জঙ্গলে জঙ্গলে

 জঙ্গলে জঙ্গলে 


ঘুরতে গেছিলাম সুন্দরবন। হঠাৎ বর্ষা,সারাদিন ঘুটঘুটে  অন্ধকার,নোয়াখালী জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সরু রাস্তা চারপাশে উঁচু উঁচু গাছগাছালি, ঘনঘন ঝোপঝাড়, নদীর জলে প্রবল টান। লঞ্চ,ঘাটে দাঁড়িয়ে পড়েছে, আর এগোনো যাচ্ছে না। বনদপ্তর থেকে বারণ করেছে। ঠিক এ সময় সচরারচর বৃষ্টি হয়না। ঘনঘন মেঘ ডাকছে, কোথাও কোথাও বাজ পড়ছে। আমরা ছয়জন, বন্ধুরা মিলে একটু, মদ মাংস নিয়ে ফুর্তি করতে বেরিয়েছি তিনদিন। প্রত্যেকের ব্যাগে একটা করে বোতল। বন মুরগীর খোঁজ করতে চলেছি বনের মধ্য দিয়ে ভেতরে, বন মুরগীর কষা মাংস আর সুরা। আমরা কেউ সুরা পানে অভ্যস্ত নই, তবে মাঝে মাঝে অকেশনে সুরা পান করে থাকি, সকলেই আনন্দের জন্য এসেছি।

সকলেই বিবাহিত, আমাদের তিনজনের পাঁটটা বাচ্ছা। আমার দুটো মেয়ে, অসিতের একটা, গৌরবের দুটো ছেলে। বাকি তিনজন, বাবু প্রলয়, আর অনন্ত। বাবুর চার বছর বিয়ে হয়েছে বাচ্ছা কাচ্ছা হয়নি, তবে চেষ্টা চালাচ্ছে। অসিত অনন্তের দেড় বছর বিয়ে হয়েছে, দুজনের বউ অন্তঃসত্ত্বা। মাসচারেক। আমরা সকালের দিকে বেরিয়ে ছিলাম, এখন প্রায় দুপুর, কিন্তু পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে, সন্ধের পরের রাত। জঙ্গলের মধ্যে আরো অন্ধকার। সাপ খোপ থাকতেই পারে। একটা কালো মত কি দৌড়ে চলে গেল,রাস্তার একদিক থেকে আর একদিক। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। একটু শীত শীত করছে, এখন বসন্তকাল, শীতটা ভালো করে যায়নি,হঠাৎ বৃষ্টিতে শরীর ঠিক মানিয়ে নিতে পারছে না। সকলে মিলে একটা গাছে তলায় দাঁড়িয়েই দু ঘোট করে মেরে নিলাম। শরীরটা গরম হলো,বৃষ্টি আর অন্ধকারময় বনে কোনো গার্ড নেই, কোনো বাধা নেই, অবারিত দ্বার। একটা শেয়াল লাফ দিল মনে হয়। বাঘের উৎপাত এখানে নেই মনে হয়, মোবাইলে চার্য নেই, সেটাও খুলতে পারছি না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, কান দুটো বন্ধ হয়ে গেছে মনে হয়। এবার সুরার নেশা শরীরকে নিজের আয়ত্বে নিচ্ছে। পা টলছে, এলোমেলো পদক্ষেপ, কেউ কারো কথা শুনতে পাচ্ছি না। সকলেই কথা বলছি, গাছের পাতায় বৃষ্টি পড়ার শব্দ। পাখিদের কুজন, বাজ পড়ার শব্দ, দূরে কোথাও বাঘের গর্জন, নদীর জলের সঙ্গে জলের লড়াই এর শব্দ, মিলেমিশে একটা বিদঘুটে শব্দ তৈরী হচ্ছে জঙ্গলে। শুধু বাদাম ভাজা দিয়ে এই দুপুরে মদ। মুরগীর খোঁজ পেতে হলে গ্রামে যেতে হবে, জঙ্গল পার করে। জঙ্গলে বনমুরগী মারা অপরাধ। ভীষণ আইন। আমরা চলেছি, গ্রামের দিকে, সামনে পেছনে মৃত্যু। অনেক সময় খাবারের খোঁজে বাঘ এসে পড়ে, পেপারে দেখেছিলেম। 


পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদী হিমালয় থেকে সৃষ্টি হয়ে বঙ্গোপসাগরে এসে মিশেছে। বঙ্গোপসাগরের মোহনার নোনা জল আর এই তিন নদীর মিষ্টি জল মিলেমিশে একাকার হয়েছে। জলের সঙ্গে আসা পলি জমে যে বদ্বীপের সৃষ্টি, তাতেই সুন্দরবন গড়ে উঠেছে। এ ধরনের বন উপকূলের স্থিতিশীলতা রক্ষা করে, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস-উত্তাল তরঙ্গ ও জোয়ার-ভাটায় ভাঙন প্রতিরোধ করে। ম্যানগ্রোভ বনের উদ্ভিদের শ্বাসমূলের কারণে তা মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর কাছে এক আকর্ষণীয় আশ্রয়। তারা খাবার এবং শিকারি প্রাণীদের কাছ থেকে আত্মরক্ষার জন্য এ ধরনের বনে আশ্রয় নেয়। ছোট মাছ, শামুক, কাঁকড়া, চিংড়ি ও পাখিদের আবাস হিসেবে ম্যানগ্রোভ বন অনন্য। কার্বন শোষণের মাধ্যমে এ ধরনের বন বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে সহায়ক। তাছাড়া এরা প্রবাল ও ঘাসজাতীয় উদ্ভিদের আবাসের মতো আশপাশের বাস্তুসংস্থানে পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে।

আর সেই পুষ্টির খোঁজে আমরা চলেছি বনের ভেতরে, পায়ে হাঁটা পথে, একটি গাইড নেওয়ার কথা ছিল, নেওয়া হয়নি, কারণ তারা কেউ আসতে চায়নি, বনদপ্তরের ভয়ে, আমরা কেন ভয় পাইনি জানি না। শরীরে যৌবনের রক্ত ও যার উদ্যোগে এই ভ্রমণ, তার কাকা এই নোয়াখালীর ফরেষ্ট অফিসার। সকলে চলেছি আগে পিছে করে, আমি সচেতন ভাবে তাদের সতর্ক করে দিচ্ছি বার বার, সকলে এক সঙ্গে চল, বিপদ এলে সকলে মিলে মোকাবিলা করতে পারব। কিন্তু তাও আগে পিছে হয়ে যাচ্ছি, খালি পেটে সুরাপানে শরীর টাকে মহাধিরাজের মত লাগছে। কাউকে প্রভু বলে স্বীকার করে না মন। চারিদিকের জঙ্গল যেন সাজানো সৈনিক, রাজা অভিবাদন করছে। কোনদিকে চলেছি,কেন চলেছি,কারো মনে নেই, তবু চলেছি। 

একটা বাজ পড়ল কাছেই, বনের পশু পাখিরা ঝটফট করে কোথায় যেন উড়ে গেল। ধীরে ধীরে অন্ধকার আরো গাঢ় হচ্ছে। কতগুলো মুরগীর মতো পাখি হয়তো দেখা যেতো, যদি না বৃষ্টি হতো। আমি সকলকে দেখতে পাচ্ছি না, অসিতকে দেখলাম দুলতে দুলতে হিস করছে। ডাক দিলাম 

- অসিত.......

