সাবিত্রী
সাবিত্রী-১
মদ্রদেশে অশ্বপতি ছিল মহীপাল।
সন্তান বিহীন রাজা নিরানন্দ মতি।
পুত্রহেতু শিব সেবা করে বহুকাল।
বহুদিন পরে হলো, কন্যা রূপবতী।
শ্বেতবর্ণ তনু তার শরীরের শোভা।
বিহঙ্গম-চঞ্চু সম, প্রকাশিছে নাসা।
ধনুকের মত ভুরূ অতি মনোলোভা
দু আঁখি দেখিলে মনে, ধরে যাবে নেশা।
শুদ্ধমতি সর্বকার্যে অতি সে প্রবীণা।
সুপ্রিয়বাদিনী সতী, ভারি দয়া মায়া।
সুকোমল ইন্দ্রধনু, অপার করুণা।
অশ্বপতি হৃষ্টমতি দেখিয়া তনয়া।
সর্বদা পবিত্রা কন্যা, পবিত্র আচার।
সাবিত্রী রাখিল নাম, বিচারি তাহার।
সাবিত্রী-২
দিনে দিনে বাড়ে কন্যা, পিতার মন্দিরে।
প্রিয় সখীগণ লয়ে, আনন্দে উৎসবে।
স্বচ্ছন্দে ভ্রমনে যায়, যেথা ইচ্ছা করে।
ভ্রমণ করিছে সুখে, সুন্দর এ ভবে।
উপনীত হলে গিয়া, মুনির আলয়।
বিবিধ কৌতুক দেখে, অশ্বপতি-সুতা।
রূপে গুণে সবদিকে, পাইল প্রশ্রয়।
খুশিতে মগন হয়ে, কহে নানা কথা।
হাসিতে ঝরিছে রত্ন, খুশি অশ্বপতি।
বিদ্যাশিক্ষা জ্ঞানশিক্ষা, সব দিল তারে।
ধৈর্য স্নিগ্ধ গুরুজ্ঞান, আর রীতিনীতি।
শিশুকাল হতে কন্যা, সব নিলো ধরে।
ষোড়শী রূপসী কন্যা, ভারি জ্ঞানবতী
দেখিয়া তাহার রূপ, খুশি অশ্বপতি।
সাবিত্রী-৩
দ্যুমৎসেন নামে জেনো অবন্তীর পতি।
তাহার নন্দন ছিল, নাম সত্যবান।
পুত্র সহ দ্যুমৎসেন, বনেতে বসতি।
শত্রু নিলো রাজ্য তাই, দরিদ্র সমান।
মুনি পুত্রগণ সহ, ক্রীড়া করে বনে।
সাবিত্রী থাকিয়া দূরে, দেখিল তাহারে।
কন্দর্প সমান রূপ, মুনিপুত্র সনে।
দেখিয়া নরেন্দ্র সুতা, জিজ্ঞাসিল তারে।
কাহার নন্দন তুমি, কেন এই স্থান।
রূপে সমুজ্জ্বল এই, স্নিগ্ধ তপোবন।
দ্যুমৎসেনের পুত্র, আমি সত্যবান।
সাবিত্রী শুনিয়া কথা, ভারি খুশি হন।
মনেতে ধরিয়া তারে, মানে নিজ পতি।
গৃহেতে আসিয়া তবে, শুনিল নৃপতি।
সাবিত্রী-৪
শুনিয়া কহিল রাজা, দুঃখিত অন্তরে।
কোন্ বংশে জন্ম তার, কিবা তার ধর্ম।
এইরূপে ছিল রাজা, রাজ সভাঘরে।
না জানি কেমনে রাজা করে হেন কর্ম।
এক দিন উপনীত, ব্রহ্মার নন্দন।
নারদ মুনিরে দেখি, খুশি সর্বজনে।
বসালেন সিংহাসনে, হয়ে সুখীমন।
ভারি খুশি নরপতি, মুনি আগমনে।
আনন্দে বসিল সবে কথোপকথনে।
সহসা সাবিত্রী আসে সেই সভা কক্ষে।
কন্যা দেখি নৃপতিরে, কহে সভাস্থানে।
কাহার নন্দিনী তুমি, এলে সভাকক্ষে।
কহে রাজা নারদেরে, কি কহিব আর।
রূপসী রমণী সম, এ কন্যা আমার।
