নটী বিনোদিনী

| মঞ্চলক্ষী নটী বিনোদিনী দাসী |

ঊনিশ শতকের কলকাতার হাতিবাগান অঞ্চলের ১৪৫নং কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে নিজের দিদিমার খোলার বাড়িতে বিনোদিনী দাসী আনুমানিক ১৮৬৩ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তখন কয়েক ঘর গরিব ভাড়াটের সামান্য ঘরভাড়া ও অন্যের বাড়িতে কাজ করে তাঁর মা যা কিছু উপার্জন করতেন, সব মিলিয়ে অনেক দুঃখকষ্ট সহ্য করে অনেক অভাব-অনটনের মধ্যে দিয়ে কোনরকমে তিনি নিজের সংসার চালিয়েছিলেন..

এরপরে বালিকা অবস্থায় জীবিকানির্বাহের তাগিদে বিনোদিনী মাত্র এগারো-বারো বছর বয়সে কলকাতার গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে যোগ দিয়েছিলেন। হয় ১৮৭৪ সালের ২রা ডিসেম্বর তারিখে, আর নয়ত ১২ই ডিসেম্বর তারিখে হরলাল রায়ের ‘শত্রু-সংহার’ নাটকে পাণ্ডবদের প্রথম চরের ছোট্ট ভূমিকায় তিনি সর্বপ্রথম রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং ১৮৮৭ সালের ১লা জানুয়ারি বা ১২৯৩ বঙ্গাব্দের ১৮ই পৌষ তারিখে তিনি বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটারে গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘নল-দময়ন্তী’ ও ‘বেল্লিকবাজার’ নামক পঞ্চরঙে রঙ্গিণী চরিত্রে অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে তাঁর অভিনেত্রী জীবনের সমাপ্তি ঘটেছিল। বিভিন্ন নাট্য-গবেষকের প্রদত্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, মাত্র বারো বছরের অভিনেত্রীজীবনে তিনি পঞ্চাশটিরও বেশি নাটক, প্রহসন, গীতিনাট্য, পঞ্চরঙ ইত্যাদিতে ষাটটিরও বেশি ভূমিকায় অভিনয় করে বঙ্গরঙ্গালয়ের সর্বশ্রেষ্ঠা অভিনেত্রীরূপে সমাদৃতা হয়ে মাত্র তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সে থিয়েটার পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন..

তিনিই সেযুগের একমাত্র মঞ্চাভিনেত্রী ছিলেন, যিনি ঊনিশ শতকের কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত সবগুলি নাট্যশালাতেই অভিনয় করেছিলেন..

♦ তাঁর অভিনেত্রী জীবনের কালপঞ্জী নিম্নরূপ —

(১) ৬নং বিডন স্ট্রিটের গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার: ১৮৭৪ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ১৮৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত;
(২) ৯নং বিডিং স্ট্রিটের বেঙ্গল থিয়েটার: ১৮৭৭ সালের মার্চ মাস থেকে ১৮৭৭ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত;
(৩) ৬নং বিডন স্ট্রিটের ন্যাশনাল থিয়েটার: ১৮৭৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ১৮৮৩ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত; এবং
(৪) ৬৮নং বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটার: ১৮৮৩ সালের জুলাই মাস থেকে ১৮৮৭ সালের ১লা জানুয়ারি পর্যন্ত।

এগুলির মধ্যে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে তাঁর বাল্যজীবন অতিবাহিত হয়েছিল। এরপরে বেঙ্গল থিয়েটারে তিনি অভিনেত্রী হিসাবে প্রশংসিতা হলেও প্রতাপচাঁদ জহুরির ন্যাশনাল থিয়েটারে নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষের শিক্ষাগুণে প্রকৃতপক্ষে তাঁর খ্যাতি, প্রতিপত্তি ও প্রতিষ্ঠার ক্রমোন্নয়ন ঘটেছিল। আর পরিশেষে স্টার থিয়েটার প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান ও আত্মত্যাগ বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছিল। 

♦গবেষকদের মতে বিনোদিনীর অভিনীত উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি নিম্নরূপ ছিল —

(১) বেঙ্গল থিয়েটার: মৃণালিনীতে মনোরমা, কপালকুণ্ডলায় কপালকুণ্ডলা ও দুর্গেশনন্দিনীতে আয়েষা;
(২) ন্যাশনাল থিয়েটার: মেঘনাদবধ কাব্যে প্রমীলা, পলাশীর যুদ্ধে ব্রিটানিয়া, বিষবৃক্ষে কুন্দনন্দিনী, মায়াতরুতে ফুলহাসি, মোহিনী প্রতিমায় সাহানা, রাবণবধ নাটকে সীতা ও পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস নাটকে দ্রৌপদী; এবং
(৩) স্টার থিয়েটার: দক্ষযজ্ঞ নাটকে সতী, নল-দময়ন্তী নাটকে দময়ন্তী, চৈতন্যলীলা নাটকে নিমাই, বিবাহ-বিভ্রাট নাটকে বিলাসিনী কারফরমা, বুদ্ধদেব চরিত নাটকে গোপা, বিল্বমঙ্গল ঠাকুর নাটকে চিন্তামণি প্রভৃতি।

