কৃতকর্ম
কৃতকর্ম
বাপ মা মরে গেছে। হীরা আর পান্না দুই যমজ ভাই। কি একটা কথায় দুই ভাইয়ের লাগল মারামারি। পান্না রেগে গিয়ে বলল, “তুই ঘুঘু দেখেছিস। কিন্তু ফাঁদ দেখিস নি।”
হীরা রাগ করে বাড়ি হতে পালিয়ে এলো কলকাতায়। এখানে এসে এ বাড়ি, সে বাড়ি,ঘুরতে লাগল কাজের আশায়। কিন্তু কাজ তাকে কে দেবে? এই শহর এক মজার শহর, এখানে যে পায় অনেক পায়, যে পায় না কিছুই পায় না। কাজের বড় আকাল। অবশেষে হীরা গিয়ে উপস্থিত হল, এক ঠাকুরের বাড়ি। ভারি বিদঘুটে লোক এই ঠাকুর। চাকর রেখে সময় মত খেতে দেয় না, খেতে দিলে, বেতন দেয় না, তাই কেউই তার বাড়িতে কাজ করতে চায় না। তবু হীরা সেখানে কাজে লেগে গেল, হীরা বাজার করে, বাগান ঝাঁট দেয়, বাসন মাজে, রান্না করে, ঠাকুরের বউ সকলকে খেতে দেয়, নিঃসন্তান ঠাকুর, যজমানি করে দিন চলে। তা বলে সে যে খুব গরীব তা নয়, তার বাবা একটা প্রসিদ্ধ মন্দিরে পুজা করতেন, অনেক টাকা পয়সা রেখে গেছেন। ঠাকুরের তিন পুরুষ বসে খেলেও শেষ হবে না। তবুও ঠাকুর পুজো করতে যান বাড়ি বাড়ি,দিনের শেষে অনেক চাল কলা ফল মুল আনেন। সেগুলো সব গুছিয়ে রেখে দেন, মজুত করেন, কিসের জন্য মজুত করেন কেউ জানে না। কোনো মন্দিরে পুজো হলে সেখানে কাঙালী ভোজন হয়, সেদিন বাড়িতে রান্না বন্ধ থাকে, সকলে কাঙালী ভোজনে অংশ নেন। এই সবে হীরার প্রচন্ড রাগ হয়। চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে কিছু বলে না। তবুও একদিন সাহস করে হীরা জিগ্যেস করে,
- ঠাকুর এত থাকা স্বত্বেও কেন এমন জীবন যাপন?
- ঘোর বিপদ আসছে, সেই বিপদে মানুষের পাশে থাকতে হবে, নইলে মানুষ জন্ম বৃথা।
এদিকে পান্না গ্রামের বাড়িতে জমি জায়গা দেখা শোনা করে, চাষ আবাদ করে, তাতেই বেশ দিন চলে যায়, সে পাশের গ্রামের এক কৃষকের মেয়েকে বিবাহ করে। বেশ গোছানো সংসার, শ্বশুর শাশুড়ি সমেত ভালোই আছে সকলে, ভুলেও হীরার কথা তার মনে আসে না। অথচ হীরা তার যমজ ভাই, বাড়ির ভাগ তারও আছে, জমির ভাগ তারও আছে, সে কথা পান্না ভুলে গেছে, কখনো হীরার কথা তার বউয়ের কাছে স্বীকার করেনি। সে একাই তার বাবা মার সন্তান, এইটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করে।
