পরশুরাম রাজশেখর বসূ
রাশভারী প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু লেখায় ছিল ভরপুর মজা, ব্যঙ্গ। স্বয়ং প্রফুল্লচন্দ্র বলেছিলেন, “এই বুড়া বয়সে তোমার গল্প পড়িয়া হাসিতে হাসিতে chocked হইয়াছি।” তাঁর লেখার ভক্ত ছিলেন আরও একজন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একবার লেখায় মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এত রস পাও কোথায়?” তৎক্ষণাৎ উত্তর, “আপনি ভুলে যাচ্ছেন, আমি রসায়নের লোক! তবে নিজেকে ‘রসসাহিত্যিক’ বলতে ঘোর আপত্তি ছিল রাজশেখরের। বলতেন, “রসসাহিত্যিক আবার কি; আমি কি হাঁড়িতে রস ফুটিয়ে তৈরী করি?”
সাল ১৯২২। জলধর সেনের ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল একটি গল্প। নামটা ভারী অদ্ভুত – ‘শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’। এক গল্পেই বাজিমাত। রসসাহিত্য এমনও হয়? কৌতুক আছে, ব্যঙ্গ আছে, কিন্তু ভাঁড়ামি নেই একফোঁটাও। লেখক কে? তার নামটাও তো ভারী অদ্ভুত। ‘পরশুরাম’। এটা আসল নাম না কি ছদ্মনাম? কিছুদিন পরেই জানা গেল লেখকের প্রকৃত নাম। তিনি পেশায় রসায়নবিদ্। বেঙ্গল কেমিক্যালের তৎকালীন সর্বময় কর্তা। নাম? রাজশেখর বসু। বাংলা রসসাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। আবার, তাঁর জন্মশতবর্ষে প্রকাশিত হল এমন এক কাণ্ডের ইতিবৃত্ত, যা এত কাল কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষের নেতৃত্বে মানিকতলা বোমা মামলার ঘটনায় বোমার ফর্মুলা এবং যাবতীয় মালমশলা সরবরাহ করতেন রাজশেখর! ধরা পড়লে সোজা সেলুলার জেল, তবু নির্ভয় কাজ করে গিয়েছেন। এবং নীরবে। এমনই স্থিতপ্রজ্ঞ তিনি।
তবে শুধু গল্পই নয়। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উৎসাহে ও অনুরোধে ‘চলন্তিকা’ অভিধানের কাজ শুরু করেন রাজশেখর বসু । সঙ্গে পান সুরেশচন্দ্র মজুমদার ও শৈলেন্দ্রকৃষ্ণ লাহাকেও। লক্ষ্য ছিল একটাই, বাংলা বানানের একটা আধার তৈরি করা। সেখানে স্থান পায় পরিভাষাও। এই বিশাল কাজে মতামতের জন্য চলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রমথ চৌধুরী, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতো মানুষদের কাছে। অবশেষে ২৬০০০ শব্দ নিয়ে প্রকাশিত হয় অভিধান ‘চলন্তিকা’। পরে এই শব্দসংখ্যা বেড়ে হয় ৩০০০০। সেই সঙ্গে ছিল পরিভাষার সমাহারও।
এর সঙ্গেই চলেছিল রামায়ণ-মহাভারতের অনুবাদ। নানা জটিলতা পেরিয়ে, সহজ সরল ভাষায় মহাকাব্যকে পরিবেশিত করেছিলেন তিনি। এই কাজটা করতে গিয়ে যাতে আসল আখ্যানটির কোনো ক্ষতি না হয়, সেটাও মাথায় ছিল। সব নিয়েই একটা আকর্ষণীয় জগৎ তৈরি করেছিলেন রাজশেখর বসু |
একইসঙ্গে নানারকম কাজ করতে পারতেন পরশুরাম। রান্না থেকে সেলাই থেকে বই বাঁধাই। এমনকি, অ্যাবাকাসের নির্মাণকর্তাও এই বাঙালী। সুরুচি, শৃঙ্খলা আর বুদ্ধির সংমিশ্রণে বাঙালী পরশুরামের জীবনটি ছিল এককথায় বিচিত্রের সমাহার। বিজ্ঞান ছিল প্রথম প্রেম, অথচ বাঙালী তাঁকে মনে রেখেছে রসসাহিত্যিক হিসেবে। নাদু মল্লিক থেকে বিরিঞ্চি বাবা – তাঁর সৃষ্ট অবিস্মরণীয় চরিত্রগুলি কৌতুকের মোড়কে খুলে দিয়েছে সমাজের অসাধুতা, ভণ্ডামির মুখোশ। তাঁর লেখার ধারে আজও মুগ্ধ বাঙালী।
Comments
Post a Comment