কোনো উত্তর এলো না,কিন্তু অসিত চার পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে, কতগুলো দাঁড়কাক কা কা করে ঝাপ্টা মেরে উড়ে গেল। আবার ডাক দিলাম 

- আরে এই অসিত।

কোনো শব্দ নেই, অথচ সামনেই দাঁড়িয়ে। আমি ঠেলা মারতে গেলাম, টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলাম। কিন্তু আমিতো ওর গায়ে হাত দিলাম, গায়ে লাগল না কেন? উঠে দেখি কেউ নেই সেখানে। ভ্রম হলো, চোখের ভুল। এতো সূরা পান হয়েছে, চোখে সরষে ফুল দেখছি, আরে সবাই গেল কোথায়? কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। আগে পিছে কেউ নেই। সকলে তো একই দিকে হাঁটছিলাম। কই গেল সব? একটু জোরে হাঁটতে হবে, আমার পেছনে কেউ ছিল কিনা জানি না। তবে সামনে ছিল, অনন্ত আর গৌরব, অসিত ছিল আমার সঙ্গে, বাবু প্রলয় ছিল এক সঙ্গে। বাবুটা প্রচুর মাল খেয়েছে, ওটাকে নিয়েই সমস্যা, প্রলয় ওকে সামলাতে পারে। দূরে কারা হাঁটছে দেখতে পেলাম। হ্যাঁ ওরাই তো। তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করলাম, কিছুতেই যেন ধরতে পারছি না। যতই জোরে হাঁটি চার পাঁচ হাত বাকি থেকেই যাচ্ছে। ডাকছি শুনতে পাচ্ছে না। কি অদ্ভুত ব্যপার। চোখ জুড়িয়ে আসছে, পায়ে যেন কি লাগল? বসে পড়ে দেখি একটা মানুষের মাথা। দাঁত বের করে হাসছে।বললাম- 

- কি ভাই? দেখতে পাচ্ছো না। আমার না হয় পায়ে চোখ নেই, তুমিতো বাবা রাস্তা গড়া গড়ি দিচ্ছো। দেখতে পাওনি? 

একটা নয় দুটো নয় অন্ততপক্ষে চার পাঁচটা বাঘের গর্জন শুনতে পাচ্ছি খুব কাছে, আমার পরিস্থিতি এমন,যে দৌড়ে পালাতেও পারব না,যদি বাঘে ধরে। একটা হরিণ চোখে পড়ল, কি জাতের হরিণ এই নেশার ঘোরে বুঝতে পারছি না। অথচ এই কাজ গুলো আমি নির্ভুল করতে পারি। আমি যাদের সাথে এখানে এসেছি, সকলেই বিগ বিগ বাপের পোলা। শুধু অমিই নিকিরি জাতের, আমার বাবার কোনো সম্পত্তি নেই,টাকা পয়সাও নেই। তারা আমাকে বরাবরই একটু অবহেলার চোখে দেখে, যদিও এটা আমার ধারনা কিনা জানি না। ওরা আমাকে নিয়ে বরাবর প্রাঙ্ক করে, মজা করে। এখনো তাই করছে, আমাকে ফেলে সকলে লুকিয়ে গেছে। এক একজন বেরিয়ে আমাকে মাতাল প্রমাণ করতে চাইছে। চোখটা একটু রোগড়ে নিলাম। তাও ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না। বৃষ্টির জল পড়ছে চশমার ওপরে। আমি মাথায় একটা পলি ব্যাগ বেঁধেছি। মাথার ওপরের জল টপটপ করে চোখ বেয়ে পড়ছে,তাই আরো দেখতে পাচ্ছি না। চোখের সামনে সকলকে দেখতে পেলাম, ঐ তো ওরা, 

- কি রে?বেকার আমাকে দৌড় করাছিস। এক সাথে চল না বাবা, তোদের আর কি, জঙ্গলে তোদের বাঘে খেলে, তোদের বউ ফুর্তি করবে, তোদের পয়সায়, ভাই আমার বউটা দুটো মেয়েকে নিয়ে অকুলপাথারে পড়বে। একটু আসতে চল ভাই। 

আবার হোঁচট খেলাম, রাস্তার ওপরে,কে যেন শুয়ে আছে, না শুয়ে নেই পড়ে আছে। মাথা নেই, সারা গায়ে রক্ত, জামা কাপড় ছেঁড়া ফাটা, সারা গায়ে আঁচড়ের দাগ। বাকিরা কোথায়? তারপর আর কিছু মনে নেই।


Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