ব্যোমকেশ

বড় মুশকিলে পড়িয়াছি। ১৯৭০  সালে শরদিন্দু বাবুর মৃত্যুর পর হইতে আজ অবধি কলম ধরি নাই। অনভ্যাসে বিদ্যা কিঞ্চিৎ হ্রাস পাইয়াছে। তবু বহুযুগ পরে এই মুখপুস্তিকাখানি পাইয়া কিছু লিখিতে সাধ জাগিল। খোকার পুত্র এখন বড় হইয়াছে। সেই আমাকে এই অ্যাকাউন্টখানি খুলিয়া দিয়া কহিল মনের সকল কথা ইহাতে লিপিবদ্ধ করিতে।

কিন্তু কী লিখি? জানি পাঠকদিগের আমার প্রতি এক চরম ক্ষোভ রহিয়াছে। কেন বিশুপাল বধের কাহিনি সম্পূর্ণ করিলাম না? কেন শরদিন্দু বাবুর মৃত্যুর পরেই লেখনী সংবরণ করিলাম? এতদিন এই কথা প্রকাশ করি নাই। আজ জানাই, উহাই ব্যোমকেশের শেষ কেস ছিল এবং উহাতে তাহার সম্পূর্ণ পরাজয় হয়। আমি চাহিয়াছিলাম পাঠকদের নিকট যে ব্যোমকেশ বীরের আসনে আসীন, তাহা যেন বিন্দুমাত্র লাঘব না হয়।

এই অবধি লিখিয়াছি, আচমকা ঘরে ব্যোমকেশ প্রবেশ করিল। মুচকি হাসিয়া কহিল “কি হে, আজ শরদিন্দুবাবুর উপরে ফেসবুকে কিছু লিখছ নাকি?” আমি চমকিত হইয়া কহিলাম “বুঝলে কি করে?” একখানি সিগারেট ধরাইয়া আরামকেদারায় বসিয়া পা নাচাইতে নাচাইতে ব্যোমকেশ কহিল “এ বুঝতে বুদ্ধি লাগে না। গতকাল থেকেই তোমার মধ্যে কেমন একটা অস্থির ভাব দেখছি। তাক থেকে শরদিন্দু বাবুর লাল লাল বইগুলো টেনে বার করছ। কাল অনেক রাত অবধি খোকার থেকে বাংলায় টাইপ করা শিখলে। আজ ওঁর জন্মদিন। এটুকু আমি কেন পুঁটিরাম-ও বুঝতে পারবে”

ভারি রাগ হইল। কহিলাম “প্রিয় চরিত্র” গল্পে উনি তো ঠারেঠোরে তোমাকেই নিজের প্রিয় চরিত্র বলে গেছেন। ভুলে গেলে? তা তুমিই বল ওঁকে নিয়ে কিছু”। ব্যোমকেশের ভ্রুযুগল উত্থিত হইল। খানিক কী যেন ভাবিয়া কহিল “দেখ ভায়া, আমি সত্যান্বেষী। সত্য বই অন্য কিছু জানি না। ফলে কেঠো তথ্য ছাড়া কিছু বলতে পারব না। জন্ম ১৮৯৯ সালে বিহারের পূর্ণিয়াতে। কলকাতায় এসে মেট্রোপলিটন। প্রথম বই কবিতার। নাম যৌবনস্মৃতি। ১৯৩২ সালে পথের কাঁটা। যেটায়…”

“জানি জানি। মূল লেখা আমিই লিখেছিলাম। আমার ভাষা আর বানানের বহর দেখে উনি সেটা শুধরে দেন। এই তো। এই নিয়ে এত বছর বাদে খোঁটা না দিলেও পারতে”
“আরে তোমার লেখার পুরো বিশ্বাস রাখতে পারেন নি বলেই হয়তো বেনীসংহার কাহিনি নিজেই লিখেছেন” বলিয়া ব্যোমকেশ মিটিমিটি হাসিল। “আর তোমার এই সাধু চলিতের গুরুচন্ডালী। বাপ রে!!!”

