কেশব চন্দ্র নাগ
তেলমাখা বাঁশে বাঁদর উঠছে আর নামছে৷ সুদ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে৷ প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে গতিময় ট্রেন,চৌবাচ্চার এক দিক দিয়ে জল বের হচ্ছে আর এক দিক দিয়ে ঢুকছে৷ দাঁত ফোটানো যায় না অঙ্কের এমন সব সংখ্যা, বিটকেল ভগ্নাংশের হিসেবপত্তর। দাঁত ভাঙা অঙ্ক বললেই ভেসে ওঠে কে সি নাগের কথা, পুরো নাম কেশব চন্দ্র নাগ। জীবিত অবস্থায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন গোটা বাঙালি জাতির অঙ্কের মাস্টারমশাই। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছাত্রদের অনেকের কাছে কে সি নাগের অঙ্ক যেন ভয়ের এক প্রতিচ্ছবি। আবার মেধাবীর কাছে তিনি আইকন।কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র যাঁর নাম রেখেছিলেন গণিত শিল্পী। তাঁর ছাত্র তালিকায় আছেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মত প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বরা।
একসময় সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ছবি অনেকের চোখে পড়েছে উপরে কে সি দাসের ছবি, তিনি বলছেন: আমি রসগোল্লা বানানোর জন্য বিখ্যাত। তলায় কে সি নাগের ছবি, তিনি বলছেন: আমি রসগোল্লা পাওয়ানোর জন্য বিখ্যাত। আসলে কি সেটাই সত্যি! মোটেও নয় আদপে অঙ্ক ভীতি দূর করে অঙ্ককে কী ভাবে প্রাঞ্জল করে শেখানো যায়, কেশবচন্দ্র জীবনভর সেটাই শিখিয়েছেন। ১৮৯৩ সালে ১০ জুলাই, রথযাত্রার দিন হুগলির গুড়াপের নাগপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন কেশবচন্দ্র নাগ। পিতা রঘুনাথ নাগ মা জননী ক্ষীরোদাসুন্দরী। ছোট বয়সেই কেশবচন্দ্র বাবাকে হারান,মায়ের কাছেই মানুষ। একটার পর একটা অঙ্ক বই লিখে যিনি আজ বরেণ্য সারা বাঙালি জাতির কাছে, উচ্চশিক্ষায় তিনি বিজ্ঞান নয়, চেষ্টা করেছিলেন যদি কলা বিভাগেও স্নাতক হওয়া যায়! অবশেষে ১৯১৭ সালে অঙ্ক ও সংস্কৃত নিয়ে জোড়া বিএ পাশ করেন ।
অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে কিষেণগঞ্জ হাইস্কুলে
যোগ দিলেন। এরপর বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুল। শিক্ষকতা আর সামান্য রুজিরোজগার নিয়ে সহজ মধ্যবিত্ত জীবন কাটছিল হুগলির কেশবের । ততদিনে শিক্ষক হিসেবে সুখ্যাতি ছড়িয়েছে অনেকটা । সেই সুখ্যাতি গিয়ে পৌঁছল বাংলার বাঘ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কানে। তাঁর ডাকে মিত্র ইনস্টিটিউশন ভবানীপুরে অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন কেশবচন্দ্র নাগ। শুরু হয় কলকাতার মেস-জীবন। রসা রোডের মেসবাড়িতে থাকতে শুরু করেন। পাকাপাকিভাবে কলকাতার বাসিন্দা হলেও মনেপ্রাণে ছিলেন মফস্বলের ছেলে। মাটির টানে বারবার ফিরে গিয়েছেন হুগলির গুড়াপে, তাঁর আদি বাড়িতে।