সাবিত্রী-৫
মুনি বলে, সুলক্ষণা, তোমার দুহিতা।
বিবাহ দিয়াছ কিনা, তনয়া তোমার।
রাজা বলে, শিশুমন নয় বিবাহিতা।
কেমনে বিবাহ দিবো, মনে বড় ভার।
বরিয়াছে মনে মনে এই তপোবনে।
ভালো হল ভাগ্যবশে আসিলে আপনি।
ঘুচিল মনের ধন্দ, আজ এই ক্ষণে।
কহিলে তাহার বংশ, আমি তবে জানি।
নারদ কহেন তবে, সাবিত্রীর প্রতি।
কোন বংশে জন্ম তার, কাহার কোঙর।
সাবিত্রী কহিল, দেব মনে দিলো প্রীতি।
সত্যবান নাম তার, জানি না বিস্তর।
দ্যুমৎসেনের পুত্র তিনি কহিল নারদ,
আমি জানি সবকিছু, হইবে বিপদ।
সাবিত্রী-৬
এরে ছাড়ি তুমি ভাবো, অন্য কোনো বর।
সাবিত্রী কহিল, পূর্বে বরিয়াছি মনে।
কেমনে ছাড়িব প্রভু, এ নয় যে পর।
অন্যে বরি ভ্রষ্টা হব, কিসের কারণে।
মুনি বলে, দোষ নাই, শুনো মোর কথা।
ভবিষ্যত দর্শি আমি, কেমনে এ মানি।
সাবিত্রী কহিল, মুনি না হবে অন্যথা।
ব্যস্ত হয়ে, জিজ্ঞাসিল মদ্র নৃপমণি।
কেবা এই সত্যবান, কোথা তার ঘর।
তাহার বৃত্তান্ত শুনি, কহ মহামুনি।
কি হেতু বরিতে বল অন্য কোন বর।
কোন্ বংশে জন্ম তার কেমনে তা জানি।
কহ শুনি মুনিবর, কাহার নন্দন।
কৃপাবশে তপোধন, কহিল বচন।
সাবিত্রী-৭
সূর্য্যবংশে শূরসেন রাজার সন্তান।
দ্যুমৎসেন নামে রাজা অবন্তীর পতি।
মহিমা সাগর রাজা, মহা গুণবান।
পৃথিবীতে নাহি শুনি, গুণে মহামতি।
খণ্ডিতে না পারে রাজা, দৈবের কারণ।
ফলে সেই নৃপতির, সব অন্ধকার।
চক্ষুহীন শিশু পুত্র, নাহি অন্য জন।
সুযোগ পাইয়া রাজ্য, নিলো সব তার।
ভার্য্যা পুত্র সহ সবে করে বনবাস।
মহাক্লেশে আছে সবে, ভীষণ দুর্ভোগ।
শরীর ধরিলে হয়, বিধাতা নিরাশ।
বিচার করিয়া দেখো, দৈবের সংযোগ।
রাজা বলে, চরিতার্থ করি তপোধন।
এই চিন্তা করি সদা, নিরানন্দ মন।
সাবিত্রী-৮
সুখ দুঃখ এ সংসারে জন্মে একসাথে।
সময়ে প্রবল হয়, দুঃখ বলবান।
আপন কর্মের ফল, ফলে হাতে নাতে।
যোগ্য বর মানি বটে, সেই সত্যবান।
আজ্ঞা করো, মুনিবর, করি তাঁরে দান।
মুনি বলে, তাতে মানা করিয়াছি আমি।
বারেবারে প্রশ্ন করো, মূর্খের সমান।
কুলে শীলে রূপেগুণে, শ্রেষ্ঠ যে ভূস্বামী।
সকল সুন্দর বটে, কষ্ট তবু হয়।
আজি হতে যেই দিনে বর্ষ পূর্ণ হবে।
সেই দিন সত্যবান, মরিবে নিশ্চয়।
করিনু ভবিষ্য বানী, মিলিয়ে দেখিবে।
ভেবেচিন্তে কন্যাদান করো অন্য জনে।
নহিলে বিপদ হবে, ভাবিও এক্ষণে।
সাবিত্রী-৯
শুনিয়া মুনির মুখে, এতেক কথন।
