শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কয়েক বছরের জন্য সন্ন্যাস জীবন যাপন করেছিলেন। সময়টা আনুমানিক ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের প্রথমদিক। এই সময় তিনি হঠাৎ একদিন গৃহত্যাগ করেন। কেউ বলেন- তাঁর মায়ের আকস্মিক মৃত্যুতে তিনি খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। তাই বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি নিজের পিতার উপর অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
কেউ কেউ এমনও মনে করেন- ভাগলপুরের রক্ষণশীল নেতারা শরৎচন্দ্রকে একটি বিশেষ কারণে সমাজচ্যুত করেছিল। ফলে তিনি সেই সময় মর্মান্তিক আহত হয়ে ভাগলপুর ত্যাগ করেন।
কারণ যাই থাক না কেন। তিনি যে বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন এবং সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন তার বহুবিধ প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সময় তিনি সন্ন্যাসীর বেশে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। এমনকি নাগা সন্ন্যাসীদের দলে ভিড়ে গেলেন বেশ কিছু সময়ের জন্য। এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে একদিন তিনি মজঃফরপুরে এলেন। প্রত্যক্ষদর্শী নরেন্দ্র দেব এ প্রসঙ্গে তার 'শরৎচন্দ্র' গ্রন্থে লিখছেন-
"তাঁর মজঃফরপুর আগমন সম্বন্ধে স্বর্গীয় প্রমথনাথ ভট্টাচার্য মহাশয় বলেছিলেন- একদিন সন্ধ্যায় তাঁরা ক্লাবে জমায়েত হয়ে খেলা ও গল্পগুজব করছিলেন, এমন সময় একটি তরুণ সন্ন্যাসী সেখানে এসে পরিষ্কার হিন্দি ভাষায় সবিনয়ে লেখবার সরঞ্জাম প্রার্থনা করলেন। ক্লাবের একটি ছেলে দোয়াত কলম এনে দিল। সন্ন্যাসী ঝুলির ভিতর থেকে একখানি পোস্টকার্ড বার করে ঘরের এককোণে বসে নিবিষ্টমনে পত্র লিখতে শুরু করলেন।
ছেলেরা স্বভাবতই কৌতূহলী। ওরই মধ্যে একজন উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে নিলে সন্ন্যাসী চমৎকার বাঙ্গালা হরফে পত্র লিখছেন। ক্লাবের মধ্যে একটা কানাঘুষো শুরু হয়ে গেল, সবাই একটু চঞ্চল হয়ে উঠল এই তরুণ সন্ন্যাসীর পরিচয় নেবার জন্য। প্রমথনাথ ছিলেন এসব বিষয়ে অগ্রণী; তিনি পুরোবর্তী হয়ে সন্ন্যাসীঠাকুরের সঙ্গে আলাপ পরিচয় শুরু করলেন।"
মজঃফরপুরের এক ধর্মশালায় শরৎচন্দ্র থাকতে শুরু করলেন। রাত্রে নিজের মনে সেখানে ছাদে বসে গান গাইতেন। তাঁর সুরেলা মিষ্টকণ্ঠ ক্রমশ সেখানকার মানুষদের আকৃষ্ট করতে শুরু করল। তিনি ক্রমশই পরিচিত হয়ে উঠলেন নিজের নানা গুণের জন্য। অসহায় রোগীর পরিচর্যা করা কিংবা মৃতের সৎকার এসবের জন্য নিজের একটা জায়গা তৈরি করে ফেললেন মজঃফরপুরের সাধারণ জনবাসীর মনে।
সেখানকার জমিদার মহাদেব সাহু ছিলেন সঙ্গীতপ্রিয় ব্যক্তি। তিনি শরৎচন্দ্রের কথা বিভিন্ন লোকের কাছে শুনে তাঁকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিলেন। এই সময়ে তিনি 'ব্রহ্মদৈত্য' নামে একটি উপন্যাস লিখলেন। সময়টা ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিক। সেখানে থাকাকালীন একদিন পিতার মৃত্যুসংবাদ অবগত হয়ে তিনি ভাগলপুরে ফিরে যান। উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপি ওই জমিদারের কাছে তিনি রেখে এসেছিলেন। পরে সেটি আর পাওয়া যায়নি। পিতার মৃত্যুর পর তাঁর জীবন অন্য আরেকদিকে বাঁক নেয়।
শরৎচন্দ্রের মেজভাই প্রভাসচন্দ্র পরবর্তীকালে স্থায়ীভাবে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন বৃন্দাবনে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের অধ্যক্ষ। তাঁর নাম ছিল স্বামী বেদানন্দ।
শরৎচন্দ্র তখন সমতাবেড়ের বাড়িতে বসবাস করতেন। প্রভাসচন্দ্র আশ্রমের কী এক কাজে রেঙ্গুন গেলেন। ফিরে এসে তিনি আশ্রমে না গিয়ে সরাসরি দাদার কাছে গেলেন। পরের দিন সেখানেই দেহত্যাগ করলেন। এ ব্যাপারে লীলারাণী গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা শরৎচন্দ্রের একটি চিঠি থেকে জানা যায়- "...আমার মেজভাই প্রভাস সন্ন্যাসী ছিলেন, বোধ করি শুনিয়া থাকিবে। তিনি দিনকয়েক পূর্বে বর্মা হইতে ফিরিয়া মঙ্গলবার রাতে অসুখে পড়েন। ক্রমাগতই বলিতে লাগিলেন, বারম্বার অসুখে এ দেহ অপটু হইয়া পড়িয়াছে, ইহা পরিত্যাগ করাই প্রয়োজন। পরদিন বেলা একটায় ঘর ও বিছানা ছাড়িয়া নিজে বাহিরে আসিলেন এবং আমার বুকের উপর মাথা রাখিয়া দেহত্যাগ করিলেন।"(১৩৩৩ বঙ্গাব্দ, ১৩ই কার্তিক)
বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ যাদুকরী লেখক শরৎচন্দ্রের জীবন ছিল ঘটনাবহুল। তিনি কান পেতে মানুষের বুকের শব্দ শুনতে পেরেছিলেন।
সংগৃহীত
#novelas
#follower
#everyone
#viralpost
#foryou
#fb
#love
#kolkata
#india
Comments
Post a Comment