কেশব নাগের গুণগ্রাহী ছিলেন কাশিমবাজারের মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী। তাঁর বিশাল লাইব্রেরি তিনি কেশব নাগের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন,কার্যত সেখানেই গণিতের আসল ধ্যানজ্ঞান ও সাধনা শুরু করেন কেশব নাগ। নিজে লিখবেন কোনওদিন তাঁর ভাবনায় ছিল না। কবিশেখর কালিদাস রায়ের বাড়িতে সাহিত্যিকদের আড্ডা রসচক্র সাহিত্য সংসদ। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, জলধর সেনের মতো সাহিত্যিকের নিত্য যাতায়াত সেখানে। কেশবচন্দ্র ছিলেন আড্ডার অন্যতম মুখ। কবিশেখরই তাঁকে প্রথম বলেছিলেন অঙ্কের বই লেখার কথা। তোমার ক্লাস ছেলেরা গোগ্রাসে গেলে, তুমি বই লিখবে না? তিনের দশকের মাঝামাঝি প্রকাশিত হয় নব পাটীগণিত। প্রকাশক ইউ এন ধর অ্যান্ড সন্স। শিক্ষক কেশবচন্দ্র নাগের সেই কে সি নাগ হয়ে ওঠার শুরু। বছর কয়েকের মধ্যেই বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে বইটি। পাঠ্যপুস্তক হিসেবেও অনুমোদিত হয়। কিন্তু, পাঠ্যবইয়ের রচয়িতাকে লেখক বলে স্বীকৃতি দেওয়া আমাদের অভ্যাসে নেই যে! কে সি নাগকে তাই আমরা লেখক বলিনি। যদিও কে সি নাগের সব অঙ্ক বই মৌলিক ছিল বলেই তা আজও অম্লান।
কেশবচন্দ্রের মেসে একদিন এসে পড়েছিলেন ক্যালকাটা বুক হাউসের পরেশচন্দ্র ভাওয়াল। টেবিলের উপরে রাখা ছিল বাঁধানো অঙ্কের খাতা। কোন জটিল অঙ্ক কোন উপায়ে করলে সহজেই তা বোধগম্য হবে, তার সব টেকনিক লিখে রাখা আছে পাতার পর পাতায়। উল্টেপাল্টে দেখে উঠে ছিলেন পরেশবাবু। কেশব নাগকে সেই খাতা বইয়ের আকারে ছাপার প্রস্তাব দেন তিনি। প্রথমে রাজি হননি কেশবচন্দ্র। প্রশ্ন জেগেছিল, অঙ্কের কি হেল্প-বুক হয়? শেষমেশ কেশবচন্দ্রকে রাজি করাতে সফল হন ওই প্রকাশক। ১৯৪২ সালে প্রকাশিত হল অঙ্কের সহায়িকা ম্যাট্রিক ম্যাথমেটিক্স।নব পাটীগণিত’-এর মতোই, মার্কেট ও মন, দুই-ই জয় করল বইটি,আর ফিরে তাকাতে হয়নি। মোট ৪২টা বই লিখেছেন। ততদিনে ‘অঙ্কের বই মানেই কে সি নাগ।
ইংরেজি, হিন্দি, নেপালি, উর্দু ভাষায় অনূদিত হয় কেশবচন্দ্র নাগের বই। পাকিস্তান বোর্ডের সিলেবাস অনুযায়ী লিখেছিলেন পাক ম্যাথমেটিক্স। দৃষ্টিহীনদের জন্য প্রকাশিত হয়েছে ব্রেল সংস্করণও। এখনও এমন দিন নেই, যেদিন কে সি নাগের বই বিক্রি হয় না। যেসব পড়ুয়া মন দিয়ে অঙ্ক শিখতে চায়, তারা এখনও খুঁজে বের করে কেসি নাগের লেখা আসল বই। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র যাঁর নাম রেখেছিলেন গণিত-শিল্পী।
উত্তম-সুচিত্রার ছবির ভক্ত কেশবচন্দ্র ছিলেন মোহনবাগান ক্লাবের কট্টর সমর্থক। এমনও হয়েছে, মোহনবাগান ম্যাচ হারলে সে রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়েছেন। মিষ্টি খেতে ভালবাসতেন, গজা খুব প্রিয় ছিল। জন্মদিনে অভিনেতা বিকাশ রায় আসতেন গোলাপের তোড়া নিয়ে। যত বছরের জন্মদিন, ততগুলো গোলাপ। ওঁর ছাত্রতালিকায় আছেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সকলের স্মৃতিময় লেখাপত্তরে ভরে আছে মাস্টারমশাইয়ের কথা।
এমন এক উজ্জ্বল বাঙালি ব্যক্তিত্ব কেশবচন্দ্র নাগ বাঙালি কে অঙ্ক শিখিয়েছেন । আজ আন্তর্জাতিক গণিত দিবসে বাঙালির গণিতের শিক্ষক কে আমরা স্মরণ করি শ্রদ্ধায়।
তথ্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার আনন্দবাজার পত্রিকায়,শিশির রায় ও আর্যভট্ট খানের নিবন্ধ,দি বেঙ্গল স্টোরির সৈকত দাসের নিবন্ধ
Comments
Post a Comment