অশ্বপতি নরপতি, কহিতে লাগিল।
কথা মত এই কর্ম, করিব এখন।
শিশুর ক্রীড়ায় মন, কেন ভরে ছিল।
ধনে মানে কুলে শীলে হবে গুণবান।
রাজ রাজ্যেশ্বর হবে, এমন খুঁজিব।
বিচার করিয়া তারে দিবো কন্যাদান।
দোষ না থাকিবে আর, খুশিতে রহিব।
তাহে যদি মনে নহে, হবে স্বয়ম্বর।
আনাইব পৃথিবীর, যত নৃপমনি।
সেথায় বরিবে কন্যা, দেখে পরস্পর।
কেন বা বরিবে যার, অল্প দিনমনি।
কি হেতু বরিবে অল্প আয়ু সত্যবান।
এমন বৈধব্য দুঃখ, মরণ সমান।
সাবিত্রী-১০
যখন হৃদয়ে তাঁরে বরিয়াছি আমি।
শুনহ জনক মোর, সত্য নিরূপণ।
জীবনে মরণে সেই সত্যবান স্বামী।
কদাপি নয়নে নাহি হেরি অন্যজন।
বৈধব্য যন্ত্রণা যদি, থাকে মোর ভোগ।
খণ্ডণ না যাবে পিতা, দৈবের কারণ।
অবশ্যই এ সংসারে, হইবে সংযোগ।
না মরিয়া চিরজীবী, আছে কোনজন।
কি করিবে সুখ পিতা, ক্ষণিক জীবন।
কু-কর্ম আজন্মকাল নরকে থাকিব।
এত শুনি ধন্য ধন্য করে তপোধন।
কহ পুত্রী কি বলিয়া, আশীর্বাদ দিবো।
অশ্বপতি দুঃখ অতি পাইল অন্তরে।
কহিল অনেক কথা সাবিত্রীর তরে।
সাবিত্রী-১১
একান্ত বুঝিয়া রাজা তনয়ার মন।
বিধিমতে পরিণয় দেন নরপতি।
সত্যবান গেল তবে, গৃহেতে তখন।
পুত্রের বিবাহ শোনে অবন্তীর পতি।
হরষে বিষাদ মন, কহে রাজা রাণী।
বনেতে নিবাস করি তপস্বীর বেশে।
বধূ মম অশ্বপতি, নৃপতি-নন্দিনী।
কিরূপে রহিবে বধূ, এই পরিবেশে।
সাবিত্রী দেখিতে যত আসিল ব্রাহ্মণী।
অনেক প্রশংসা করি, কহে সর্বজন।
তুমি রাজা মহাসাধু, ভাগ্যবতী রানী
সমানে সমানে বিধি, করিল মিলন।
লক্ষ্মীর লক্ষণ দেখি, ইহার শরীরে।
এত বলি সবে গেল নিজ নিজ পুরে।
সাবিত্রী-১২
পরম আনন্দ মনে রহে চারি জন।
নিত্য নিত্য সত্যবান বনে প্রবেশিয়া।
ফল মূল আনি খায়, তারা চারজন।
শ্বশুর শাশুড়ী সেবা, করে মন দিয়া।
লক্ষ্মীর সমান সতী ভারি পতিব্রতা।
যত্নে আচরিল সতী নানাবিধ ধর্ম।
নিত্য নিয়মিত পূজে ব্রাহ্মণ দেবতা।
নিত্য আচরিল যত নানাবিধ কর্ম।
হেনমতে যায় মাস, ঘুরিল বছর।
আরম্ভ করিল ব্রত করে প্রণিপাত।
জ্যৈষ্ঠ মাসে চতুর্দ্দশী, কৃষ্ণপক্ষ ঘর।
লক্ষ্মী নারায়ণে সতী পূজে দিবারাত।
শুদ্ধভাবে একমনে বসিয়া সুন্দরী।
অনায়াসে কাটিলেন দিবস শর্বরী।
সাবিত্রী-১৩
প্রভাতে উঠিয়া সতী হয়ে সযতন।
সত্যবানের বৎসর পূর্ণ সেই দিনে।
আশীর্বাদ করি গেল যত দ্বিজগণ।
তাহাতে নৃপতি সুতা চিন্তাকুল মনে।
