প্রথম প্রেম
প্রথম দর্শনে
প্রেম মানে আকর্ষণ। প্রেম মানে মোহ। প্রেম মানে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। প্রথম দর্শনে প্রেম, শুধুমাত্র একটি ছেলে এবং একটি মেয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, তা মনে করার কোন কারণ নেই। স্কুল কলেজ, বাসস্ট্যান্ড, মেলা, কোচিন সব জায়গাতেই এই প্রেম আসতে পারে। আমার প্রেম এসেছিল কনে দেখতে গিয়ে। আমি তখন আঠাশ। যাকে দেখতে গেছি সে সবে ফাস্ট ইয়ার পরীক্ষা দিয়েছে,
হ্যাঁ আমি তার প্রেমে পড়েছিলাম প্রথম দর্শনে। সেই প্রেম আজও অনড় আছে। আমাদের ভালোবাসা প্রকৃতই অন্তরের ছিলো বলেই, আমরা সাময়িক কষ্ট থেকে, পুনঃরায় তা অমলিন ভালোবাসায় পরিনত হয়েছে।
সবার নিশ্চয়ই বেশ কৌতূহল হচ্ছে,আমার কার সাথে প্রথম দর্শনে প্রেম হয়েছিল?
আমার জীবনে প্রথম কনে দেখার আনন্দটা ছিল অকৃত্রিম। বেশ ফুরফুরে মন সকাল থেকে, বিকাল চারটেতে যাবো সেই বহু প্রতিক্ষিত জীবনের সঙ্গী টিকে পছন্দ করে নেওয়ার মুহূর্ত।
আমার বোন, বোনাই, আমি আর আমার খুড়তুতো দুইভাই লালু আর কালু। যে ঘটক নিয়ে গেছিল, তাকে বলেছিলাম মেয়ে যেন মোটা না হয়, কালো, রোগা যাই হোক আমি রাজি হয়ে যাবো, কিন্তু মোটা হলে সোজা না করে দেবো।
ট্রেন থেকে নেমে, পঞ্চাশ গজ উত্তরে হেঁটে রেল লাইনের আন্ডারপাসের নিচে রিক্সা পাওয়া গেল। লালু কালু আর আমি তিনজন একটা রিকশায়, বোন বোনাই আর একটা রিক্সায় উঠলাম, ইচ্ছাপুর থেকে পলতা প্রাইমারী স্কুল। পরিবেশের দিক দিয়ে অতি সুন্দর সবুজ ঘেরা রাস্তা দিয়ে চলেছি, বর্ষা সবে কেটেছে, রাস্তার খোলনোলচে বদলে গেছে একেবারে, কঙ্কালসার অবস্থা, তার ওপর একটা রিক্সায় তিনজন, নৌকায় দুলুনি খাওতার মতো করে চলেছি, পথ আর শেষ হয় না, বিধানপল্লী হাই স্কুল পার করে এগোচ্ছি, সাইকেল চড়ে লোকজন যাওয়া আসা করছে, একে তো ওই রাস্তা তার ওপরে তিনজন, রিক্সা ওলার ভারি কষ্ট ও হচ্ছে বুঝতে পারছিলাম, একটা খাল পার হলাম, খালের পরেই পঞ্চায়েত, খালের আগে ছিল মিউনিসিপলিটি, কিছুটা যাওয়াল পর একটা মসজিদ, কয়ে অম্বিকাপল্লী খেলার মাঠ পেরিয়ে মুদি দোকানের রাস্তায় সোজা দেখা যায় তাদের বাড়ি। রাস্তা খুব খারাপ, রিক্সায় বেশ কষ্ট হচ্ছিলো। লালু কালুর চেহারা বেশ ভালো। আমি মোটামুটি। ওদের পায়ের ওপরে বসেছি। কোমরটা বেশ চাপ লাগছে।কখনো উচু, কখনো নিচু, প্রায় আধ ঘন্টা লাগল স্টেশন থেকে যথাস্থানে পৌঁছতে। মোড়ের মাথায় ঘটক আর আমার হবু শ্বশুর দাঁড়িয়ে ছিল। তাই বাড়ি খুঁজতে অসুবিধা হয়নি। আমরা টালির চালের বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকলাম। গ্রাম, চারিদিকে গাছগাছালি,ঘেরা মনোরম পরিবেশে, আমার হবু শ্বশুর বাড়ি। প্রেমে পড়ে গেলাম সেই পরিবেশের।
এটাও প্রেম, আমি মনে মনে ঠিক করে নিলাম, মেয়ে যাই হোক এখানেই বিয়ে করব। বারান্দায় একটা চৌকি পাতা,তাতে একটা বয়স্ক মহিলা একটা ঘন চুল ওলা অল্প বিস্তর শ্যামলা গায়ের রঙ,পাখির বাসার ন্যায় তার চুল,আঁচড়ে দিচ্ছে।
গোপাকে আমি সেইদিন প্রথম দেখলাম, আগোছালো ফ্রক পরা একটা মেয়ে, ভাবলাম এই বুঝি তিনি,যেনাকে আমি দেখতে এসেছি। প্রেমে পড়ে গেলাম তার। একেবারে সাধারণ অতি সাধারণ পোষাকে। সরবত এলো, মিষ্টি এলো, কে যেন জানলা দিয়ে উকি দিয়ে গেল। বেশ মিষ্টি মুখ। পাশের ঘরের থেকে কথা শোনা গেল, তিনজন, এসেছে,ছেলে কে? তিনজনের মধ্যে?
