মহামতি কর্ণ

মহামতি কর্ণ
দেবপ্রসাদ

ফাটক সমীপে কোন যোদ্ধা যুদ্ধ করে?
ধূমেতে ধূসরবর্ণ, ভরিছে আকাশ 
প্রকট বিকট মূর্তি, মনে দৃঢ় জ্ঞান
কঠোর কূলিশ সম, কাহার হৃদয়?
কুরুক্ষেত্র মাঝে কেন ত্রাহি ত্রাহি রব
কে তুমি? মহা বিক্রমে করো ঘোররণ।
অর্জুন! অর্জুন তুমি, এখনে হেরিলে
বিপক্ষে দেখিয়া মোরে, উল্লাসে আসিলে।
তাহলে, সময় হলো, তোমার অর্জুন!
দ্বৈরথ মহা সমরে, উত্তর-ভূখণ্ড 
জুড়ে পরমায়ু দেখি, হন্তারক ছায়া,
বুকের নিভৃত থেকে উঠে আসে বুঝি
অরণ্যপিপাসা, হেথা সমস্ত শিকড় 
জুড়ে প্রতিহিংসা ঢালে, অবিরাম বিষ ;
এতদিনে, মহামতি পার্থ, এতদিনে
মুখোমুখি, মহারণ, তোমাতে আমাতে।
রশ্মি নয়, অস্থি দিয়ে, জ্বালাই যে আলো
পাথর চেরা স্রোতের মত ঋজু পথে
তিল তিল করে শোধ করছি জন্মের
অযাচিত ঋণ, ওহে মহামতি পার্থ
আশৈশব আকাঙ্ক্ষার ভেলায় বেয়েছি।
আজ সেই ধ্রুবলগ্ন, দেখো, সূর্য নয়
আমার পিতা প্রবীণ, সেই অধিরথ,
আজ ঘিরে আছে মোরে, এই মধ্যদিনে 
কুয়াশার জমকালো, কলঙ্কিত মেঘ।
কনিষ্ঠ আঙুলে ধরি সমগ্র পৃথিবী,
তবু কেন ব্যূহ ছেড়ে, গড়েছি প্রাচীর?
নেই একাঘ্নী আয়ুধ, কবচকুণ্ডল 
হৃত ছদ্মবেশী ইন্দ্র, ভিক্ষুকের হাতে,
আর নই, মহারথী,  জীবনের নেশা
বিলিয়ে দিয়েছি তাও গত গোধূলিতে।
অস্তমান সূর্যকে ঢেকে, সামনে আমার
মাতা কুন্তী ভিক্ষা চায়, পঞ্চপুত্র প্রাণ,
চোখের মিনতি তাঁর, তোমারই জন্য,
হে অর্জুন, বুঝেছিনু ততক্ষণে আমি।
সে মুহূর্তে জানিলাম, যদি জয়ী হই 
সারা জীবন আমাকে, বহন করতে-
হবে মহা অভিশাপ, আমার মাতার ;
এবার আসিল বুঝি সেই মহাক্ষণ 
তৃতীয় পাণ্ডব, এই দিনমান শেষে
বাজি রইল মোর, অভাগা জীবন, 
ধনুর্বাণ হাতে নাও, জুড়ে নাও তীর
এ-খেলায় পরিত্রাণ নেই কারো, পার্থ।
আমাকে একমুহূর্ত ভিক্ষা দাও ওহে
কৌন্তেয়, সারাশরীর মোর ভারি হয়ে 
আসছে পাথর সম, বড়ো দীর্ঘকাল 
অপেক্ষায় আছি তব, রণক্ষেত্র হতে 
কুড়াইব বিশ্বজয়ে, বীরত্ব সম্মান।
এতদিন সমবেত জনতার ক্রুর
অট্টহাসি, আচার্যের ব্যঙ্গ প্রত্যাখ্যান, 
তব বঙ্কিম বিদ্রুপ, ওহে পাণ্ডুপুত্র
দেখেছিনু যে প্রথম, সেই ক্রীড়াঙ্গনে
জানিতাম প্রতিদ্বন্দ্বী মোর কেউ নেই 
এই ভারতভূমিতে পার্থ, তুমি ছাড়া 
প্রবল স্পর্ধায় ছুঁড়ে দিয়েছি দ্বন্দ্বের 
আহ্বান, যখন বিনা যুদ্ধে, তুমি নিলে
শ্রেষ্ঠত্বের বরমাল্য, আরো একবার, 
আকাঙ্ক্ষিত নারীকেও তুমি নিয়েছিলে
আমারই অবনত দৃষ্টির সামনে।
অসিতাঙ্গী অগ্নিকন্যা, আমাকে ফিরিয়ে 
দিলেন সুতপুত্রকে বরণ করার 
অছিলায়, তবু স্থির আমি ছাড়ি নাই
মোর পথ। প্রতিবারে  মনের গভীরে 
উদ্ভাসিত প্রস্তাবিত,  আমি সুতপুত্র।
ভুলতে চেয়েছি আমি সেই পরিচয়।
অধিরথ দিয়েছিল স্নেহ, পুত্রবোধে-
সামান্য সে এক নারী, অক্লান্ত অবোদ্ধে
আমাকে পূর্ণ করেছে মাতৃত্ব- অমৃতে।
প্রতিমুহূর্তে তাঁহার সেই ভালোবাসা 
আস্বাদন করে করে আমি ভেবেছিনু
এই কি আমার স্থান অধিরথ গৃহে?
আমার আকাঙ্ক্ষা, সব আমাকে অর্জন 
করতে হয়েছে শুধু, মিথ্যার আড়ালে। 
ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে পাই শস্ত্রজ্ঞান,
বিদ্রপের প্রতিবাদে বজ্রমুষ্টি তুলে 
