গৌরী

 গৌরী


-তোমাদের কি রান্না হবে? মাছ নেই ফ্রিজে। আমি বাজারে যেতে পারবো না, বাজারের লোক গুলো ভালো না, কি সব ইঙ্গিত করে, দাদাবাবু কে বলে দেও। বিকালে ফিরে ছাদের বাগানে জল দেবো। তারপর রাতে সোনাদির বাড়িতে যাবো, কাকার কাছে একটা চাদর আনতে। এই শীতে বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার কোন চাদর নেই। শাড়ি একটা পেয়েছিলাম তোমাদের কাছে সেটাই পোরে যাবো।

এক নিঃশ্বাসে বলে গেল গৌরী। গৌরী আমাদের পুরানো কাজের মেয়ে, আমার বাবার সময় থেকে আমাদের বাড়িতে আছে। নয় বছর বয়স থেকে সে এখানে কাজ করে, এখন ওর বাইশ, মাঝখানে একবার বিয়ের ঠিক করেছিল বাবা,বাবার অফিসের কোন এক চাপরাসির সঙ্গে, তখন ও সবে আঠারো, কেন ঠিক করেছিল সঠিক জানি না। তবে যেটুকু আন্দাজ করতে পারি, আমিও তখন বেশ যুবক, ফলে মা বলল,

- সমত্ত মেয়ে, কোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে, এবার বিয়ে দাও। 

বিয়ের কথা শুনে গৌরীর সে কি কান্না, কিছুতেই বিয়ে করবে না, অগত্যা আমার বিয়ের ঠিক হলো,সদ্য বি এস সি পাশ করেছি, চোখে নতুন স্বপ্ন, কলেজে একটা দুটো প্রেম ও করেছি, ঘোরাঘুরি চলছে, এরই মধ্যে বিয়ে!  মায়ের এক বান্ধবীর মেয়ে, ফাস্ট ইয়ার পড়ছে। মায়ের জোরাজুরিতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো, আমাদের গুরুদেব স্বামী বরাহনন্দজী বললেন,

- জন্ম মৃত্যু বিবাহ, না বলতে পারে বরাহ। ক্ষতি কি? ওর তো স্ত্রী ভাগ্যে উন্নতি, গাড়ি বাড়ি সব হবে, সংসারে শান্তি আসবে, কিন্তু.....

এই কিন্তুর মানে কি? তা তিনি আর খুলে বলেননি,

সত্যি কথা স্ত্রী ভাগ্যে ধন। বিয়ের চার মাসের মধ্যেই রেলে চাকরি, বাবার তৈরি একতলা বাড়ি তিনতলা করেছি, দুটো গাড়ি হয়েছে, একটাতে আমি অফিস যাই, একটা বাড়ির সকলে ব্যবহার করে, ড্রাইভার আছে, বাগানে মালি আছে, বাড়ির চার পাশে বাগান, ছাদের বাগান গৌরী দেখা শোনা করে, বিয়ের আট বছরে তিনটে প্রমোশন,কিন্ত.....

হ্যাঁ গুরুদেবের সেই কিন্তুর জবাব এখন পাচ্ছি। এই আট বছরে এখনো কোনো সন্তানের মুখ আমি দেখিনি, মা বাবা নাতি নাতনির আশায় মন্দির মর্জিদ সব করেছেন, সাধু সন্যাসীর কাছে হত্যে দিয়েছেন, ডাক্তার কবিরাজ করেছেন। কিন্তু কোন ফল হয়নি, গুরুদেবের কাছ থেকেও কোনো আশ্বস্ত হওয়ার মত প্রবচন শুনতে পায়নি তারা, তবুও তারা তাদের বৌমার পক্ষে কথা বলেন, আমি তাদের এই আচরণেও অসুখী নয়। আমি মাকে যতটা ভালোবাসি বউকেও ততটাই ভালোবাসি। 


গৌরী ঝটফট বলে চলে গেল, ইদানিং ওর একটু বাইরের দিকে মন হয়েছে, পাড়ায় কানাঘুসো  শুনি কোন এক ছেলের সাথে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, আমি বাজার করে এনে রান্নাঘরে মাকে দিয়ে,অফিসের একটা কাজ নিয়ে বসেছি, আমার গিন্নি অবন্তিকা, মাকে রান্না ঘরে,সাহায্য করে গৌরী না থাকলে, আজ গৌরী নেই তাই তার ডিউটি সেখানে,অফিস বেরবো দশটায়, তাই স্নান করে রেডি হতে হবে, ল্যাপটপ টাকে বন্ধ করে,বাথরুমে ঢুকতে যাবো, একটা ফোন এল ল্যান্ড ফোনে, ধরলাম -

- হ্যালো 

- থানা থেকে বলছি, গৌরী পোদ্দার নামে কাউকে চেনেন? 

থানার কথা শুনে বুকটায় ঢিপ করেই ওঠে, সে অন্যায় করো বা না করো। 

- কি হয়েছে স্যর?

- গৌরী কি আপনার বাড়ির কাজের লোক? 