ভয়ানক ক্ষুব্ধ হইয়া গুম মারিয়া বসিয়া রহিলাম। দেখিলাম অবরুদ্ধ হাসিতে ব্যোমকেশ ফুলিয়া ফুলিয়া  উঠিতেছে। কহিল “আমার সেই ডাক্তার অনুকুল বাবু কিংবা মণিলালের চেয়েও শরদিন্দুবাবু দেখছি তোমার কাছে বড় ভিলেন!” উত্তর না দিয়া উঠিয়া যাইব ভাবিতেছি এমন সময় ব্যোমকেশ সিগারেটে একটা টান দিয়া বলিল “লেখায় আমাদের ভূতান্বেষী বরদার কথাও রেখ। তাঁর আলোচনা তো আজকাল বিশেষ শুনি না”।কথাটা ভুল নয়। গোলগাল আলুর ন্যায় দেখিতে এই ভদ্রলোক যে প্রেতপুরীর সমস্ত খবরাখবর রাখেন তাহা “রক্ত খদ্যোত”, “বহুরূপী” র মত কাহিনি পড়িলেই প্রতীয়মান হয়। এই সেদিন খোকার পুত্র সানডে সাসপেন্স নামক এক বেতারকাহিনীতে উহার কীর্তি শুনিয়া শিহরিত হইতেছিল। ব্যোমকেশ যখন তাহাকে জানায় সে স্বয়ং বরদার সঙ্গে মোলাকাত করিয়াছিল, তাহার পৌত্র অবিশ্বাসের হাসি হাসে। এই আজকালকার দিনের ফ্যাশন হইয়াছে। বয়সের মর্যাদা নাই, কিংবা গেঁয়ো যোগী…। যাহা হউক বরদার কথা লিখিতে হইবে। 

দরজায় বেল বাজিল। পুঁটিরাম দরজা খুলিতেই হাসি মুখে পুরন্দর পান্ডের আবির্ভাব। রিটায়ার করিয়া আমাদের পাড়ায় একখানি ফ্ল্যাট লইয়াছেন। প্রত্যহ সকালে একবার করিয়া ঘুরিয়া যান। ব্যোমকেশ আমার এই লেখার কথা জানাইতেই তিনি আনন্দিত হইয়া কহিলেন “এতো খুব ভাল। তবে আমার মতে আপনি ওঁর ঐতিহাসিক কাহিনিগুলো নিয়ে বেশি করে লিখুন। আহা! কি ভাষা! তিনিই প্রথম লেখক যিনি আগের ভুদেব কিংবা রমেশচন্দ্রর মত ইতিহাসের চোঙ দিয়ে গল্পকে বিশ্লেষণ করে নি। ইতিহাস হাতরান নি। ইতিহাস গল্পরসের হানি ঘটায়নি কোথাও। তুমি সন্ধ্যার মেঘ, কালের মন্দিরা, তুঙ্গভদ্রার তীরে, কুমারসম্ভবের কবি-তে তাঁর কল্পনা যেন আকাশ ছুঁয়েছে। আপনাদের একটা গল্প বলি। ফলিত জ্যোতিষের চর্চা করতেন ভদ্রলোক। নাকি মুখ দেখেই ভবিষ্যৎ বলতে পারতেন। একবার যা হয়েছিল তা মারাত্মক। এক বিখ্যাত মানুষের বাড়ি প্রায়ই যেতেন আড্ডা দিতে। একদিন গেছেন, প্রৌঢ় মানুষটি আনন্দের সঙ্গে শরদিন্দুকে জানালেন তাঁর পুত্র পরীক্ষায় দারুন পাশ দিয়েছে। তিনি খুব খুশি। এবার ছেলেকে বিদেশে পাঠাবেন। শরদিন্দুও দারুণ খুশি। 
ভিতর বাড়ি থেকে ছেলেটি এসে তাঁকে প্রনাম করতেই তাঁর চোখমুখ কেমন বদলে গেল। এদিকে তাঁর বাবা বলে চলেছেন, ভাল সম্বন্ধ এসেছে ছেলের বিয়ের। বিয়ে করেই ছেলে বিদেশ যাবে। ছেলেটি চলে যাবার পর শরদিন্দু গম্ভীর হয়ে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর খুব দৃঢ়ভাবে বললেন, ছেলেকে পারিবারিক ব্যবসার কাজেই লাগান মশাই। বিদেশে পাঠাবেন না। আর হ্যাঁ, বিয়েটা এখনই দেবেন না। প্রৌঢ় অবাক। কেন এমন বলেছেন শরদিন্দু? শরদিন্দু কিছুই ভেঙে বললেন না। উঠে গেলেন।
ভদ্রলোকের মন খচখচ। তবুও বিয়ে হল ঠিক সময়েই। কিন্তু অদ্ভুতভাবে বিয়ের কিছুদন পর থেকেই ছেলেটি খেয়াল করল চোখে ঝাপসা দেখছে। এক বছর ঘুরতে না ঘুরতে পুরো অন্ধ। বিদেশ যাওয়া হল না ছেলেটির। হতে পারে কাকতালীয়। হতে পারে...” 

