রবীন্দ্রনাথ

জীবনে এবং সাহিত্যে সমান সংযত শালীন এবং শোভন রবীন্দ্রনাথকে যে অসংখ্য কোটি সাধারণ মানুষ বিশ্বকবি জ্ঞানে বিপুল শ্রদ্ধা করার পরেও যতখানি গ্রহণ করার তা করতে পারেনি তার অনেকখানি দায়িত্ব কিন্তু রবীন্দ্র জীবন এবং সাহিত্যের যাঁরা অসাধারণ পাঠক, একান্তভাবে তাঁদেরই। রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে যারা বিশেষ অজ্ঞ তাদের ভ্রান্ত ধারণা অপনোদনে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্য ব্যাপারে যাঁরা বিশেষজ্ঞ তাঁরা প্রায়ই উদাসীন যে কেবল তাই নয়, তাঁদের কেউ কেউ আরও ভীতি উত্‍পাদনে তত্‍পর বরং এই বলে যে- আমরা লিখি তোমাদের জন্যে; আর রবীন্দ্রনাথ লেখেন আমাদের জন্যে। রবীন্দ্র-সাহিত্য সম্পর্কে এমন অলীক এবং অযৌক্তিক উক্তি কদাচ অন্য কোনও দেশে অন্য কোন কবিকর্ম সম্পর্কে শ্রুত হয়। অসাধারণ রবীন্দ্রনাথকে সর্বসাধারণের, বিদ্বজ্জনের রবীন্দ্র-সাহিত্যকে সর্বজনের জন্যে অবারিত করা রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞদেরও দায়িত্ব ও কর্তব্য হওয়া উচিত। সাধারণ লোক রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে যত ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে তার অনেকটাই অধ্যাপকদের দুঃসহ কাব্যবিশ্লেষণজাত। আর খানিকটা রবীন্দ্রনাথের রাজকীয় পরিবেশে জন্মগ্রহণ এবং অতিনাটকীয়তা এবং ভাবালুতা মুক্তির কারণে। রবীন্দ্রনাথ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র অতএব বাংলা দেশের চাষী-মজুরদের কথা, গ্রামের কথা, নিম্নবিত্ত নীচের মহলের কথা তাঁর জানবার নয়- এই মিথ্যা দূর করবার কাজে ব্রতী হওয়াও বিভিন্ন রবীন্দ্র-উত্‍সবের উপলক্ষ হওয়া সঙ্গত। রবীন্দ্রনাথ যে কেবলমাত্র কবি নন, বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকারদের একজন নন, প্রথমত- একথা সাধারণ বাঙালী পাঠক এখনও জানে না তার কারণ কোনও অসাধারণ পাঠক তাকে কখনই এ কথা বোঝবার অবকাশ দেয় নি যে, মানবজীবনের সুখ-দুঃখের কাহিনী কেবল কাঁদাবার জন্যে লেখা হয় না। মানবজীবনের গভীর আনন্দের এবং সুগভীর বেদনার প্রকাশ যে গল্পে সে ছোট হয়েও আসলে বড় কারণ তা মানুষকে বাইরে ঠেলে দেয় না, অন্তর্মুখী করে। যে মহত্‍ দুঃখে মানুষ ক্রন্দন করে না চিত্‍কার করে; সীমাহীন শূন্যতার সামনে দাঁড়িয়ে মুহূর্তে বাচাল হয় মূক; যে গভীর সুখে মানুষ সোল্লাসধ্বনি করে না; বসন্তের দিন চলে যাওয়ার আগে সূর্যালোকে মধুকরগুঞ্জরণে যেমন কাঁপে ছায়াতল তেমনই অব্যক্ত আনন্দের যে স্রোত শিরায় শিরায় রিমঝিম করে, সেই মহত্‍ দুঃখ-সুখের পৌষ-ফাগুনের পালাই রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে ছোট গল্পকেও মানবজীবনের সবচেয়ে বড় গল্পে উত্তীর্ণ করেছে॥

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