মায়ের বন্ধু
মায়ের বন্ধু
ওষুধ লাগিয়ে,জিজ্ঞেস করে -
-বয়স কত?
-ঊণিশ,
ডাক্তার হাসতে হাসতে বলেন,
-তাহলে ভেউ ভেউ করে কাঁদছো কেন? আমি ভাবলাম পাঁচ ছয় হবে।
- ঊণিশে কেউ কাঁদে না?
- কাঁদেতো, তবে অল্প সল্প। সহ্য করে নেয়।
এরপর চাপ দিয়ে,অনিতার কাছে থেকে ডাক্তার সব কথা শোনেন। সব শুনে বেশ গম্ভীর ভাবে ডাক্তার বলেন,
- ব্যাপারটা কবে?
- আগামী শুক্রবার।
- তার মানে এখনো তিনদিন।
ডাক্তার অবনীকান্ত তালুকদার আমাদের পাড়ার বাসিন্দা, সকালে নিজের বাড়িতেই চেম্বার করেন, ওনার একটা পুরানো মডেলের গাড়ি আছে, উনি বাইরে ছিলেন বলে, গাড়িটা পড়েই ছিল। সদ্য এখানে এসেছেন, ছেলে আমেরিকায় থাকে, তিনজনের সংসার, স্ত্রী হার্ড স্পেশালিষ্ট, মেডিকেলে আছেন। দুজনে বেশ কম্প্রোমাইস করে চলেন। অবনী ডাক্তারের নামও কম নয়, উনি সব রুগি দেখেন, জ্বরজারি, কাটাছেঁড়া, গাইনি, পেট ব্যথা পেট খারাপ সব। একবার ওনার ওষুধ খেলে দ্বিতীয় বার আর যেতে লাগে না। গরীব মানুষের চিকিৎসা উনি বিনা পয়সায় করেন। কিন্তু যেদিন বিনা পয়সায় যার চিকিৎসা করবেন তার বাড়ির লোককে তার ডিসপ্নেসারি সাফ সাফাই করে দিতে হবে। যদিও সেই মানুষের যা ওষুধ পত্তর লাগে সব উনি দিয়ে দেন। উনি বলেন এটা যদি উনি না করেন, তাহলে যে ওষুধ উনি দিচ্ছেন, সেই ওষুধ গুরুত্ব নিয়ে রুগি খাবেন না। তাই এই পদ্ধতি তিনি অনুসরণ করেন। গাড়িটা ওনার সখের, বেশি দূরে কোথাও যান না, পাড়ার আশেপাশে কোথাও নিমন্ত্রণ থাকলে, আত্মীয়র বাড়ি যেতে হলে তবেই ব্যবহার করেন, নিজেই চালান গাড়ি, আস্তেই চালান, আজ সেরকম একটা নিমন্ত্রণ বাড়ি থেকে ফেরার পথে গলির মুখে তার গাড়ির সামনে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল রমিতা। আত্মহত্যা করতে চাইছিল।
ডাক্তার ঠিক সময়ে গাড়ি না থামালে একটা অঘটন হোতোই। সেটা বুঝতে পেরে ডাক্তার রমিতাকে চেপে ধরল। কি জন্য সে এই কাজ করতে যাচ্ছিল? রমিতার পড়ে গিয়ে হাত পা ছিঁড়ে গেছিল, একটা টেডভেক দিতে হলো।
সব শুনে ডাক্তার বাবু বললেন,
-চলো দেখি তোমার মায়ের সাথে কথা আছে। তোমার কি বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে?
- না, শুক্রবার দেখতে আসবে, আমার ছবি দেখে পছন্দ হয়ে গেছে, আষাঢ় মাসে ওরা বিয়ে করাতে চায়, কিন্তু ডাক্তার বাবু আমি এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করব না, আরো পড়াশোনা করব, আপনার মতো ডাক্তারী করতে চাই, কিন্তু ওরা করতে দেবে না।
- আচ্ছা ঠিক আছে বিয়ের দিনতো আর ঠিক হয়নি, ওরা কি বিনা পণে বিনা টাকায় বিয়ে দিতে চায়?
- বলল সামান্য আয়োজনে বিয়ে করাবেন।
- আচ্ছা চলো আমি তোমার মায়ের সাথে কথা বলে আসি।
ডাক্তারবাবু আমার পঙ্গু মাকে দেখে হকচকিয়ে গেলেন। বললেন,
- রিনি !
আমার মায়ের নাম যে রিনি, আমি এই প্রথম শুনলাম। মাও হতবাক হয়ে ডাক্তারবাবুকে দেখছে। আমি মায়ের একটাই মেয়ে,বাবা সাধারণ একটা কোম্পানিতে অ্যাকাউন্টসে চাকরি করেন।খুব সহজে যে আমাদের সংসার চলে বলতে পারি না। আমি কিছু টিউশন করি,মায়ের চিকিৎসা আর আমার টিউশনের টাকায় কোন রকমে সংসার চলে। এসব দেখার পর,ডাক্তারবাবু আমাকে ধমক দিলেন,
- বাড়ির এই অবস্থা আর তুমি এই অঘটন ঘটাচ্ছিলে? জানো রিনি তোমার এই মেয়ে কি করতে যাচ্ছিল? ভাগ্যিস আমি ছিলাম।
মা আনন্দে দুঃখে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
- কি করতে যাচ্ছিলি রমি?