এগুলির মধ্যে চৈতন্যলীলা নাটকে নিমাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করা তাঁর জীবনের সর্বাপেক্ষা স্মরণীয় ঘটনা ছিল। এই অভিনয় করে তিনি মহাত্মা শিশিরকুমার ঘোষ, মহামহিমান্বিত পণ্ডিত ফাদার লাফোঁ, ভারতে থিওসফিক্যাল আন্দোলনের অন্যতম নেতা কর্ণেল অলকট, প্রখ্যাত ধর্মীয় নেতা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, নবদ্বীপের বিখ্যাত পণ্ডিত মথুরানাথ পদরত্ন প্রভৃতি অনেক দেশী-বিদেশী মনীষী ও জ্ঞানী-গুণীর আন্তরিক আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন। 

আর সর্বোপরি ১৮৮৪ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর বা ১২৯১ বঙ্গাব্দের ৬ই আশ্বিন তারিখে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব চৈতন্যলীলা নাটকে বিনোদিনীর অভিনয় দেখবার পরেই প্রথম সাক্ষাতে তাঁর মস্তক স্পর্শ করে ‘তোমার চৈতন্য হোক’ বলে স্নেহাশীর্বাদে তাঁকে চিরকৃতার্থ করেছিলেন। এরপরে এই মধুর স্মৃতিই তাঁর জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন এনে দিয়েছিল এবং তিনি পরমহংসদেবের পতিতপাবন ভাগবত্তায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন।

একারণেই, পরবর্তীসময়ে গলরোগে অসুস্থ হয়ে কলকাতার ৫৫নং শ্যামপুকুর স্ট্রিটের ভাড়াবাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণদেব যখন বসবাস করছিলেন, বিনোদিনী তখন তাঁর গৃহীভক্ত কালীপদ ঘোষের পরামর্শে তাঁর সঙ্গে একজন ইউরোপীয় সাহেবের ছদ্মবেশে এই বাড়ির দ্বাররক্ষক নিত্যনিরঞ্জন ঘোষের (সন্ন্যাসজীবনে স্বামী নিরঞ্জনানন্দ) চোখে ধূলো দিয়ে ১৮৮৫ সালের ১০ই অক্টোবর বা ১২৯২ বঙ্গাব্দের ২৫শে আশ্বিন তারিখে তাঁকে শেষবারের জন্য দর্শন ও প্রণাম করেছিলেন..

১৮৮৭ সালের ১লা জানুয়ারি তারিখে অভিনেত্রী-জীবন শেষ করবার পরে বিনোদিনী উত্তর কলকাতার শেষপ্রান্তে অবস্থিত প্রাসাদপ্রতিম অট্টালিকায় নিজের বধূজীবন যাপন করতে শুরু করেছিলেন। তখন উদারহৃদয় আশ্রয়দাতার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ও অপরিসীম বদান্যতায় তাঁর অতীতের সমস্ত দুঃখময় স্মৃতি একে একে বিদূরিত হয়ে গিয়েছিল। এরপরে ১৮৯১ সালে তাঁর একমাত্র কন্যা শকুন্তলার জন্ম হয়েছিল, যাঁর ডাকনাম ছিল কালো। এসময় থেকে সাংসারিক আনন্দে তাঁর অন্তর কানায় কানায় ভরে উঠেছিল। কিন্তু এরপরেই মাত্র তেরো বছর বয়সে ১৯০৪ সালের ১০ই মার্চ বা ১৩১০ বঙ্গাব্দের ২৭শে ফাল্গুন তারিখে এই কন্যার আকস্মিক মৃত্যু তাঁর সেই সাময়িক আনন্দোজ্জ্বল জীবনকে পুনরায় বেদনায় ভারাক্রান্ত করে তুলেছিল। আর কন্যার অকালপ্রয়াণের পরে যাঁকে কেন্দ্র করে তাঁর বিষাদাতুর জীবন তখন অতিবাহিত হচ্ছিল, সেই সর্বশেষ আশ্রয়দাতাও ১৯১২ সালের ২৭শে মার্চ বা ১৩১৮ বঙ্গাব্দের ১৪ই চৈত্র তারিখে রামনবমী তিথিতে পরলোকগমন করেছিলেন। বলাই বাহুল্য যে, আশ্রয়দাতার জীবনাবসানের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পরের দিনই তাঁকে সেই বিরাট প্রাসাদচ্যুত হয়ে পুনরায় কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে অবস্থিত তাঁর দিদিমার পুরোনো বাড়িতে ফিরে যেতে হয়েছিল।

অভিনয় ছাড়াও, ঊনিশ শতকের বাংলার একজন মহিলা কবি ও সাহিত্যিক হিসেবে বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে বিনোদিনীর ঐতিহাসিক অবদান উল্লেখযোগ্য হলেও সেযুগের ব্রাত্য-সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করবার জন্য তিনি এবিষয়ে আজও উপযুক্ত স্বীকৃতি পাননি...

বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্যাবলী থেকে জানা যায় যে, স্টার থিয়েটারে অভিনয় করার সময়েই ১২৯২ বঙ্গাব্দে ‘ভারতবাসী’ নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় তিনি প্রায় নিয়মিতভাবে বঙ্গরঙ্গালয় সম্পর্কে বিভিন্ন চিঠিপত্র লিখেছিলেন। এরপরে ১৩০৩ বঙ্গাব্দে ‘বাসনা’ নামে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থটি মুদ্রিত হয়েছিল, যাতে চল্লিশটি বিভিন্ন খণ্ড কবিতা ছিল। তাছাড়া এই একইবছরে তাঁর লিখিত ‘আভা’ নামের একটি আখ্যায়িকা কাব্য বা কাব্যোপন্যাসও প্রকাশিত হয়েছিল। এরপরে ১৩১২ বঙ্গাব্দে ‘কনক ও নলিনী’ নামে তাঁর দ্বিতীয় ও শেষ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল, এটিও একটি কাব্যোপন্যাস বা আখ্যায়িকা কাব্য ছিল। নিজের একমাত্র কন্যার অকালমৃত্যুর পরে তিনি এই কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেছিলেন ও এটিকে তাঁর নামেই উৎসর্গ করেছিলেন।

তবে শুধু কাব্য নয়, বিনোদিনী তাঁর অভিনয়জীবনকে কেন্দ্র করে দুটি আত্মজীবনীও লিখেছিলেন, যা আজও বাংলা নাট্যশালার প্রাথমিকপর্বের ইতিহাসের আকরগ্রন্থ হিসাবে চিরস্মরণী ও স্বীকৃত হয়ে রয়েছে। এরমধ্যে তাঁর প্রথম আত্মজীবনী—‘আমার কথা বা বিনোদিনীর কথা’–র প্রথম খণ্ডটি ১৩১৯ বঙ্গাব্দে প্রথমবারের জন্য মুদ্রিত হয়েছিল, এবং পরের বছর, অর্থাৎ—১৩২০ বঙ্গাব্দে এটির একটি নব সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। এরপরে তাঁর দ্বিতীয় আত্মজীবনী—‘আমার অভিনেত্রী জীবন’, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও নির্মলচন্দ্র চন্দ্র দ্বারা সম্পাদিত হয়ে ‘রূপ ও রঙ্গ’ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রথম বর্ষে ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ৪ঠা মাঘ থেকে ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ২৬শে বৈশাখ পর্যন্ত মোট এগারটি সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে মুদ্রিত হয়ে অসম্পূর্ণ অবস্থায় শেষ হয়েছিল।

সমকালীন বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে, বিনোদিনীর শেষজীবন খুব দুঃখে অতিবাহিত হয়েছিল..

এসময়ে তাঁর আপনজন বা আত্মীয় বলতে কেউ ছিলেন না। তখন তিনি সকালে গঙ্গাস্নান ও দুপুরে পূজাপাঠ সেরে সন্ধ্যাকালে কখনও হাতিবাগানের নতুন স্টার থিয়েটারে তো আবার কখনও রাজা রাজকৃষ্ণ স্ট্রিটে অবস্থিত রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠে যেতেন। এসময়ে তিনি নিজের বাড়িতে একটি রাধা-গোবিন্দ যুগলমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করে নিজের সমস্ত সম্পত্তিকে দেবোত্তর সম্পত্তিতে রূপান্তরিত করে দিয়েছিলেন; আর নিজের মৃত্যুর কয়েক বছর আগে থেকে তিনি গেরুয়া কাপড় পরিধান করতে শুরু করেছিলেন। 

অবশেষে ১৯৪১ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি বা ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের ২৯শে মাঘ তারিখে মাঘীপূর্ণিমার শেষ রাতে ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গরঙ্গালয়ের সর্বশ্রেষ্ঠা অভিনেত্রী ও নায়িকা, সম্ভ্রান্ত পরিবারের ভাগ্যবিড়ম্বিতা গৃহবধূ, সেকালের ব্রাত্যসমাজভূক্ত প্রতিভাময়ী লেখিকা, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আশীর্বাদধন্যা ও মঞ্চলক্ষী নটি বিনোদিনী সকলের অজ্ঞাতে আটাত্তর বছর বয়সে এই পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চ থেকে অবসর গ্রহণ করেন..🌷

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