ঘটক একজন মহিলাকে দেখিয়ে বলল এই মেয়ের মা, বাবাকে তো আগেই দেখেছ। এনার চার মেয়ে, সকলেই পড়াশোনা করে,যাকে দেখবে সে এ বছর ফাস্ট ইয়ার দিয়েছে। আমার হবু শাশুড়িকে ছটফট করতে দেখে, ঘটক জিগেস করল -
- কিছু জিগেস করার থাকলে করুন না।
কথা বলার সুজোগ পেয়ে উনি বললেন,
- এদের মধ্যে ছেলেকে?
ঘটক আমাকে দেখিয়ে বলল,
- এই ছেলে।
লালু কালুর চেহারা দেখে আমার হবু শাশুড়ি একটু ইতস্তত করছিলেন। আমাকে দেখার পর যে হাসিটা তার মুখে ফুটে উঠল, সত্যি দেখার মত। এমন নির্মল হাসি আমি কোনদিন দেখিনি, আমি প্রেমে পড়ে গেলাম, তবে শাশুড়ির না, তার সেই মুখের হাসিতে।
তখন মেয়ে দেখতে গেলে একটা নিয়ম ছিল, মেয়ে চায়ের সঙ্গে আসবে, তিনি যখন আমাদের ঘরে পা দিলেন, তখন আমাদের সামনে একটা চেয়ার পাতা হলো, তিনি এসে সেখানে বিরাজমান হবেন,
ছয়টি কাপে চা এলো, সঙ্গে তিনি, সট্ হাইট, দেহের গড়ন মোটামুটি, দেখতে ও সেই মোটামুটি। যদিও আমার দেখা,প্রথম কনে দেখায় তার উপস্থিতি বেশ মধুর লাগল,সেই বয়সে যেরকমই হোক বেশ লাগে, আমি দেখছি, আমার দিকে খুব একটা তাকাচ্ছে বলে মনে হয় না। আমি তার দিকে দেখলেও, কি যে দেখছি বলতে পারব না। তবে দেখছি। ভালো লাগল বেশ মিষ্টি করে বলা নামটা। আর তার চুল। কোঁচকানো চুল, বেশ ঘন। যদিও তখন কতটা লম্বা চুল বুঝতে পারিনি। হালকা পাউডার মাখা মুখমণ্ডল। মনে হল চাপা রঙটাকে উজ্জ্বল করার আপ্রাণ চেষ্টা হয়েছে। তবুও আমি তার চুলের প্রেমে পড়ে গেলাম।
সেদিনই তিনি আমার মনের মনিকোঠায় স্হান করে নিলেন। যিনি আমার জীবন সঙ্গিনী হবেন।
আর কিছু বলার আগে বোন বলল,
- কিরে দাদা বল, তোর পছন্দ কি না।
আমি কিছু বলার আগে আমার বোনাই বলল,
- পছন্দ হবে না কেন? বেশ ভালোই তো লাগল।
তিনি উঠে চলে গেলেন। বললেন - আসছি।
আমাদের আলাপ হলো। আর আমার মনে এল প্রথম প্রেম । তারপর থেকে আমাদের সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকলো। আমি তখন ফ্লাটে থাকি, আমাদের একটা ল্যান্ড ফোন আছে, সেটার নং দিল বোন, বোন উঠে গিয়ে পাশের ঘরে কি সব জিগেশ করল, শুনতে পাইনি। এসে আমাকে বলল, তিনটে শালি হবে তোর, একটা একদম পুচকি, তার ওপরের টা মাসির বাড়ি গেছে, দুটোর সঙ্গে আলাপ করবি? কথাটা শুনে কিরকম লজ্জা পেলাম। তবু তারা এলো, দেখলাম, তাদের সরলতায় আমি প্রেমে পড়ে গেলাম।
তারাও আমার কাছে আদরনীয়া হয়ে উঠলো। অবশ্য তাদের আমাকে ভালো লাগল কি না জানি না।
আমার সব মনের কথা, কষ্টের কথা, হাসির কথা এক কথায় যাবতীয় কথা,আমি আমার বোনের সাথেই শেয়ার করে শান্তি পাই। ওর যাবতীয় কথা আমার সাথে শেয়ার করে। ও যদি একদিন আমার সাথে কথা না বলে,আমার ভীষণ রাগ হয়। এটাই আমাদের ভাইবোনের ভালোবাসা। আন্তরিকতা । জীবনে শুধুই যে একটা স্ত্রীলোক একটা পুরুষের
প্রতি প্রথম দর্শনে প্রেম হবে এমনটা নয়। সেই প্রেম অজানা অচেনা যে কোনো লোক, ও বস্তু পরিবেশের সাথে হতে পারে ।
আমারও তাই হলো, প্রথম দর্শনে তার প্রেমে পড়ে গেলাম।
অশান্ত মনকে শান্ত করতে তেনার দর্শন প্রয়োজন ছিল, কিন্তু কিছুতেই তা সম্ভব হচ্ছিল না। একদিন সুজোগ পেয়ে যে দিদা সম্বন্ধ এনে ছিল, সে থাকে কালিমাতায়, আমাদের বাড়ির কাছেই, তাকেই বললাম, একটু মেয়ের সঙ্গে কথা বলার দরকার দিদা।
দিদা সব ব্যবস্থা করে দিলো, আমার বইয়ের দোকানে তাকে আনা হলো।
Comments
Post a Comment