ডাক্তারবাবু মাকে বললে,
- ওকে কেন এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিচ্ছো রিনি,ওতো পড়তে চায়, ডাক্তারী করতে চায়,
মা বলল,
- তুমি জানো না অবনী, আমাদের অবস্থা, ওর বাবার একটা সামান্য চাকরি, শরীর ভালো না, আমার অবস্থাও দেখছো, কি করে ওকে আর পড়াতে পারি?
- ওর দায়িত্ব আমি নিলাম রিনি, ওকে আমাকে দিয়ে দাও, আমার একটাই ছেলে, আমেরিকায় আছে, সামনের বছর চলে আসবে, আমি ওদের বিয়ে দেবো, ও খুব ভালো মেয়ে, আমার সঙ্গে থাকবে ও।
আরে এতো দেখছি আর এক প্যাঁচাল, ওনাকে নিয়ে এলাম, এই পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতে, আর উনিই আমাকে ফ্যাঁসাদে ফেলছেন। ডাক্তারবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরে বললেন,
- ভয় নেই, তোমার সব আশা আমি পূরণ করব।
তুমি জানো তুমি কার মেয়ে? আমার রিনির মেয়ে,
মা লজ্জা পেয়ে গিয়ে বলল,
- আরে এসব কি বলছ অবনী?
- কেন লুকিয়ে রাখবে বলো? মেয়ে বড় হয়েছে তাকে বুঝতে দাও, আমাদের সম্পর্কটা কি?
মা লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে, মেয়ের সামনে ডাক্তারবাবু তাদের পূরানো সম্পর্ক টাকে তাজা করে দিচ্ছেন।
- আমি আছই শ্রেয়শীর সঙ্গে কথা বলছি, তোমার চিকিৎসার ব্যাপারটা দেখার জন্য, আর তোমাকে কিছু চিন্তা করতে হবে না, আমি সব করে নেবো, মা রমিতা মাকে একটু ধরে বিছানায় নাওতো।
আমি মাকে বিছানায় নিলাম, ডাক্তারবাবু বললেন,
- এ যা দেখছি বাচ্চা হওয়ার সময় ভুল টিটমেন্টে তোমার এই অবস্থা করেছে, কি ঠিক বললাম তো?
মা ঘাড় নাড়লেন।
- অবনী তুমি ঠিক একই রকম আছো, এত ভালো ডাক্তার তুমি অথচ এম বি বি এস নিয়েই পড়ে থাকলে, কেন যে তুমি স্পেশাল কিছু করলে না, কত করে তোমাকে আমি বললাম তখন শুনলেই না। শুধু আমার জন্য এফ আর সি এস টা ছেড়ে দিলে। কত করে সকলে বোঝালো, আমি তো তোমারই ছিলাম অবনী, রাগের মাথা এ কি করলে?
- আরে, এই বয়সে এসেও আমাকে জ্ঞান দিতে ছাড়ছ না। আমি করিনি তো কি আছে? আমার ছেলে করছে, আমার ছেলের বউ করবে।
- ধ্যাৎ তুমি ছাড়তো, তোমার ছেলে কি করবে তার ঠিক নেই, আগে থেকে-
- না গো রিনি, আমার ছেলেকে তুমি চেনো না, বড় মা ভক্ত, মা যা বলবে তাই,
- আগে মা বলুক তারপর এসব বোলো।
- কেন? তুমি শ্রেয়শীকে চেনো না?
- চিনি, এত গুলো বছর কেটে গেছেতো? তাই ভয় হয়, যে ভাবে তুমি রাগের মাথায় শ্রেয়শীকে বিয়ে করে ফেললে, তার খেসারত নিশ্চয়ই এখনো দিচ্ছো?
- না গো যতটা শ্রেয়শীকে বাইরে থেকে জানি, তার চেয়ে অনেক বেশী ভালো শ্রেয়শী। হঠাৎ করে ফেলা বিয়ে বলে, আমাদের জীবনে কোনো অশান্তি আজ পর্যন্ত হয়নি, এমন কি তোমাকে নিয়েও না। তুমি দেখবে শ্রেয়শী তোমার কত কেয়ার করে, তুমি নার্সিংটা শেষ করতে পারলে না বলে কত দুঃখ করতো শ্রেয়শী। আসলে ওতো তোমারই প্রিয় বন্ধু ছিল।
- হ্যাঁ ঠিকই, ওর মতো মেয়ে যে আমার বন্ধু ছিল তাতে আমার গর্ব হতো,
আমি এই প্রথম জানলাম আমার মা কোনদিন নার্স ছিল। আর মায়ের বন্ধু ছিল ডাক্তার।।
Comments
Post a Comment