খেয়াল করি নাই, এর মধ্যেই চায়ের সরঞ্জাম সহ সত্যবতীর প্রবেশ ঘটিয়াছে।পান্ডেজি থামিতেই সে তড়বড় করিয়া কহিল “আমাদের খোকাকেও তো ছেলেবেলায় শরদিন্দুবাবুর লেখা জেনারেল ন্যাপলা, পরীর চুমু, সাপের হাঁচি পড়ে শুনাতাম। আর সদাশিবের গল্পগুলোও দারুণ মজার”

“আমার মোটামুটি লাগে” বলিতেই সত্যবতী এমন কটমট করিয়া আমার দিকে চাহিল, যে পুরাকাল হইলে ভস্ম হইতে কিছুমাত্র সময় লাগিত না। “সে কী ঠাকুরপো! আমার তো তোমার লেখাপড়ার প্রতি বেশ শ্রদ্ধা ছিল। মহারাষ্ট্রের কাহিনিকে বাংলায় এনে অমন দারুণ সব কান্ড আর কে লিখেছেন বল দেখি! আনন্দমেলায় যখন তরুণ মজুমদারের চিত্রনাট্য আর বিমল দাশের ছবিতে প্রকাশ পেত, খোকা যে খোকা, খোকার বাবা, আমি সবাই হামলে পড়তুম, ভুলে গেলে!”
তর্ক বাড়াইলাম না। আমার মুখপুস্তিকার লেখা ঢের বাকি পড়িয়া আছে। অবাক হইয়া বলিলাম “সত্যবতী! তুমিও শরদিন্দু বাবুর ভক্ত!”
“হব নাই বা কেন? কত ভাল রোমান্টিক সব উপন্যাস লিখেছেন ভাব দেখি। দাদার কীর্তি, মেঘদূত, ঝিন্দের বন্দী এমনকি ছোট গল্প ভল্লু সর্দার-ও কত্ সুন্দর। আমার ভারী ভাল লাগে। তোমার লাগে না”
খল হাসিয়া বলিলাম “জানো না বোধহয়, ঝিন্দের বন্দি আসলে প্রিজনার অফ জেন্দার অনুবাদ”
ভীমরুলের চাকে ঢিল পড়িল।“সব জানি ঠাকুরপো। মাকড়সা নিজের পেটের থেকে সুতো তৈরি করে, আর মৌমাছি অন্য ফুল থেকে মধু নিয়ে আসে। কিন্তু তুমি যদি আমায় মধু ছেড়ে মাকড়সার সুতো খেতে বল তা আমার পক্ষে অসম্ভব। তুমি খেলে খাও গে যাও”

অকাট্য যুক্তি। আমাকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া বিজয়িনীর হাসি হাসিয়া সত্যবতী কহিল “তুমি বোধহয় সিনেমা থিয়েটার বিশেষ দেখ না ঠাকুরপো। দেখলে জানতে উত্তমকুমার থেকে আবীর, অনির্বান, সব কালের সব সুপুরুষ নায়কই আমাদের ওঁর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন”। ব্যোমকেশ সলজ্জ হাসি দিল। বুঝিলাম এই বিষয়ে আজ আমার জয়লাভ করা অসম্ভব। 

যে লেখা লিখিতে বসিয়াছিলাম তাহা শেষ হইল না। থাক। এতকাল পরে নূতন করিয়া লেখা শুরু না করাই বুঝি ভাল।মৃত্যুর পর কোন কোন লেখক হারাইয়া যান। কেহ আবার চরম স্রোতস্বতী নদীর মত তীব্রবেগে জনমানসে ফিরিয়া আসেন ।শরদিন্দু এই দ্বিতীয় শ্রেণীর অদ্বিতীয় লেখক।

জন্মদিনে তাঁহাকে শতকোটি প্রণাম জানাই।

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