দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর
‘দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বাংলা গদ্যসাহিত্য’
ভারতী নামক উচ্চমানের একটি পত্রিকার সম্পাদক, দার্শনিক ও কবি দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬) ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর বাংলা গদ্যসাহিত্যের অন্যতম একজন শিল্পী হলেও, বর্তমান সময়ের ক’জন তাঁর কথা মনে রেখেছেন—এবিষয়ে যথেষ্ট রয়েছে। আরো ভালো করে বললে, বর্তমান সময়ের মানুষের কাছে কবি দ্বিজেন্দ্রনাথ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছেন, আর গদ্যশিল্পী দ্বিজেন্দ্রনাথ সকলের অলক্ষ্যে পড়ে রয়েছেন। অথচ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একজন গদ্যশিল্পী হিসেবে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও একটি বিশিষ্ট স্বতন্ত্র ভূমিকা ছিল। অতীত ও বর্তমানের প্রায় সমস্ত সমালোচকই স্বীকার করে নিয়েছেন যে, তাঁর একটি নিজস্ব গদ্যরীতি ছিল। আর সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হল যে, বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের যুগের মানুষ হয়েও তাঁদের কারো প্রভাবই কিন্তু তাঁর উপরে পড়তে পারেনি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এবিষয়ে তাঁকেই একমাত্র ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে। কারণ, ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের বাংলা সাহিত্যের বাকি গদ্যলেখকরা হয় বঙ্কিমচন্দ্র, আর না হয় রবীন্দ্রনাথের দ্বারা অল্পবিস্তর হলেও প্রভাবিত হয়েছিলেন।
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য-জীবনের সাথে যাঁরা কমবেশি পরিচিত রয়েছেন, তাঁরা তাঁকে মূলতঃ ১৮৭৫ সালে প্রকাশিত ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ কাব্যগ্রন্থের কবি বলেই জানেন। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজের সুবক্তা ও ভারতী পত্রিকার সম্পাদক দ্বিজেন্দ্রনাথের গদ্যরচনার সংখ্যাও কম কিছু নয় বলেই দেখতে পাওয়া যায়। সাহিত্য সমালোচকদের মতে, তাঁর মুখ্য গদ্যরচনাগুলি হল—চার খণ্ডের তত্ত্ববিদ্যা (১৮৬৬-৬৯), গীতাপাঠ (১৯১৫), নানা চিন্তা (১৯২০), প্রবন্ধমালা (১৯২০) এবং চিন্তামণি (১৯২২)।
