচনায় বিভক্ত মারাঠা-শক্তির উপরে তিনি সম্পূর্ণভাবে নিজের আস্থা স্থাপন করতে পারেননি। এরপরে একারণেই তিনি কয়েকটি শর্তে ঔরঙ্গজেবের কাছে বশ্যতামূলক সন্ধির প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এর বিনিময়ে মোঘল সম্রাট মারাঠাদের অধিকারে থাকা সমস্ত দুর্গগুলি দাবি করবার ফলে এই প্রস্তাবটি আর এগোতে পারেনি। এরফলে মোঘল সম্রাটের বিজয় অভিযান অব্যাহত থেকে গিয়েছিল, এবং শম্ভাজীর মৃত্যুর আগে ও পরে মহারাষ্ট্রের যে দুর্দিনের সূত্রপাত ঘটেছিল, রাজারামের মৃত্যুর আগে ও পরে মারাঠা জাতির উপরে সেই দুর্দিনের মেঘ আরও ঘন হয়েছিল। ১৭০৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে তো মারাঠাদের প্রধান প্রধান গিরিদুর্গগুলির সবই মোঘলদের হাতে চলে গিয়েছিল। বিশালগড়, পানহালা, সিংহগড়, তোরণা—এসব বিখ্যাত দুর্গ তখন মোঘলরা মারাঠাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন।
কিন্তু অন্যদিকে এসবের মধ্যেও তারাবাঈও ততদিনে পরিপাটি করে নিজের ঘর গুছিয়ে নিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে তিনি মহারাষ্ট্রের শাসকের অভিভাবিকা এবং সাধারণ মানুষ ও সাধারণচিত্তের একাধিনায়িকা হয়ে উঠেছিলেন। এসময়ে প্রায় সমস্ত কিছুর বিধি-ব্যবস্থা ও নিয়ন্ত্রণ-ভার তাঁরই হাতে ছিল। মারাঠা সেনাপতি ও অন্যান্য রাজপুরুষদের বিভিন্ন রাজকীয় পদে নিয়োগ ও পরিবর্তন তখন তাঁরই ইচ্ছা ও অনিচ্ছা, অনুরাগ ও বিরাগ সাপেক্ষ ছিল। এসময়ে তাঁর বয়স তিরিশ বছরের কাছাকাছি ছিল। তবে যে ক্ষমতা তিনি চেয়েছিলেন, সেই ক্ষমতা হাতে পেয়ে নিজের চাওয়ার যৌক্তিকতাকে সর্বতোভাবে প্রতিপন্নও করতে পেরেছিলেন। তারাবাঈ শুধু শিবাজীর পুত্রবধূ ছিলেন, তিনি শিবাজীর সমকালীন বীর যোদ্ধা হম্বীররাও মোহিতের কন্যাও ছিলেন। ক্রমশঃ তারাবাঈয়ের অদ্ভুত সামরিক প্রতিভাও দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। ফলে সময় ও সুযোগ বুঝে মোঘলদের উপরে মারাঠাদের পাল্টা আক্রমণ আরম্ভ হয়েছিল, এবং দেখতে দেখতে এই আক্রমণ মোঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে কাঁপিয়ে তুলেছিল। এসময়ে মারাঠাদের হাতে আক্রান্ত জায়গাগুলিতে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা মোঘলদের ছিল না; কারণ, ইতিমধ্যে সম্রাট তাঁর দাক্ষিণাত্য বিজয়কে স্থির ও চির বলে কল্পনা করে নিয়ে নিজের বাদশাহী ফৌজকে সমৃদ্ধ করবার অভিলাষে এসব জায়গা থেকে অধিকাংশ সৈন্যই অপসারিত করে দিয়েছিলেন। এছাড়া অবশিষ্ট মুষ্টিমেয় সৈন্যদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য বিদ্রোহের আশঙ্কায় স্থানীয় ভূস্বামীদের অস্ত্রশস্ত্রও তিনি কেড়ে নিয়েছিলেন। যারফলে মারাঠাদের তখন মোঘলদের দিক থেকে কোন ধরণের সংহত প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়নি। তাঁরা তখন শুধুমাত্র আক্রমণনীতি পরিহার করেছিলেন, এবং যেসব জায়গার ভিতরে তাঁরা ঢুকতে পেরেছিলেন, সেখানে