নিত্য নিত্য সত্যবান প্রবেশিয়া বনে।
ফল মূল কাষ্ঠ যত করে আহরণ।
করণ্ড কুঠার নিলো আপনার সনে।
রাণী বলে, ওহে পুত্র শোনো দিয়া মন।
এমন সময়ে বনে না করো প্রবেশ।
সত্যবান বলে, মাতা করিও না ভয়।
এখনি আসিব মাতা, জানিবে বিশেষ।
এই বলে চলিলেন, রাজার তনয়।
সাবিত্রী পাইয়া বার্তা, দেখে অন্ধকার।
শোকাকুলা গৃহবধু, করে হাহাকার।
সাবিত্রী-১৪
শীঘ্রগতি গেল তবে পতি যায় যেথা।
নৃপতি শুনিয়া কহে, নিষেধ বচন।
সাবিত্রী নিষেধ নাহি মানিলেন সেথা।
ওহে বধূ, চিন্তা করো কিসের কারণ।
কি কারণে কষ্টে করে যাবে তুমি বন।
দুই দিন হলো তুমি, আছো উপবাসী।
ভোজন করিও ঘরে, শুনহ বচন।
করযোড়ে কহে বধু, তবু আমি আসি।
আসিয়া পশ্চাতে আমি করিব ভোজন।
আজ্ঞা দেহো ঠাকুরাণী দেখে আসি তারে।
দেখিয়া বনের শোভা শান্ত করি মন।
আনন্দে স্বামীর সনে, ফিরিব এ ঘরে।
সাবিত্রীর অভিলাষ বুঝে রাজরাণী।
নিবৃত্ত হইল, শেষে, না কহিল বাণী।
সাবিত্রী-১৫
মুনিবাক্য মনে করি নৃপতির সুতা।
না জানি কেমনে হবে পতির মরণ।
সত্যবান নাহি জানে, এত সব কথা।
সুখে তুলে ফলমূল করিয়া ভ্রমণ।
পরিপূর্ণ হলো তার, ফুল সাজি খানি।
রাখিয়া আঁকশি সাজি সাবিত্রীর কাছে।
ওঠে গাছে সত্যবান, কাষ্ঠ দেবে আনি।
কুঠারে কাটিয়া পড়ে ডাল পালা নিচে।
উপস্থিত হলো আসি ক্রমে মৃত্যুকাল।
অকস্মাৎ শিরঃপীড়া করিল অস্থির।
সহস্র নাগেতে যেন দংশিল কপাল।
সত্যবান বলে শুনো, ফেটে যায় শির।
দশদিক অন্ধকার দেখি অকস্মাৎ।
সহস্র সহস্র শেল মারিছে নির্ঘাত।
সাবিত্রী-১৬
বুঝিতে না পারি কিবা হলো দেবমায়া।
প্রাণ পাখি যায় বুঝি, ভারি শিরোব্যথা।
নিস্তার নাহিক আর, সব দেখি ছায়া।
সাবিত্রী কহিল, আমি জানি পূর্ব কথা।
এক কথা বলি আমি, শুনো দিয়া মন।
বৃক্ষ হতে শীঘ্র তুমি, আসিবে ঠাকুর।
অচেতন হলো নেমে, রাজার নন্দন।
ক্রমে ক্রমে আয়ু শেষ, করিল ঈশ্বর।
দেখিয়া নৃপতি-সুতা ভাবে মনে মনে।
অবশ্য আসিবে হেথা, কৃতান্ত কিঙ্কর।
আবেদন করি যদি, তাহার চরণে।
দেখিব কেমনে লয়, আমার ঈশ্বর।
সাবিত্রী এতেক ভাবি রহে ঘোর বনে।
সেথায় ডাকিল যম, যত দূতগণে।
সাবিত্রী-১৭
তমসা রজনী ব্যাপি, ঘেরিল ধরণী,
দেখে পরমাদ গণি, ভাসাইল তরী।
কোলেতে স্বামীর দেহ, বসিয়া রমণী
আঁধার বনানী আর, অন্ধকার গিরি।
দুর্গম কান্তার গিরি, বিকট আকার।
চলেনা ফেরেনা কেউ, একাকী বেচারি।