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনীগ্রন্থগুলি থেকে জানা যায় যে, নিজের যুগের নিরিখে তিনি অসাধারণ বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। কাব্য, গণিত, ভাষাতত্ত্ব, দর্শন, কাগজের বাক্স ও বাংলা শর্টহ্যাণ্ড অক্ষর রচনার বিষয়ে তাঁর সমান কৌতূহল ছিল। আত্মপ্রতিষ্ঠায় উদাসীন, নির্লিপ্ত ও অনাসক্ত দ্বিজেন্দ্রনাথ ইচ্ছা করলেই বাংলা গদ্যের ইতিহাসে একজন মহৎ শিল্পীরূপে স্বীকৃতিলাভ করতে পারতেন। কিন্তু যেহেতু এধরণের স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা লাভের কোনো প্রচেষ্টাই তাঁর চরিত্রের মধ্যে কখনো ছিল না, সেহেতু তিনি কোন যুগের বাঙালি পাঠক-পাঠিকাসমাজের কাছেই তেমন ধরণের যোগ্য সমাদর পাননি।
নিজের ব্যক্তিগত জীবনে দ্বিজেন্দ্রনাথ মূলতঃ একজন দার্শনিক ছিলেন। এবিষয়ে তাঁর শ্রেষ্ঠ গদ্যরচনা হচ্ছে—গীতাপাঠ। এই গ্রন্থটি থেকে একথার প্রমাণ পাওয়া যায় যে, দুরূহ মৌলিক দর্শন ও তত্ত্বকথাকে সরল ও প্রাঞ্জলভাবে ব্যাখ্যা করবার বিরল ক্ষমতা দ্বিজেন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল। আর এখানেই তাঁর গদ্যরীতির সূত্রটির সন্ধানও পাওয়া যায়।
সমালোচকদের মতে, বাংলা গদ্যে তিনি যে ভাষারীতি ব্যবহার করেছিলেন, সেটার প্রধান গুণ ছিল—যুক্তি, শৃঙ্খলা ও প্রাঞ্জলতা। আর এসব গুণই তাঁর কাব্যগুলিতেও সঞ্চারিত হয়েছিলেন। তাঁর রচিত বাংলা গদ্যের ছাঁচ নিতান্তই দেশী প্রকৃতির ছিল, যাতে তিনি কিছু চলতি বাংলা বাগধারা এবং কিছু সংস্কৃত পরিভাষা ব্যবহার করেছিলেন। সমালোচকদের মতে, তাঁর এই গদ্যরীতি অলঙ্কার বিরল ছিল, এবং কথ্যভাষানুসারী না হয়েও কথ্যরীতি ছিল; আর এই দুই মিলিয়েই দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর নিজস্ব একটি স্টাইল বা ভাষারীতি তৈরি করে নিয়েছিলেন। এপ্রসঙ্গে তিনি নিজেই একবার বলেছিলেন—
“আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, মনে যদি এমন কোনও ভাব উদিত হয়, যাহা প্রকাশের উপযুক্ত খাঁটি দেশী ভাষায় প্রকাশ করা যায়, তাহাকে প্রকাশের জন্য বিদেশী ইডিয়মে অনুবাদ করিতে যাইব কেন? আমি কখনো ওপথ মাড়াই নাই। আমার লেখার এই বিশিষ্টতা আর কেহ বুঝিতে পারিবে কিনা জানি না কিন্তু কৃষ্ণকমল পারিবে।”
আর সত্যিই আচার্য কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের ‘পুরাতন প্রসঙ্গ’ গ্রন্থে দ্বিজেন্দ্রনাথের ভাষারীতির ভূয়সী প্রশংসা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও দ্বিজেন্দ্রনাথকে বাংলা সাহিত্যের জগতে শুধুই উপেক্ষার অভিশাপ পেতে হয়েছিল বা এখনও পেতে হচ্ছে।
অনেক সমালোচকের মতে, দ্বিজেন্দ্রনাথের গদ্যরচনায় যে ভাষারীতি দেখতে পাওয়া যায়, তা থেকে একথাই মনে হয় যে, তখন থেকেই যদি এই ভাষারীতি বা স্টাইলের চর্চা করা হত, তাহলে বাংলা সাহিত্যে সাধু ও কথ্যভাষার মধ্যেকার কলহ বহুদিন আগেই মিটে যাওয়া সম্ভব ছিল। একইসাথে একথাও অনস্বীকার্য যে, বাংলা সাহিত্যের আরেক সফল গদ্যশিল্পী প্রমথ চৌধুরীর ভাষারীতিও কথ্যভাষার উপরেই প্রতিষ্ঠিত হলেও, সেটা কিন্তু