কলকাতায় হীরাকে ঠাকুরের বাড়িতে খুব কষ্ট করে থাকতে হয়। সকাল থেকে রাত পযর্ন্ত খাটতে হয়,দুতিন বিঘে বাগান তাকে দেখা শোনা করতে হয়, বাগানে একটা শুকনো পাতা থাকবে না, থাকলেই বেতের বাড়ি খেতে হয় তাকে, বাসন ধুলে যদি একটু ময়লা থেকে যায়, আবার তাকে সব মাজতে হয়, প্রতি কথায় খিটখিট করে ঠাকুর। আর তার গিন্নি? সেতো আর এক, খাবার রান্না হলেও, বাসি খাবার দেবে খেতে, তা চার পাঁচ দিনের খাবার ও হতে পারে। বড় দূর্বল হয়ে পড়ে সে, নানা রকমের ব্যাধি তাকে ধরে গেল, শরীর ভালো যায় না, তবু তাকে কাজ করতে হবে, হুকুম মানতে হবে। কিন্তু একি আশ্চর্যজনক ব্যবহার তার ঠাকুরের, অসুস্থ শুনেই ডাক্তার ওষুধ খাওয়া দাওয়া সব পাল্টে গেল। ঠাকুর আর গিন্নিমার চরিত্রে যেন ঘোর পরিবর্তন। দু একদিন সুস্থ হয়ে গেল হীরা। তাদের প্রতি যতটুকু বিদ্বেষ ছিল সব চলে গেল। ভরে গেল মন।
ঠাকুরের এই সব বদ অভ্যাসের মধ্যে ও একটা অভ্যাস খুব ভালো ছিল, সারাদিন ঠাকুর দেবতা মন্দির এই সব নিয়ে থাকতেন, বেশ জাগ্রত মুনিঋষিদের মতো সকাল সন্ধ্যা পুজা আহ্নিক করেন।
পান্নার রমরমা গ্রামে বাড়তে লাগল। নিজেকে পান্না জমিদারের সমতুল্য ভাবতে লাগল। শ্বশুর শাশুড়ি শালাশালি সব এক জাগায় থাকে।
তারপর এলো সেই দিন করোনায় ভরে গেল দেশ,মহামারী লেগে গেল চারিদিকে, আত্মীয় স্বজনরা ছেড়ে পালাতে লাগল। খাদ্যের আকাল লাগল দেশে, লক ডাউন হলো দেশে, গরীবরা আরো গরীর বড় লোকের আরো বড় লোক হতে থাকে, এমত অবস্থায় মানুষে মানুষে দ্বন্দ। কাজ কর্ম বন্ধ, মানুষ খাবারের খোঁজে এদিক ওদিক ছুটছে, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের অনাহারে দিন কাটে, হাসপাতাল গুলো করোনা রুগির থাকার জায়গা নেই, শ্মশানে লাইন। প্রিয়জন ছেড়ে পালাচ্ছে ভয়ে।
ঠাকুরের করোনা হলে,বাকি চাকর বাকররা তাকে ছেড়ে পালালো,হীরা তাকে ছেড়ে পালায়নি সর্বদা তার সেবা করছে,হাসপাতাল ঘর করছে, সেই সময় ঠাকুর বলল
- হীরা যাও চলে যাও, কেন মরতে এসেছ এখানে? আমি মরলে সম্পত্তি নেওয়ার ইচ্ছা। ও আমি বিলি করে দেবো,গরীবদের যদি পারো মজুত খাবার গুলো,বাড়ি বাড়ি দিয়ে দাও, যারা খেতে পাচ্ছে না তাদের, আমি মরে গেলে কে খাবে?
হীরা তাই করে, ঠাকুরের বউ নিজের হাতে তা গরীবদের বিলি করে, শুণ্য করে দেয় তার মজুত চাল ডাল, সব্জি। খবরে তাদের দেখায়, হীরা মনোযোগ দিয়ে রুগিদের সেবা করে, নিজেকে বিলিয়ে দেয়,তাদের সেবায়। লোকে ধন্য ধন্য করে।
পান্না করোনায় আক্রান্ত হলে তার শ্বশুর বাড়ির লোক তাকে ছেড়ে চলে যায়। বউ ও ভয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়। ঘরের সব জিনিস পত্র লুট করে নেয় গ্রামের লোক। হীরা জানতে পেরে পান্নাকে নিয়ে আসে তার কাছে, হাসপাতালে সুস্থ করে তোলে।
কৃতকর্মের ফল সকলকে ভুগতে হয়।
Comments
Post a Comment