সেখানে রাজস্ব সংগ্রহ করবার সুবন্দোবস্ত করে নিজেদের পাকাপাকি শাসনবিধিও প্রবর্তন করতে শুরু করেছিলেন। এরপরে ১৭০৫ সালে দুটি বিশাল মারাঠা-বাহিনী দু’জন সেনানীর অধীনে এগিয়ে যুগপৎ নর্মদা নদী অতিক্রম করেছিল। এরমধ্যে একটি বাহিনী তখন মধ্যপ্রদেশের ভূপালের মাইল পঞ্চাশেক উত্তর পর্যন্ত গিয়ে লুঠতরাজ করে মালবভূমির অনেকটা ছারখার করে দিয়েছিল; আর অন্য বাহিনীটি গুজরাটে ঢুকে মোঘল সম্রাটের একটি বিশাল সেনাদলকে পরাভূত করে গুজরাট থেকে আহমেদাবাদ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগ থেকে লুণ্ঠন-লব্ধ ধনের পাহাড় নিয়ে পুনরায় মহারাষ্ট্রে প্রত্যাবর্তন করেছিল। বলাই বাহুল্য যে, তখন এই ধারাবাহিক বিপর্যয়ের ধাক্কায় মোঘল সম্রাটের সেনাবাহিনীর মনোবল অনেকটাই ভেঙে গিয়েছিল, যারফলে তাঁদের মধ্যে শ্লথতা, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাশ্যের ম্রিয়মাণ কুঞ্ঝটিকা দেখা দিয়েছিল। অন্যদিকে এসময়ে মারাঠাপক্ষে সাফল্য-পরম্পরাজাত আত্মপ্রত্যয় দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। এভাবে বৃদ্ধ মোঘল সম্রাট এসময় থেকে মারাঠাদের বাধা দেওয়ার শক্তি যতই হারিয়েছিলেন, তাঁর মনে মারাঠাদের নিয়ে ততই ঘৃণার উদ্রেক ঘটেছিল। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, এসময় প্রতি শুক্রবার মোঘল বাহিনীর সৈন্যরা তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করে যে প্রার্থনা করতেন, বিজয়োদ্ধত মারাঠা নায়করা সেটারই বিদ্রূপাত্মক অনুকরণে নিজেদের সৈন্যদের আদেশ দিয়েছিলেন যে, তাঁরাও যেন প্রতি শুক্রবার ঈশ্বরের কাছে সম্রাটের অনন্ত পরমায়ু প্রার্থনা করেন এবং যেন এই ঘৃণার জ্বালায় তাঁর মন অনন্তকাল ধরে পুড়তে থাকে! নিরুপায় ঔরঙ্গজেব তখন মহারাষ্ট্র-বহির্ভূত দক্ষিণ-ভারতের অন্য দু’-একটি জায়গা জয় করবার বিষয়ে মনোনিবেশ করেছিলেন।
এসময়ে তারাবাঈ এই পরিপূর্ণ সুযোগের সবটুকুই দু’হাতে গ্রহণ করেছিলেন। ফলে একে একে আবার সব মারাঠা দুর্গের অধিকার তাঁর হাতে ফিরে এসেছিল। এরপরেই মোঘল সম্রাট নিদারুণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, এবং দিন কয়েক তাঁকে জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিস্থলে কাটাতে হয়েছিল। আর তারপরে মহারাষ্ট্র জয়ের আশা ত্যাগ করে তিনি যখন নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে নিরাপদে দিল্লীতে প্রত্যাবর্তন করবার চেষ্টায় ছিলেন, ঠিক তখনই আহমদনগর অভিমুখে অপসরণরত বাদশাহী বাহিনীর পিছনদিকে মারাঠারা আক্রমণ চালিয়েছিলেন। এরফলে বহু সৈন্য নিহত হয়েছিলেন এবং অনেকে পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছিলেন। শুধু তাই নয়, এসময়ে ঔরঙ্গজেবের নিজস্ব মালপত্রবাহী শকটগুলিও লুণ্ঠিত হয়েছিল। এমনকি, অনেকের মতে, এসময়ে মারাঠা বাহিনীর দায়িত্বে থাকা ধনাজী যাদব যদি আরেকটু সাহস করে কিছুটা এগোতে পারতেন, তাহলে তিনি সশরীরে