অতিশিষ্ট বিদগ্ধমণ্ডলীর ভাষা; তাঁর ব্যবহৃত ভাষা প্রাকৃত ছিল না। অন্যদিকে দ্বিজেন্দ্রনাথের ভাষারীতি প্রাকৃত বাংলার উপরে প্রতিষ্ঠিত ছিল। এদিক থেকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ভাষারীতি দ্বিজেন্দ্রনাথের ভাষারীতির কাছাকাছি পৌঁছেছিল বলা যেতে পারে। সমালোচকদের মতে, তাঁদের দু’জনের ভাষারীতিতেই দেশী-বিদেশী-সংস্কৃতর অপূর্ব পরিণয় সংঘটিত হয়েছিল। বিশ্রম্ভালাপের সুরই এই শৈলীর মূল ভিত্তি ছিল। যেহেতু এতে গ্রাম্যতা অনুপস্থিত ছিল এবং একইসাথে কৃত্রিম শহুরেয়ানাও অবাঞ্ছিত ছিল, সেহেতু সমালোচকেরা একে প্রাকৃত বাংলা বলে অভিহিত করেছেন বলে দেখতে পাওয়া যায়। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরই বাংলা সাহিত্যে এই প্রাকৃত গদ্যরীতিকে সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল যে, এরপরে তাঁর অনুবর্তী হয়ে এবিষয়ে অন্য কেউ আর অগ্রসর হননি।
দ্বিজেন্দ্রনাথের গদ্যরচনার ভাষারীতির স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য প্রমাণিত করবার জন্য এখানে তাঁর ‘গীতাপাঠ’ নামক গ্রন্থটি থেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রাঞ্জল যুক্তিপ্রধান সাবলীল গদ্যের কিছু পরিচয় তুলে ধরা যেতে পারে। তাঁর এই গ্রন্থের প্রথম কয়টি বাক্য নিম্নরূপ—
“এ শান্তিনিকেতন। আমার কুটীরে বিনা-তৈলে একটি দীপ জ্বলিতেছে—ভগবদ্গীতা। আমাদের দেশের মস্তকের উপর দিয়া এত যে বাত্যার উপর বাত্যা চলিয়া যাইতেছে—কিন্তু আশ্চর্য্য ঈশ্বরের মহিমা—উহার অটল জ্যোতি সেকাল হইতে একাল পর্যন্ত সমান রহিয়াছে—ক্ষণকালের জন্যও ক্ষুব্ধ বা ম্লান হয় নাই। পশ্চিমের সমস্ত তত্ত্বজ্ঞান একত্র পুঞ্জীভূত হইয়া যত না আলোকচ্ছটা দিগদিগন্তরে বিস্তার করিতেছে আমাদের ঐ ক্ষুদ্র দীপের অপরাজিত শিখা সে সমস্তেরই উপরে মস্তক উত্তোলন করিয়া স্বর্গীয় মহিমায় দীপ্তি পাইতেছে।”
আর এই গ্রন্থেরই ‘তৃতীয় অধিবেশন’–এর শেষাংশ এরকম—
“আনন্দ সম্বন্ধে এ যাহা আমি কথা-প্রসঙ্গে বলিলাম এটা সাধন-পদ্মানদীর ওপারের কথা; আমরা কিন্তু রহিয়াছি এপারে কারারুদ্ধ; কাজেই, আমাদের পক্ষে ওরূপ উচ্চ আনন্দের কথাবার্তার আন্দোলন একপ্রকার ‘গাছে কাঁঠাল-গোঁফে তেল’। এ-রকমের বাক্যবাণ আমার সহা আছে ঢের; সুতরাং উহা গ্রাহ্যের মধ্যে না আনিয়া আমার যাহা কর্তব্য মনে হইল তাহাই আমি করিলাম—যাত্রীরা পাছে নৌকাযোগে পদ্মানদী পার হইতে অনিচ্ছুক হন—এই জন্য পদ্মানদীর ওপার যে কিরূপ রমণীয় স্থান তাহা দুরবীণ-যোগে তাঁহাদিগকে দেখাইলাম। এখন নৌকা আরোহণ করিবার সময় উপস্থিত; অতএব, যাত্রী-ভায়ারা পোঁটলা-পুঁটলি বাঁধিয়া প্রস্তুত হউন।”
