রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি বিখ্যাত ছোটগল্প রচনার পেছনের ঘটনা!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্পকার। বাংলা ভাষায় ছোটগল্প তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর দেখানো পথেই পরবর্তী লেখকগণ হেঁটেছেন বা চেষ্টা করেছেন। এখানে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি বিখ্যাত ছোটগল্প রচনার পেছনের ঘটনা তুলে ধরা হলো-
১. পোস্টমাস্টার
রবি ঠাকুরের অতি জনপ্রিয় একটি ছোটগল্প ‘পোস্টমাস্টার’। আপনারা অনেকেই জানেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে তাঁর একটি কাচারি বাড়ি ছিল। এই কাচারি বাড়ির একতলাতে একটা পোস্ট অফিস ছিল। সেখানকার পোস্টমাস্টার মহাশয়ের সাথে রবি ঠাকুরের প্রায় প্রতিদিন দেখা হতো এবং তাদের মধ্যে অনেক কথাবার্তা, গল্প-গুজব হতো। কবিগুরু প্রায় প্রতিদিন দিনের বা রাতের কোনো একটা সময় পোস্টমাস্টার সাহেবের সাথে কাটাতেন। মূলত এই পোস্টমাস্টার মহাশয়ের জীবনের নানা কাহিনি অবলম্বনেই তিনি এই গল্পটি লেখেন।
২. কংকাল
ছোটবেলায় কবি যে ঘরে শুতেন সেখানে একটা মেয়ে মানুষের skeleton ঝুলানো ছিল। সে সময় তাঁর তেমন একটা ভয়-টয় করত না। পরিণত বয়সে একদিন বাড়িতে অতিথি সমাগম হওয়াতে তাকে বাইরে শোবার দরকার পড়েছিল। অনেকদিন পরে সেই ঘরে তিনি আবার শুয়েছেন। শুয়ে তাঁর মনে হতে লাগল, সেজের আলোটা ক্রমে কাঁপতে কাঁপতে নিভে গেল। তাঁর আরও মনে হতে লাগল, কে যেন মশারির চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বলছে ‘আমার কংকালটা কোথায় গেল’, ‘আমার কংকালটা কোথায় গেল’? ক্রমে মনে হতে লাগল সে দেয়াল হাতড়ে বন বন করে ঘুরতে আরম্ভ করেছে। এভাবেই তাঁর মাথায় এসে গেল এই ‘কংকাল’ গল্পটা।
৩. জীবিত ও মৃত
কবিগুরুর ভোররাতে উঠে অন্ধকার ছাদে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস ছিল। তেমনি একদিন রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে যেতেই তিনি উঠে পড়লেন, ভেবেছিলেন উঠার সময় হয়েছে, আসলে তখন গভীর রাত। অভ্যাশবসত তিনি হাঁটতে লাগলেন। সব ঘরের দরজা বন্ধ। সব একেবারে নিরব, নিঝুম। খানিক পড়েই ঢং ঢং করে দুটো বাজার ঘণ্টা পড়ল। তিনি থমকে দাঁড়ালেন, ভাবলেন- তাই তো, এই গভীররাত্রে আমি সারা বাড়িময় এমন করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। হঠাত তাঁর মনে হল তিনি যেন প্রেতাত্বা, এ বাড়ি হান্ট করে বেড়াচ্ছেন। তিনি যেন মোটেই তিনি নন, তাঁর রুপ ধরে বেড়াচ্ছেন মাত্র। এই আইডিটাই তাকে পেয়ে বসল, যেন একজন জীবিত মানুষ সত্যসত্যই নিজেকে মৃত বলে মনে করছে। এভাবেই ’জীবিত ও মৃত’ গল্পের সৃষ্টি।
৪. ক্ষুধিত পাষাণ
কবির মতে, ‘ক্ষুধিত পাষাণের কল্পনা কল্পলোক থেকে আমদানি’। তবে তাঁর এই কল্পনার পেছনেও একটি কাহিনি আছে। কবি বিলেত যাওয়ার আগে তাঁর মেঝদাদার কর্মস্থল আহমেদাবাদ গিয়েছিলেন। তাঁর বড় ভাই জজিয়তি করতেন। আহমেদাবাদের জজের বাসা ছিল শাহিবাগে, বাদশাহী আমলের রাজবাড়িতে। দিনের বেলায় তাঁর মেঝদাদা চলে যেতেন কাজে, তখন তাঁর মনে হতো, বড়ো বড়ো ফাঁকা ঘর হাঁ হাঁ করছে, সমস্ত দিন ভূতে পাওয়ার মতো ঘুরে বেড়াতেন তিনি। বাড়ির সামনে প্রকাণ্ড চাতাল, সেখান থেকে দেখা যেত সাবরমতি নদী (গল্পের ‘শুস্তা’ নদী)। তাঁর মতে, কোলকাতার মানুষ হিসেবে ইতিহাসের মাথা তোলা চেহারা কোথাও তিনি দেখেননি। আহমেদাবাদ এসে তিনি প্রথম দেখলেন চলতি ইতিহাস থেমে গিয়েছে, দেখা যাচ্ছে তার পিছন-ফেরা বড়োঘরোআনা। তাঁর সাবেক দিনগুলো যেন যক্ষের ধনের মতো মাটির নিচে পোঁতা। তাঁর মনের মধ্যে প্রথম আভাস দিয়েছিল ক্ষুধিত পাষাণের গল্প।
৫. ছুটি
এটাও শাহজাদপুরে কাচারিবাড়ি বসে লেখা রবীন্দ্রনাথের আরো একটি অনবদ্য ছোটগল্প। তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম বাহন ছিল নৌকা। তিনিও নৌকাযোগেই তাঁর কাচারি বাড়িতে তাঁর জমিদারী দেখাশোনা করতে আসতেন। এমনি একদিন ওই রকম নৌকা ঘাটে ভিড়িয়েছেন। নদীর তীরে গ্রামের অনেক ছেলে খেলা করতে এসেছে। তার মধ্যে সর্দার গোছের একটি ছেলে ছিল। অনেক ডানপিটে স্বভাবের ছিল সে। তার কাজই হলো, এ-নৌকা ও-নৌকা করে বেড়ানো, মাঝিদের কাজ দেখা, মাস্তলের পাল গোটানো দেখা ইত্যাদি। তীরে অনেকগুলো গুড়িকাঠ গাদা-করা অবস্থায় ছিল। মাঝে ছেলেটি তড়াক করে নৌকা থেকে এই কাঠগুলি গড়িয়ে গড়িয়ে নদীতে ফেলতে আরম্ভ করলে। কিন্তু তার আমোদের পথে একটা বিঘ্ন এসে উপস্থিত হল। একটি ছোট মেয়ে এসে গুড়ি চেপে বসল। ছেলেটি তাকে উঠাবার চেস্টা করলে, কিন্তু মেয়েটি তা গ্রাহ্যও করলে না। তখন ছেলেটি তাকে সুদ্দই গুড়িটি উলটে দিলে। মেয়েটি পড়ে গিয়ে বিকট কান্না জুড়ে দিলে, এবং কাঁদতে কাঁদতে উঠেই ছেলেটিকে কষে এক চড় লাগালো। এই ঘটনা থেকেই ‘ছুটি’-র শুরু। সৃষ্টি হলো অন্যতম সেরা একটি গল্পের। এই গল্পে ফটিকের ‘ছুটি’ হয়েছিল চিরতরে।
তথ্যসংগ্রহ: ইন্টারনেট
#সংগৃহীত
Comments
Post a Comment