মোঘল সম্রাটকে বন্দি করতেও পারতেন। যদিও এসময়ে তিনি সম্রাটের দেহরক্ষীদের কাছ পর্যন্ত পথ করে নিয়েছিলেন, কিন্তু সম্রাটের একান্ত সান্নিধ্য ও তাঁর রাজপ্রতাপের অত জাঁকজমকে একাজ শেষপর্যন্ত ধনাজীর সাহসে আর কুলোয়নি। এই ঘটনার পরে আহমদনগরের যে দুর্গে ঔরঙ্গজেব আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেসময় থেকে একুশ বছর আগে দিল্লী থেকে এসে সেখানেই প্রথম তিনি তাঁর শিবিরটি স্থাপন করেছিলেন। আর অবশেষে সেখানেই ১৭০৭ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি তারিখে ৮৯ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।
আর এরপরেই তারাবাঈ মারাঠা গৌরবের শৃঙ্গে উঠে গিয়েছিলেন। স্বয়ং মোঘল সম্রাটের বিরুদ্ধে লড়ে তিনি বিজয়িনী হয়েছিলেন এবং মোঘলদের বিরুদ্ধে এই দু’বছরের অপূর্ব সাফল্য তাঁর মাথায় তখন শুভ্র জয়টীকা এঁকে দিয়েছিল। কিন্তু নিজের এই অবস্থান তিনি বেশিদিন ধরে রাখতে পারেননি; কারণ, এরপরেই তাঁর জীবনে যে নতুন অধ্যায়ের শুরু হয়েছিল, সেটা ছিল তাঁর পতনের অধ্যায়। তবে তারাবাঈয়ের এই পতন আচমকা হয়নি, বরং ধীরে ধীরে সম্পন্ন হয়েছিল। পরবর্তী সাত বছরের মধ্যে মারাঠা রাজনীতিতে তিনি এমন এক অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিলেন, যেখান থেকে তাঁর পক্ষে আর কোনদিনই উপরে যথা সম্ভব হয়নি। বহিঃশত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে তারাবাঈ বিজয়িনী হলেও এরপরেই ক্ষমতার দখল নিয়ে মারাঠাদের মধ্যে যে অন্তর্যুদ্ধ বা ঘরোয়া যুদ্ধ বা জ্ঞাতিবিরোধ শুরু হয়েছিল, সেযুদ্ধে তিনি বারবার পরাজিত হয়েছিলেন। এমনকি এক্ষেত্রে তাঁর বুদ্ধি ও প্রতিভার দীপ্তি কোন কাজে তো লাগেই নি, বরং তাঁর ক্ষমতা-লোলুপতা সবসীমা ছাড়িয়ে গিয়ে তাঁর বুদ্ধিকে এতটাই ভ্রংশ করে দিয়েছিল যে, তিনি অন্ধের মত পথ থেকে বিপথে চালিত হয়েছিলেন।
ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরে শম্ভাজীর পুত্র সাহু বন্দিদশা থেকে মুক্তিলাভ করে মহারাষ্ট্র অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছিলেন, এবং ঠিক একইসময়ে রাজসবাঈও কারাপ্রাচীরের মধ্যে বন্দি থেকেও তলে তলে নিজের পুত্রের জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। এসময়ে মারাঠা দলপতিদের মধ্যে অনেকেই এই দুই বিধবার অন্তর্যুদ্ধকে বন্ধ করবার জন্য সাহুকেই শাসনক্ষমতায় বসাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারাবাঈ তাঁদের পরিষ্কার করেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, শম্ভাজীর পরে তখনকার মারাঠা-রাজ্য যেহেতু রাজারামের সৃষ্টি, সেহেতু এতে সাহুর কোন দাবি গ্রাহ্য হবে না। শুধু সেটাই নয়, এরপরে একদিন তারাবাঈ পরমান্ন গ্রহণ করে তাঁর পুত্রের প্রতি আনুগত্যের শপথ নেওয়ার জন্য সব মারাঠা-প্রধানকে আদেশ করলেও, তখন শুধুমাত্র তিনজন ছাড়া অন্য কেউই সেই পরমান্ন গ্রহণ করেননি। বস্তুতঃ এদিন থেকেই