ঘোর অন্ধকারে একা, নাই হাহাকার।
নাই মানবের রব, নাই হেথা নারী।
গর্জন করিছে পশু ঘন অন্ধকারে।
বৃক্ষের পল্লব পড়ে, সেথা ক্ষণে ক্ষণে।
কখন পাখীর ডানা, ঝটপট করে।
ভয়েতে সুন্দরী একা, পতি দেহ টানে।
পরশে অধরে নারী, অনুভব করে।
নীরবে কাঁদিয়া চুম্বে, মৃতদেহ ধরে।
সাবিত্রী-১৮
আচম্বিতে ভয়ঙ্কর আঁধার আঁচড়ে।
একলা রমণী দেখে, আকাশের পানে।
যত ছিল আলোকেরা, সেই স্থান ছাড়ে।
ম্লান হয়ে গেল সব, ভীষণ অরন্যে।
আঁধারে শৃগাল কাঁদে, বিপদ এখন।
পালায় শ্বাপদ দল, ওঠে পদধ্বনি।
ভাঙে কত বৃক্ষশাখা, অকালে মরণ।
মৃতদেহ ধরে সতী, কাঁদিছে রমণী
মহাসতী শব ধরে করে আলিঙ্গন।
পচাগলা শব লয়ে, একাকী রমণী।
সহসা উজ্জ্বল হলো ঘোর ঘন বন।
মহাগদাপ্রভা যেন প্রকাশে ধরণী।
দেখিয়া সাবিত্রী কহে, ওহে মহাবলী।
কে তুমি আলোক মালা, এলে বনস্থলী।
সাবিত্রী-১৯
মহাগদা দেখি তাঁর, প্রণমিলা সতী।
জানিল কৃতান্ত সব, পতি পরলোকে।
কি ভীষণ আলো ছায়া, তাহার মূরতি।
ভাগ্যে যাহা আছে লেখা, ঘটিবে ভুলোকে ।
গভীর অরণ্যে ডাকি, কহিল শমন।
থর থর ধড়পড়, হৃদয়ে তা বাজে।
পর্ব্বতগহ্বরে তবে, ধ্বনিল বচন,
চমকিল পশুপক্ষী ধরণীর মাঝে।
কেন একাকিনী বনে, মানবনন্দিনী,
শব লয়ে কোলে কেন যাপিছ যামিনী,
ছাড়ি দেহো স্বামী শবে ওহে বিনোদনী,
সত্যবানে মহাকাল, পরশিল মানি।
সাধ্বী অঙ্গ ছুঁয়ে তবে লইতে নারিল।
নিজেই এসেছি আমি বেলা যে পড়িল।
সাবিত্রী-২০
সব হলো বৃথা তার শুনিল না কথা।
নাহি পারে পরশিতে সাধ্বী পতিব্রতা।
না ছাড়ে সাবিত্রী সতী শবের মমতা।
অধর্মের ভয়ে ধর্ম, পাইলেন ব্যথা।
তখন কৃতান্ত কহে শোনো একবার।
কেহ কারো নয় দেবী পুত্র কন্যা পতি।
অনিত্য জানিও দেবী, ছার সংসার।
আমার আলয়ে আসা, সকলের গতি |
রত্নছত্র শিরে তার রত্নভূষা অঙ্গে।
মহাতেজ বিচ্ছুরিছে সম্মুখে তাহার।
রত্নসিংহাসনে বসি মহিষীর সঙ্গে।
বীরদর্পে ভাঙ্গি লয় বহু শক্তি যার।
রূপ নষ্ট করি লয়, কত রূপসীর।
জ্ঞানলোপ করেছেন গরাসি জ্ঞানীর।
সাবিত্রী-২১
করো নিজ পূন্য কর্ম, কর্মই আসল।
দেহান্তে সবার হবে, সঠিক বিচার।
দেহি আমি সকলেরে তার কর্মফল।
যত দিনে সতী তব আয়ু হবে পার।
করি পুণ্য কর্ম এসো স্বামীর জগতে।
অনন্ত যুগান্ত রবে তার কাছে কাছে।
অনন্ত যৌবন পাবে, অনন্ত বসন্তে।
অনন্ত প্রণয় প্রীতি, সেথা রাখা আছে।
রবি তথা আলো করে, না করে দহণ।
