রবীন্দ্রনাথ
জোড়াসাঁকোর তেতলার বারান্দার আড্ডায় সেদিন সংস্কৃত নাটক পাঠ করছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। বসন্ত উত্সবের বর্ণনা পড়তে পড়তে তাঁর মনে হল কী সুন্দর ছিল সেকালের বসন্ত উত্সব, যেন হৃদয়ের হোরিখেলা। তিনি সবাইকে বলেন, দেখো আমরা এমন প্রাণ খুলে আবির মাখতে পারি না কেন? দিশি রীতির এই উত্সবকে কি ফিরিয়ে আনা যায় না?
কাদম্বরীও উত্সাহে মেতে উঠলেন, কেন পারব না, আমাদের উঠোনেই বসন্ত উত্সব করলে হয়, কিংবা পাশের বৈঠকখানা বাড়ির আঙিনায়।
তা হলে গুণোদাদাকে খবর পাঠানো হোক, স্বর্ণ বললেন, দু'বাড়ির ভাইবোনেরা মিলে দারুণ মজার বসন্তখেলা হবে।
এ-সব ব্যাপারে গুণেন্দ্রনাথের বরাবর খুব উত্সাহ। দু'বাড়ির ছেলেমেয়েদের নিয়ে আগেও তিনি হিন্দুমেলা বা নবনাটকের আয়োজনে মেতে উঠেছেন। যদিও জোড়াসাঁকোর দু'বাড়ির মধ্যে সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে মনোমালিন্য লেগেই ছিল। তবু সে-সব গায়ে না মেখে গুণেন্দ্র এবারেও মহানন্দে বসতবাড়ির ভাইবোনদের সঙ্গে উত্সবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
ধর্ম নিয়ে দু'বাড়ির বিভেদ হলেও ছেলেমেয়েদের মনের টান রয়ে গেছে। বসন্তসন্ধ্যায় রঙিন আলোয় আর আবিরে বৈঠকখানা-বাড়ির বাগান হয়ে উঠল নন্দনকানন। পিচকারিতে রংখেলাও বাদ রইল না।
বসন্ত উত্সবে ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও আমন্ত্রিত। অক্ষয় ও শরত্কুমারী এমন সমাবেশে পুলকিত হয়ে নিজেরা পরস্পর রং মাখাচ্ছেন।
কাদম্বরী সেজেছেন সেকালিনীর মতো। বেলফুলের মালা জড়ানো কবরীতে পিন করা জর্জেটের ওড়না, হাতে মাধবীলতার কঙ্কণ, গলায় মাধবীমালা, কানেও ঝুমকোর মতো একগুচ্ছ মাধবীফুল। তাঁকে দেখে জ্যোতিও মুগ্ধ হয়ে দু'হাত বাড়িয়ে ডাক দিলেন, অয়ি মাধবিকা কুসুমনন্দিতা!
কাদম্বরীও হাত বাড়িয়ে জ্যোতির সাদা জামায় আবির ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, ওহে আবিরলাঞ্ছিত যুবা, এসো আমরা বসন্তের আবাহন করি।
কন্দর্পনিন্দিত জ্যোতিরিন্দ্র ও অপরূপা কাদম্বরীর এই কৌতুকনাট্য সকলেই মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকেন, তাঁরা যেন এই লৌকিকস্তর থেকে ঊর্ধ্বে কোনও মায়াজাল রচনা করেছেন বাগানে।
একটু পরেই আবার সে-দৃশ্য ভেঙে আর-একটি দৃশ্যের জন্ম হয়। যেন নাটকের পালাবদলের মতো এক-এক টুকরো কথা, সংলাপ, ভঙ্গি, দৃশ্য ছড়িয়ে পড়তে থাকে বসন্তের বাগানে।
একসময় বিহারীলাল অঞ্জলিভরা আবির নিয়ে এগিয়ে আসেন কাদম্বরীর দিকে। আঙুলে করে গুঁড়ো গুঁড়ো লাল, সবুজ, গোলাপি বৃষ্টির মতো ছড়িয়ে দিতে থাকেন কাদম্বরীর মাথায়, গায়ে, সারা শরীরে। কাদম্বরীও কিশোরীর উচ্ছ্বাসে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ভিজতে থাকেন সেই আবিরবর্ষণে॥
©️Rabindranath Tagore
Comments
Post a Comment