মারাঠা রাজনীতিতে তারাবাঈয়ের পতনের পথ আরও সুগম হয়ে গিয়েছিল। আর এরপরেই পুনার অদূরে অবস্থিত খেড় নামক একটি জায়গায় হওয়া যুদ্ধে তারাবাঈয়ের বিরাট বাহিনী সাহুর কাছে পরাজিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে জয়লাভ করবার পরে সাহু সাতারাকে মারাঠা রাজ্যের রাজধানী বলে ঘোষণা করে নিজেকে মারাঠা শাসক বলে ঘোষণা জারি করে দিয়েছিলেন। অন্যদিকে তৎকালীন মারাঠা জাতিও এসময় থেকে সাহুর পিছনেই সমবেত হতে শুরু করেছিল। তারপরে মারাঠাদের মধ্যে গৃহবিবাদের কলঙ্কের অবসান ঘটানোর জন্য সাহু তারাবাঈকে কিছু উদার শর্তাবলী দিয়ে একটা আপোষ করতে চাইলেও তারাবাঈ তাঁর চরিত্রানুযায়ী কোন আপোষ করতে রাজি হননি। বরং এসময়ে তাঁর কাছে অর্থবল ও সৈন্যবল—উভয়েরই অনটন থাকা সত্ত্বেও, এর আগে থেকেই যে কৌশল ও কূটবুদ্ধির উপরে তাঁর অসামান্য অধিকার ছিল, তখন সেসবের উপরে নির্ভর করেই তিনি সাহুর বিরুদ্ধে লড়াই করাই বেশি সম্মানের বলে মনে করেছিলেন। এরফলস্বরূপ এসময়ে উভয় বাহিনীর মধ্যে পরপর কয়েকটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল এবং কিছুদিন পালা করে উভয়পক্ষের জয় ও পরাজয়ের পরে তারাবাঈ কোলহাপুরকে তাঁর পুত্রের রাজধানী বলে ঘোষণা করেছিলেন। এভাবেই তখনকার মারাঠা রাজ্য শেষপর্যন্ত দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। তবে এরপরেও মারাঠাদের গৃহযুদ্ধ বন্ধ হয়নি। শেষে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, যখন এই যুদ্ধে সাহুর অবস্থা বেশ টলমল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারাবাঈ শেষপর্যন্ত শেষরক্ষা করতে পারেননি। অর্থের অভাব এবং তাঁর অনুসারীদের মধ্যেকার অন্তর্দ্বন্দ্ব শেষ অবধি সাহুকেই জয়ী হতে সাহায্য করেছিল। ইতিমধ্যে রাজসবাঈও সাহুর সাথে হাত মিলিয়েছিলেন। আর এরফলে অবশেষে ১৭১৪ সালে তারাবাঈ রাজসবাঈয়ের হাতে বন্দিনী হয়ে পানহালা দুর্গে অবরুদ্ধা হয়েছিলেন এবং মারাঠা রাজনীতিতে তাঁর পতন সম্পূর্ণ হয়েছিল।
পরবর্তী সতেরো বছর ধরে তারাবাঈ সেই কারাপ্রাচীরের অন্তরালেই ছিলেন। এরপরে রাজসবাঈয়ের পুত্রের সঙ্গে সাহুর বাহিনীর একটি সংঘর্ষ ঘটলে পানহালা থেকে তারাবাঈ ও রাজসবাঈ—উভয়কেই বন্দি করে সাহুর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সাহু তখন সসম্মানে রাজসবাঈকে পুনরায় পানহালায় ফেরত পাঠিয়ে দিলেও তারাবাঈ কিন্তু আর পানহালায় ফিরে যেতে রাজি হননি। বরং তিনি সাহুর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন যে, তাঁকে যেন সাতারার কারাগারেই বন্দি রাখা হয়। তবে সাহু তাঁকে কোন কারাগারে বন্দি করেননি। বরং এসময়ে তাঁর নির্দেশে সাতারার দুর্গের ভিতরেই একটি পুরোনো প্রাসাদকে সংস্কার করে সেখানেই তাঁর থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বলাই বাহুল্য যে, এখানে তিনি একজন বন্দিনীর মত ছিলেন না; কিন্তু পার্থক্য এটাই ছিল যে, এটি তাঁর নিজের প্রাসাদ ছিল