নাহিক কণ্টক সেথা, কুসুম কাননে।
নিশি স্নিগ্ধকরী তাহে তিমির বরণ,
মৃদু গন্ধবহ ভিন্ন, নাহিক পবনে।
নাহিক তরঙ্গ স্বচ্ছ কল্লোলিনীগণে।
নাহিক অশনি সেথা সুবর্ণের ঘনে।
সাবিত্রী-২২
তাই বলি কন্যে তুমি, ছাড়ি দেহ মায়া,
ধর্ম আচরণ করো, গিয়া পুণ্যধাম।
ত্যজ বৃথা ক্ষোভ সতী, ত্যজ পতিকায়া।
গৃহে যাও ত্যজি দেহ, সিদ্ধ হবে কাম |
শুনে যমবাক্য সতী জোড় করে পাণি,
ছাড়ি দিয়া স্বামী দেহ, তোলে মুখ ম্লান।
ডাকিয়া সাবিত্রী কহে, কোথায় না জানি,
ওহে কাল দেখা দিয়া, রাখ মোর প্রাণ।
কোথা গেলে পাব আমি, কালের সন্ধান।
কায় মনে যদি আমি পূজে থাকি স্বামী।
পরশিয়ে করো প্রভু সঙ্কটের ত্রাণ।
সতীত্বের পুণ্যফল দেহো অন্তর্য্যামী।
সতীত্বে যদ্যপি থাকে কোনো পুণ্যফল।
সতীত্বে যদ্যপি থাকে সত্যি কোন বল।
সাবিত্রী-২৩
নিয়মের রথ এসে ঘোষিল ভীষণ।
পরশিল মহাকাল, তারে ধীরে ধীরে।
আসি প্রবেশিল সেই, ভীমের কানন।
সতীত্ব রতন হায়, চমকে তিমিরে।
সত্যবানে আনিবারে কহে ধর্মরাজ।
যেথায় কাননে পড়ি, নৃপতি নন্দন।
আজ্ঞাতে আসিল শীঘ্র দূতের সমাজ।
তাহার নিকটে গেল যম দূতগণ।
পরশিতে না পারিল সাবিত্রীর তেজে।
দূত-মুখে ধর্মরাজ পাইয়া বারতা।
নিরস্ত হইয়া দূত, কহে ধর্মরাজে।
আপনি আসিল শীঘ্র সত্যবান যথা।
দেখিয়া সাবিত্রী বলে, তুমি কোন্ জন।
ধর্ম রাজ বলে, আমি সবার শমন।
সাবিত্রী-২৪
এই বুঝি, স্বামী তব, মৃত সত্যবান।
কালপূর্ণ হলো আজ, কি করিব আর।
শুনিয়া সাবিত্রী কহে, আজ্ঞা ভগবান ।
বিধির বিধান লঙ্ঘে, শক্তি আছে কার।
মায়াতে মোহিত সব, কেবা কার পতি।
এতেক কহিয়া সতী ছাড়ে সত্যবানে।
করজোড়ে রহিলেন যমের সংহতি।
সত্যবান পাশে আসি, বিবিধ সম্মানে।
তবে সূর্য্যসুত তার শরীর হইতে।
লয় অদ্ভূত পুরুষ অঙ্গুষ্ঠ সমান।
দেখিতে সুন্দর রূপ, ধরে অঙুলিতে।
বন্ধন করিয়া ধর্ম, করিলে প্রস্থান।
দেখিয়া পতির দশা, হয়ে দুঃখমতি।
কিছু না কহিয়া চলে, যমের সংহতি।
সাবিত্রী-২৫
দেখিয়া কৃতান্ত তবে, জিজ্ঞাসিল তারে।
কেন তুমি, কি কারণ, আমার সংহতি।
বিধির বিধান মতে, নর দেহ ছাড়ে।
কালেতে মরণ হলে, লয়ে যাই পতি।
তার জন্য বৃথা চিন্তা করো কি কারণ।
জগতে নিয়ম আছে, কালপূর্ণ হলে।
সবে ধরে মৃত্যুপথ, এমনি ধরণ।
এখনো কহিনু আমি, ঘরে যাও চলে।
ধর্মরাজ মুখে শুনি, এমন উত্তর।
রাজার নন্দিনী কহে, যে কিছু কহিলে।