সমালোচকদের মতে, যদিও এতে পরিহাসপ্রিয়তা দ্বিজেন্দ্রনাথের চরিত্র থেকে তাঁর লেখার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে বলে দেখা যায়, কিন্তু তবুও বিষয়ের গুরুত্ব কোথাও ক্ষুণ্ণ হয় নি; বরং এরফলে তাঁর গদ্যরীতি সরস ও স্বচ্ছন্দ, প্রাঞ্জল ও সাবলীল হয়ে উঠেছিল।
এবারে তাঁর ‘নানা চিন্তা’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘দেখিয়া শিখিব কি ঠেকিয়া শিখিব’ প্রবন্ধ থেকে আরেকটি উদাহরণ উপস্থাপিত করা যেতে পারে, যা নিম্নরূপ—
“আমার শাস্ত্রে লেখে এই যে, হিতবাক্য লোকের মনোহারী হইবে কি হইবে না তাহা ভাবিবার কোনো প্রয়োজন করে না—চোখ কান বুজিয়া তাহা বলিয়া ফ্যালাই ভাল; যে শোনে সে শুনিবে, যে না শোনে না শুনিবে; তুমি তো বলিয়া খালাস! তুমি যদি জানিতে পারিয়া থাক গঙ্গার ঘাটে কুমিরের আনাগোনা আরম্ভ হইয়াছে, তবে সে কথা শহরময় রাষ্ট্র করিয়া দেওযা তোমার পক্ষে অবশ্য কর্তব্য। তবে এটা সত্য যে, জ্ঞানের হিতবাক্য কাহারো প্রাণে সহে না, তাহা এক কান দিয়া শ্রোতার মস্তিষ্কসদনে প্রবেশ করে—শুদ্ধ কেবল ভদ্রতার অনুগ্রহে ভরসা করিয়া; কিন্তু প্রবেশ করিয়া যখন দেখে যে, হৃদয়দ্বারে কপাট বন্ধ, তখন বসিতে না পাইয়া আর এক কান দিয়া সুড়সুড় করিয়া বাহির হইয়া যায়। মনস্তষ্টিকর অহিত বাক্যের কুহকে ভুলিয়া রসাতলের অভিমুখে ধাবমান হইতেছে এরূপ কৃপাপাত্র আমি কত যে দেখিযাছি তাহার সংখ্যা নাই, পরন্তু তাহাদের মধ্যকার একজনকেও আজ পর্যন্ত দেখিলাম না যে, সে কাহারো হিতবাক্য শুনিয়া সৎশিক্ষা লাভ করিয়াছে। চোরা না শোনে ধর্ম্মের কাহিনী! যে শেখে, সে ঠেকিয়া শেখে। বলিতেছি বটে ‘ঠেকিয়া শেখে’, কিন্তু কাহাকে বলে তাহা যদি শোনো, তবে তোমার মাথা হইতে পা পর্যন্ত শিহরিয়া উঠিবে—ঠেকিয়া শেখা’র আর এক নাম মৃত্যুমুখে প্রবেশ করা। দশজন স্নানযাত্রা গামছা কাঁধে করিয়া গঙ্গার ঘাটে অসিয়াছে দেখিয়া তুমি তাহাদিগকে উচ্চৈস্বরে বলিতেছ ‘জলে নাবিও না—গঙ্গায় কুমির দেখা দিয়াছে।’ পাঁচজন তোমার সে-কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিয়া এক-কোমর জলে, আর পাঁচজন তাহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ এক-হাঁটু জলে নাবিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল। কোমর-জলেব মহারথীরা চকিতের মধ্যেই জল-গর্ভে অদৃশ্য হইয়া গেল—ইহারই নাম ঠেকিয়া শেখা। হাঁটু-জলের অর্ধরথীরা দ্রুতগতি ডাঙায় উঠিল—ইহারই নাম দেখিয়া শেখা।”