না। যাই হোক, এখানেই তারাবাঈ তাঁর পরবর্তী জীবনের আঠারো বছর কাটিয়ে দিয়েছিলেন। আর এখানেই তিনি যখন অবশেষে পঁচাত্তর বছর বয়সে পদার্পন করেছিলেন, ঠিক তখনই একদিন শুনতে পেয়েছিলেন যে, নিঃসন্তান সাহু নিজের উত্তরাধিকার রক্ষা করবার জন্য একটি পোষ্যপুত্র গ্রহণের উদ্যোগ করছেন। আর এরপরেই তারাবাঈ হঠাৎই সাহুকে এই সংবাদ দিয়েছিলেন যে, তাঁর মৃত পুত্র দ্বিতীয় শিবাজীর রামরাজা নামের তেইশ বছর বয়সী একটি পুত্র রয়েছে, যাঁকে রাজসবাঈয়ের পুত্রের ও তাঁর স্ত্রীর অত্যাচারের ভয়ে অতি শৈশবেই গোপনে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এবং তিনি তখন তাঁর বোনের কাছে একটি গ্রামে বাস করছিলেন। এই সংবাদ দেওয়ার পরে তারাবাঈ সাহুকে বুঝিয়েছিলেন যে, ছত্রপতির বংশগত উত্তরাধিকারী বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও অন্য কারো পুত্রকে পোষ্যপুত্র বলে স্বীকার করে নিয়ে তাঁরা হাতে মারাঠাদের উত্তরাধিকার তুলে দেওয়া উচিত নয়। যদিও সাহু তখন তারাবাঈয়ের কথায় বিশ্বাস করেননি, কিন্তু পরে জনৈক ধর্মভীরু এক ব্যক্তির সাক্ষ্যে ও শপথে তাঁকে একথা বিশ্বাস করতেই হয়েছিল। এরপরে সাহু দত্তকপুত্র নেওয়ার জন্য নিজের উদ্যোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং এর কিছুদিন পরেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। এসময়ে বালাজী বিশ্বনাথের পুত্র বালাজী বাজীরাও পেশোয়া পদে আসীন ছিলেন এবং তিনিই মারাঠা রাজ্যের প্রায় সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। ফলে সাহুর মৃত্যুর পরদিন সকালেই সেই গ্রাম থেকে রামরাজাকে রাজকীয় জমকে রাজধানীতে নিয়ে আসবার জন্য রাজকীয়বহর পাঠানো হয়েছিল এবং একইসাথে তারাবাঈকেও মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। প্রফুল্লিতা তারাবাঈ তখন কৃষ্ণানদীর তীর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে রামরাজার সঙ্গে মিলিতা হয়েছিলেন, এবং প্রকাশ্যে নিজের পৌত্রকে আলিঙ্গন করেছিলেন। এমনকি এরপরে তিনি তাঁর সঙ্গে পান-ভোজন করে মারাঠা সর্দারদের মনে এবিষয়ে কোন সংশয়ই থাকিতে দেননি যে, রামরাজা সত্যিই তাঁর পৌত্র।
কিন্তু এরপরেই ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিয়েছিল। সাতারায় পৌঁছে রামরাজা মারাঠা শাসক হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই দুঃখ ও বিরক্তির সঙ্গে তারাবাঈ আবিষ্কার করেছিলেন যে, তাঁর পৌত্র শাসন-ব্যাপারে তাঁর কোন কর্তৃত্ব মানতে রাজি নন; বরং তিনি পেশোয়ার হাতের পুতুলে পরিণত হয়ে গিয়েছেন। এরফলে ক্রমে তাঁদের মধ্যেকার সম্পর্কটা শত্রুতায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল, এবং তারাবাঈ রামরাজাকে কুৎসিত ভাষায় গালাগালি করতে আরম্ভ করেছিলেন। আর এসময় থেকেই তারাবাঈ ও পেশোয়ার মধ্যে শাসনক্ষমতা নিয়ে পুনরায় মারাঠা অন্তর্বিবাদের সৃষ্টি হয়েছিল। এরফলে তারাবাঈ পেশোয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আরম্ভ করে দিয়েছিলেন, এবং রামরাজাকে কিছুতেই আয়ত্তের মধ্যে আনতে না পেরে, সবাইকে চমকে দিয়ে একদিন নিজের মুখেই ঘোষণা করেছিলেন যে, রামরাজা তাঁর পৌত্র নন—তিনি একজন প্রবঞ্চকমাত্র! এর কিছুদিন পরে—চম্পাষষ্ঠীর উৎসবের দিন সকালে তারাবাঈ নিজের একজন অনুচরকে রামরাজাকে সারাদিন তাঁর সঙ্গে সাতারার দুর্গের মধ্যে তাঁর প্রাসাদে সময় কাটাবার নিমন্ত্রণ করবার জন্য পাঠিয়েছিলেন। যদিও তখন রামরাজার পক্ষের দু’-একজন তাঁকে এই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু তবুও তখন তারাবাঈয়ের এই অনুচরের বাকচাতুর্য্যে অভিভূত হয়ে রামরাজা শেষপর্যন্ত নিজের পিতামহীর নিমন্ত্রণ স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তারপরে তিনি একাই দুর্গে পৌঁছানোর পরে তারাবাঈ তাঁকে প্রচুর আদর-আপ্যায়ন করেছিলেন এবং যত্ন করিয়ে খাইয়েছিলেন। কিন্তু এরপরে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রামরাজা দুর্গের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেখতে পেয়েছিলেন যে, দরজা বন্ধ! ততক্ষণ তিনি দুর্গ প্রহরীদের দরজা খুলে দিতে বললে তাঁরা তাঁকে জানিয়েছিলেন যে, তারাবাঈ তাঁকে দুর্গের বাইরে বের হতে না দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন। এরপরে তিনি পুনরায় তারাবাঈয়ের প্রাসাদে ফিরে তাঁর খোঁজ করলেও তাঁর সন্ধান তো পানইনি, বরং কিছু মারাঠা সৈন্যকে পেয়েছিলেন, যাঁরা তৎক্ষণাৎ তাঁকে বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিল এবং সেখানেই তাঁকে নিজের অবশিষ্ট জীবন কাটাতে হয়েছিল। এভাবে প্রায় আটষট্টি বছর ধরে রামরাজা ও তাঁর বংশধরেরা সাতারার দুর্গে বন্দি থাকবার পরে শেষপর্যন্ত ইংরেজরা মহারাষ্ট্র অধিকার করবার পরে তাঁদের মুক্তি দিয়েছিলেন। আর এভাবেই শেষপর্যন্ত শিবাজীর বংশের ক্ষমতা ও গৌরব লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
অন্যদিকে রামরাজাকে বন্দি করে তারাবাঈ তখন নিজের হাতে মারাঠা রাজ্যের শাসনভার তুলে নিলেও, জন্মগত ব্যাপারে নিরপরাধ রামরাজাকে কারারুদ্ধ করবার জন্য তৎকালীন মহারাষ্ট্রের জনমত তারাবাঈয়ের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল, এবং তাঁর নিন্দা ও অখ্যাতিতে সারা দেশ সরব হয়ে উঠেছিল। তবে এই ঘটনার বছরখানেক পরে তাঁর মধ্যে সুবুদ্ধির উদয় ঘটলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, পেশোয়ার সঙ্গে সন্ধি করা ছাড়া তাঁর সামনে অন্য কোন পথ খোলা নেই। আর তাই এরপরে পেশোয়া ও তারাবাঈয়ের মধ্যে একটি চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছিল। আর তারপর থেকে যতই দিন এগিয়েছিল, পেশোয়ার সঙ্গে তারাবাঈয়ের সম্পর্ক ততই হৃদ্য হয়েছিল। অবশেষে ১৭৬১ সালের ডিসেম্বর মাসে সাতাশি বছর বয়সে সাতরাতেই তারাবাঈয়ের মৃত্যু হয়েছিল।

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