পূর্বে সব কথা আমি, জেনেছি বিস্তর।
কেহ নহে চিরজীবী, মরিবে সকলে।
এইমত বিশ্বমাঝে আছে যত জন।
জনম লভিলে হয় অবশ্য মরণ।
সাবিত্রী-২৬
ভারি তুষ্ট হয়ে বলে, মৃত্যুর বিধাতা।
পৃথিবীতে সাধ্বী তুমি, রাজার নন্দিনী।
তোমার জননী ধন্যা, ধন্য তব পিতা।
বর লহ গুণবতি, তুষ্ট হবে মানি।
সত্যবানে ছাড়ি তুমি মাগো কোনো বর।
সাবিত্রী কহিল, যদি কৃপা করো দান।
স্বামী ছাড়া বর লব, তোমার গোচর।
অপুত্রক আছে পিতা, পুত্র করো দান।
যম বলে, তারে আমি, দিনু পুত্রবর।
যাও শীঘ্রগতি তুমি আপনার বাস।
সাবিত্রী কহিল শুনো সূর্যের কোঙর।
সত্যের সংসর্গে জানি স্বর্গেতে নিবাস।
আমারে করিতে চাহ ইহাতে নিরাশ।
পূর্ব পিতৃ পুণ্যবলে, এমন প্রকাশ।
সাবিত্রী-২৭
জানিনু আমার বাম, বিধাতা নিশ্চয়।
এত শুনি তুষ্ট হয়ে বলে মৃত্যুপতি।
অমৃত অধিক শুনি তোমার প্রত্যয়।
পুনঃ পুনঃ মহানন্দ জন্মিছে প্রগতি।
বর মাগো, আরকিছু, ছাড়ি সত্যবান।
সাবিত্রী কহিল, যদি কৃপায় অপার।
শ্বশুর আছেন অন্ধ, চক্ষু করো দান।
শমন কহেন চক্ষু, পাবেন আবার।
রজনী অধিক হয়, যাও নিজ ঘর।
রাজার নন্দিনী কহে, সব জানো তুমি।
সংসার বাসনা কভু, করে না অধর।
ঘরদোর পুত্র বন্ধু, নাহি চাহি আমি।
আজ্ঞা কর, সদা যেন ধর্মে রহে মতি।
ইহা শুনি তুষ্ট হয়, যম মৃত্যু পতি।
সাবিত্রী-২৮
পরম সুশীলা তুমি রাজার নন্দিনী।
তব বাক্যে হর্ষ পূর্ণ হল মোর মন।
পতি প্রাণ বিনা বর মাগো বিনোদিনী।
সাবিত্রী কহিল, বর মাগিব শমন।
রাজ্যহীন শ্বশুরের দিয়ো রাজ্য ধন।
যম বলে, হৃত রাজ্য পাবে নৃপবর।
বিলম্বে নাহিক কার্য, যাও গো ভবন।
সাবিত্রী কহিল, শুনো করিব গোচর।
অবশ্য হইবে যাহা, বিধির লিখন।
মায়াতে মোহিত সবে সত্যপথ ত্যজে।
আমার আমার করি কহে সর্বজন।
মিথ্যা ঘর পরিবারে সকলে যে মজে।
বান্ধব শ্বশুর নারী পুত্র পিতা মাতা।
অনর্থের হেতু সব মহা দুঃখদাতা।
সাবিত্রী-২৯
এ সব পালন হেতু ত্যজে নিজ ধর্ম।
ভরণ পোষণ করে কুকর্ম করিয়া।
নিজ অঙ্গে রোগভোগ, করিবে কুকর্ম।
নয়ন থাকিতে অন্ধ, জীবন ভরিয়া।
বিধির বিধানে সেই বৃক্ষপত্র খায়।
যথাকালে আপনার পায় কর্ম ফল।
জানিয়া তবুও তারা বহু সুখ পায়।
বিপরীত বুদ্ধি হয়, কাল টলমল।
সুখেতে থাকিবে হেন ভাবিয়া অন্তরে।
নিজসূত্রে বন্দী হয়ে, মরে অবশেষে।
সেই মত পৃথিবীতে কত লোক ঘোরে।
মায়ামোহে মজে সবে, শোক পায় শেষে।
সংসার অসার প্রভু, সার ধর্ম পথ।
তাহা বিনা নাহি মম, অন্য মনোরথ।
সাবিত্রী-৩০
এত শুনি তুষ্ট হয়ে বলে মৃত্যুপতি।
তোমার চরিত্র বেশ, লাগে চমৎকার।
অগোচর নহে মম, যতেক দূর্গতি।
অল্পকালে ধর্ম প্রতি, এমন বিচার।
পৃথিবী বিখ্যাত হলো, বিচার তোমার।
তোমার আলাপে আমি, তুষ্ট হইলাম।
পতির জীবন ভিন্ন, যা আছে আবার।
যাহা ইচ্ছা মাগো দিব, আমি কহিলাম।
সত্যবানের ঔরসে পুত্র হবে এক।
এইমতে দাও মোরে শতেক নন্দন।
পালন করিবে তবে অঙ্গীকৃত বাক্।
কৃতান্ত কহিল যাও, না করো ক্রন্দন।
মম বরে হবে তব শতেক নন্দন।
এত বলি শীঘ্রগতি, চলিল শমন।
সাবিত্রী-৩১
সাবিত্রী তাঁহার পিছে করিল গমন।
যম বলে, কি কারণে, যাও তুমি কোথা।
চার বর দিনু, কেন ত্যক্ত করো মন।
সাবিত্রী কহিল, দেব মনে লাগে ব্যথা।
জন্মিবে শতেক পুত্র, নিজে বর দিলে।
অলঙ্ঘ্য তোমার বাক্য কে পারে লঙ্ঘিতে।
আমার হইবে পুত্র, সত্যবান হলে।
সত্যবান ছাড়া পুত্র পাবো কি জগতে।
ইহার বিধান আগে করো ধর্মরাজ।
মনে মনে লজ্জা পেয়ে, কহে মৃত্যুপতি।
কি বর দিলাম আমি, মাথে পড়ে বাজ।
পরম লজ্জিত হয়ে, রহে মৃত্যুপতি।
এ তিন ভুবনে তুমি সতী পতিব্রতা।
পবিত্র হইবে লোক, শুনি তব কথা।
সাবিত্রী-৩২
শবপদরেণু তুলি, সতী লয় শিরে।
গগনে বাজিল শঙ্খ, অমরের দলে।
সুগন্ধি পবন বহে, অতি ধীরে ধীরে
বরষিল পুষ্প তবে, পতি লয় কোলে।
তুলিল কৃতান্ত দেহ, বিচিত্র সম্মানে।
সুগন্ধি কুসুমে শোভে, অতি মনোহর।
বিশেষ করিলে ব্রত চতুর্দ্দশী দিনে।
তাহার কারণে পেলে এই চারি বর।
দ্বিতীয় তোমার কর্মে, প্রাণ করি দান।
নতুবা শুনেছ কোথা মৃত প্রাণ পায়।
লহ এ তোমার পতি রাজা সত্যবান।
কৌতুকে গমন করো, লইয়া বিদায়।
যে ব্রত সাধিলে সতী বসি অহর্নিশি।
লোকে পরে করিবেন সাবি চতুর্দ্দশী।
সাবিত্রী-৩৩
তোমার গুণেতে বশ, হইলাম আমি।
শীঘ্র করি, গৃহে যাও স্বামী লয়ে সাথে।
ভোগ করো যত সুখ, শান্ত হবে ভূমি।
অন্তকালে বিষ্ণুলোকে, যাবে দিব্য রথে।
এত বলি মৃত্যুপতি ছাড়ি সত্যবানে।
আনন্দ বিধানে যান, হরষিত মতি।
পুনঃ পতি পেয়ে সতী আনন্দিত মনে।
স্বামীর নিকটে যান, অতি শীঘ্রগতি।
মহানন্দ মহাজয়, করিল বরণ।
স্বামী-অঙ্গে নিয়োজিল পরম হরষে।
চৈতন্য পাইয়া উঠে রাজার নন্দন।
কালনিদ্রা হতে জেগে উঠিলেন হেসে।
সাবিত্রীর পুণ্যকথা ভীষণ সরস।
প্রসাদ রচিল শেষে, পদ চতুর্দশ।
Comments
Post a Comment