ছেড়ে আসি ক্রীড়াভূমি। দুর্যোধন
যাঁরে প্রতিপক্ষ করে, নিজ-বীরত্বকে
করিছ বিশ্ব বন্দিত, তার অনুগ্রহে 
আমি আত্মবঞ্চনার মোহে ছদ্মবেশে
বসি ছদ্ম-ক্ষত্রিয়ের  রাজ সিংহাসনে।
বিনিময়ে বিলিয়েছি মম স্বাধীনতা।
বিশাল সভাগৃহের মাঝে দুঃশাসন 
লোলুপ আঙুলে ছিঁড়ে নিচ্ছে দ্রৌপদীর 
লজ্জা, ক্ষণিকের জন্য আমার তুণীর 
থেকে তীর উঠেছিল হাতে, কাঙ্ক্ষিতার 
অপমানে, পরক্ষণে, করতালি ব্যস্ত 
হয়েছে এই দু-হাত, কেন? দুর্যোধন 
মম উপকারী বন্ধু, বড় অসহায় -
আমি। প্রতিটি মুহূর্তে যে দুর্যোধনের 
ভ্রুকুটি শাসন করে দিচ্ছিল আমার 
কর্তব্য, আমার নিজ স্বাভাবিকতাকে।  
অক্ষম আমার মন, ভীরুতাকে ঢেকে 
উচ্চরবে প্রচারিছে আমার শৌর্যের 
অহংকার। রণভূমে উড়িছে পতাকা
প্রাণপণে সযতনে রক্ষা করি তাই
নিরন্তর অকাতরে, বংশের নিশান।
এলো এই মহালগ্ন। তোমাতে আমাতে
মহাধুমে মহারণে হরিব আপন
ভ্রাতার জীবন, নয় দিবো মোর প্রাণ।
প্রত্যাবর্তনের কোনো পথ নেই আর,
দুইপক্ষ মহারণে, একদিকে আত্মা,
আমার মাতার পুত্র, পাণ্ডব তনয়।
অন্যদিকে অন্নদাতা, বন্ধু দুর্যোধন।
মাঝে আমি সুতপুত্র, রাধার সন্তান, 
একে অন্নের দাসত্ব, অন্যদিকে ঋণ
মাতৃঋণ, স্বেচ্ছাবৃত শৃঙ্খলের পাকে।
রণক্ষেত্র থেকে দূরে, ভাঙা এ কুটিরে, 
শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে যায় এক নারী, 
যার নাম রাধা, যার স্বামী সামান্যই 
রথের সারথি, ঠিক সেই দীর্ঘশ্বাস 
আমাকে ছুঁয়েছে, মৃদু হিমেল বাতাসে-
কানে ভেসে আসে, ওই কান্নার যে শব্দ,
দূর দক্ষিণ-সমুদ্রে, তরঙ্গ-উচ্ছ্বাস।
প্রতি সন্ধ্যা বন্দনার ছলে সরিয়ে দি
আমার অপরাধের ভার, প্রতিদিন-
গাঢ় হয়ে নামে দেখি শ্মশানের ছায়া ;
ফিরিব না তবু আমি যেখানে কর্তব্য।
নেই আত্মীয়-বান্ধব, ফিরিয়েছি নিজে
পরিবর্তে চেয়েছি যে, কৌরব-সম্মান,
যে ছিল স্বজন মোর, রূঢ় অস্বীকারে 
বিমুখ করেছি তারে, ভুলেছি স্বস্থান।
আমার অভ্যস্তবিদ্যা, আজন্মলালিত 
অস্ত্রজ্ঞান, তা অকেজো, মহারণক্ষেত্রে।
হে অর্জুন, রথচক্র গ্রাস করিতেছে -
অজান্তে আমার দ্বিধা, আর দ্বিমনতা।
বড়ো তৃষ্ণা পার্থ, ওষ্ঠ জ্বালি নেমে যাচ্ছে 
বুকের ভিতরে। পার্থ যুদ্ধে পরাজিত
আমি, আর কেন দেরি করো দুরাশয়
সামনে এসো অর্জুন অস্ত্র ধরো প্রিয়।
ধুমেতে ধুসর বর্ণে ভরিছে আকাশ
দেখিবে না কেউ, এবে অস্ত্রহীন আমি।
একটু সরে দাঁড়াও, আমাকে দেখতে 
দাও বিদায়বেলার সূর্য, প্রাণ ভরে,
আর কার মুখ ঝুঁকে পড়ছে চোখের 
উপর? কে তুমি? কৃষ্ণ, কহ কহ তবে
কেন মোর এই হাল? নক্ষত্র সভায়?
আজ কেন দিনকর প্রখর এমন
অলক্ত আরক্ত প্রভা, সাঁঝের সময়?
অম্বরে শোনিতছটা, শোনিত ভুতলে
যথা তথা মরে সেনা হাজার হাজার
মার্জনা করিবে কৃষ্ণ, পিতা অধিরথ ;
এবার অর্জুন, লহ তীর ধনুকেরে
রোপন করো বুকের ভিতরে আমার।
দূর গঙ্গাতীরে মোর নিস্তব্ধ কুটিরে
একাকিনী মা রাধারে, আমার প্রণাম।
কিবা দোষ কহ কৃষ্ণ মম কর্মভোগ
ধুলিতে মিশায়ে দাও, যত পাপ তাপ।

Comments

Popular posts from this blog

দুঃখটাকে এবার

মহাঋষি শুক্রাচার্য্য

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