সমালোচকদের মতে, এর মধ্যে আগাগোড়া বিশ্রম্ভালাপের সুর শুনতে পাওয়া যায়, এবং এর জোরেই দ্বিজেন্দ্রনাথের গদ্যের ভাষারীতি অনায়াসগতি ও সাবলীল হয়ে উঠেছিল। বস্তুতঃ দ্বিজেন্দ্রনাথ কিন্তু তাঁর গদ্যরচনার সর্বত্রই এই ভাষারীতি বজায় রেছিলেন। গীতাপাঠের ভূমিকায়, সামাজিক সমস্যার নিরসনে, দুরূহ তত্ত্বালোচনায়, ব্যাকরণ আলোচনায় এবং জ্যামিতিক আলোচনায়—সর্বত্রই তিনি এই প্রাকৃত গদ্যরীতিকেই অনুসরণ করেছিলেন। প্রসঙ্গতঃ তাঁর রচনা থেকে এখানে আরেকটি উদাহরণ তুলে ধরা যেতে পারে। আর এতেও আগের উদাহরণের মতোই দেশী-বিদেশী বাগধারার নিঃসঙ্কোচ বহুল প্রয়োগ লক্ষ্যণীয়। দ্বিজেন্দ্রনাথের ‘প্রবন্ধমালা’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘সামাজিক রোগের কবিরাজি চিকিৎসা’ শিরোনামের প্রবন্ধের একটি অংশ নিম্নরূপ—
“আমাদের দেশে প্রথম প্রথম অর্থোপার্জনই ইংরাজি শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য এবং প্রবর্তক ছিল। ইংরাজি শিক্ষাতে অর্থোপার্জন ছাড়া আর যে কোনো ফল দর্শিতে পারে, অর্ধশতাব্দীপূর্ব্বে আমাদের দেশে দুই একজন অসাধারণ মহাত্মা ব্যতিরেকে আর কেহই তাহা বিশ্বাস করিতেন না। ক্রমে ইংরাজি-শিক্ষার সুফলের প্রতি লোকের চক্ষু ফুটিতে আরম্ভ করিল। হিন্দু কালেজ প্রতিষ্ঠিত হইল। হিন্দু কালেজে ডিরোজিও নামক একজন উঁচুদরের বায়ু-প্রধান শিক্ষক ছিলেন—তাঁহারই মুখের ফুঁয়ে পিত্তানল প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিল। এই ক্ষুদ্র বীজ হইতে ইয়ঙ বেঙ্গালের অঙ্কুর গজাইতে আরম্ভ করিল। এই অঙ্কুর যখন কালক্রমে সতেজ হইয়া মাথা তুলিয়া দাঁড়াইল, তখন তাহা ইংরাজি ভাষায় ‘ইয়ঙ বেঙ্গালের দল’ এবং বাঙ্গালি ভাষায় ‘ছোঁড়ার দল’ উপাধি প্রাপ্ত হইল। অন্যকে উপাধি প্রদান করিতে গেলে আপনাকেও উপাধির ভার স্কন্ধে বহিতে হয়—এই গতিকে উপাধিপ্রদাতারাও একটি পাল্টা উপাধি প্রাপ্ত হইলেন—কি? না, গোঁড়ার দল। বঙ্গসমাজে, এইরূপে, দুই পক্ষের সৃষ্টি হইল—গোঁড়ার দল এবং ছোঁড়ার দল; গোঁড়ার দল এ-পক্ষ, এবং ছোঁড়ার দল ও-পক্ষ।”
তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, বাংলা গদ্যসাহিত্যের ক্ষেত্রে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর আসলে বিশ্রম্ভালাপেরই কথক ছিলেন। শুধু তাই নয়, এক্ষেত্রে তিনি দ্বিতীয়রহিত ছিলেন। বাংলা গদ্যকে গ্রাম্য পর্যায়ে না নামিয়ে এবং কৃত্রিম শিষ্ট পর্যায়ে না তুলে, কিভাবে অনায়াসগতিতে সাবলীল প্রাঞ্জলরূপে ব্যবহার করা সম্ভব, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের গদ্যরচনা দিয়ে এর প্রকৃষ্ট পরিচয় দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাঁর এই ভাষারীতিতে যে সম্ভাবনা নিহিত ছিল, সেটা তাঁর পরে কোন উপযুক্ত অনুগামীর দ্বারা পরীক্ষিত হতে পারেনি, যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের ক্ষেত্রে আজও একটি আক্ষেপের বিষয় হয়ে থেকে গিয়েছে।
Comments
Post a Comment