- আজ্ঞে হ্যাঁ,

- তাহলে একবার থানায় আসতে হবে।

- হ্যাঁ আসছি স্যর। 

ছুটলাম সব ফেলে, থানায় - দুপুর দুটো বেজে গেল। থানার বড় বাবু খুব সজ্জ্বন ব্যক্তি, আমাকে খুব ঠান্ডা মাথায় বোঝালেন,

- মেয়েটিকে আপনারা কতদিন কাজে রেখেছেন?

- আজ্ঞে অনেকদিন, আমার বাবার আমল থেকে,

- ও আজ আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল, নৌকায় বেলুড়মঠ যাওয়ার পথে, নৌকা থেকে ঝাঁপ দেয়,একজন যাত্রী সাঁতারে খুব পটু, সেই তাকে বাঁচায়।

- ও এখন কোথায় আছে বলতে পারেন?

- হ্যাঁ তা পারি বটে। হাসপাতালে, পুলিশি হেপাজতে আছে, জানেন তো আত্মহত্যা আইনি অপরাধ? আপনি যদি চান দেখতে পারেন। ওর বাড়ির লোককে খবর দিতে বারণ করল, আপনাদের কথাই বলল। আরে মশাই এসব মেয়েদের ঘরে পোষা বড় দায়। পেটে বাচ্চা নিয়ে ঘূরে বেড়াচ্ছে। 

থানার বড়বাবুর কথা গুলো কানের পর্দা ভেদ করে মরমে প্রবেশ করল, আমি হতবাক। কি বলব বুঝতে পারছি না। 

- আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে, গৌরী !

- না মশাই মোটেও ভুল নয়। সব ওর থেকে শুনেন সব। বুঝতে পারবেন । 

ভাবতেই পারছি না, গৌরী এমন কাজ করলো কোত্থেকে? দেবীর মতো উজ্জ্বল পবিত্র একটা মেয়ে, তার এসব কি? কই এতদিনতো কই তেমন কিছু শুনিনি? 

আমি পুলিশের ভ্যানেই গেলাম, হাসপাতালে। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে পেছনেই এলো, ওকে আই সি ইউ তে রাখা হয়েছে, প্রথম দিকে খুব একটা ভালো অবস্থা ছিল না, এখন একটু ঠিক আছে, অনেকটা জল খেয়ে নিয়েছিল। 

ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললাম, বলল এখন ঠিক আছে নিয়ে যেতে পারেন, আমি ওকে জিগেশ করলাম

- কিরে এসব কি?

- দাদাবাবু মরা খুব কষ্ট।

কথাগুলো শুনে দারগাবাবু হাসতে লাগলেন।

- কষ্ট তো বটেই, এখন কি করবি?

- আমি তোমার সঙ্গে যাবো দাদাবাবু, ওরা নইলে আবার গলায় পাইপ ঢোকাবে, কি কষ্ট কি কষ্ট,ভেবেছিলাম জলে ঢুবে মরলে কোনো কষ্ট নেই,আমি আর ওকে অন্য কিছু জিগেশ করলাম না। সঙ্গে করে নিয়ে যাবো বলে দারগা বাবুর সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র সই সাবুত করে,ওকে নিয়ে গাড়ি তে উঠলাম, ড্রাইভার কে বললাম চলে যেতে, আমি গাড়ি চালিয়ে যাবো। গৌরীকে পেছনের সিটে বসতে বললাম, কিন্তু ও বসল না। সামনের সিটে বসে ধরা গলায় বকবক করতে লাগল। কি সব বলছে তার মাথা মুন্ডু বুঝতে পারছি না, 

-দাদাবাবু তোমার দুঃখ আমার সহ্য হয় না, কষ্ট হয়, 

- তাই তুই মরতে গেলি,

- না তা কেন? আমার পেটে যে বাচ্চা, শালা শয়তানের বাচ্চা বলল ভালোবাসি, ব্যস পেট করে দিয়ে পালিয়ে গেল, এখন কি করি? এটা জানতে পারলে মা আমাকে থাকতে দেবে না, তোমাদের বাড়ি, তাই -

- তুই বিয়ের আগে এমন করলি কেন? 

কোন উত্তর গৌরী দিল না। 

- কে সেই পাষন্ড? 

- আমার মাসির ছেলে।

- ছিঃ তুই নিজের মাসির ছেলের সঙ্গে।

- কি করব ও যে ছাড়ল না, ভাবলাম একবার তো কিছু হবে না, ব্যস বেঁধে গেল, 

- এসব বাজে কথা বলতে তোর লজ্জা করছে না?

- তোমার কাছে কি লজ্জা? তুমি তো আমার বন্ধুর মতো, এক সাথে খেলেছি, ঘুরেছি,

- করার আগেতো বলিস নি? 

- কি বলব গো? এসব বলা যায় নাকি? 

- এখন বলা যাচ্ছে?

- উপায় নেই যে, মরতেও পারলাম না। কি কষ্ট কি কষ্ট, বাবা আর মরতে যাই? যা হবার হবে, আমার বাচ্চাটাকে তুমি নাও না দাদাবাবু।


Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