প্রহর
প্রহর
দেবপ্রসাদ
ছাপ্পান্ন !
না তেমন কিছূ নয়,
আমার বয়স।
এবার প্রহর গোনার সময়।
জীবনটাই তো, উত্তাল প্রহরসমুদ্র।
কখনো দোলা দিচ্ছে,
কখনো অকূলে ভাসিয়ে বান ডাকছে,
আবার ভাটার টানে স্রোত সরে গেলে-
সামনে ধূ ধূ চর।
আবার উজানভাটায় নৌকার গুন টানিয়ে নিয়েছে।
আমি আশ্চর্য হয়ে দেখি,
নৌকায় নির্জনে যে লোকটি বসে আছে,
ফিনফিনে ধুতি পাঞ্জাবি পোরে সেই মানুষটি,
নৌকার মোটা কাছির কাঁধে নুয়ে পড়া মানুষটি,
সেই আমি!
শরীরের বয়স যার তিন কুড়ি হতে চলল।
প্রচুর গাছপালা নিয়ে ছিমছাম বাড়ি,
নামটার মধ্যেও নতুনত্ব-গোলকধাম।
লেখক কবি সাহিত্যিক সৌমেন চৌধুরীর বাড়ি।
কাছাকাছি থাকি তাই ছুটিছাটায়-
একবার দেখা করার চেষ্টা থাকে।
সেবারে গিয়ে দেখলাম,
একজন সন্ন্যাসী এসেছেন ওদের বাসায়।
সৌম্য, গৌরবর্ণ চেহারা, স্মিত হেসে কথা বলেন।
সেই সন্ন্যাসীর সাথে, আমার তেমন কোনো,
অন্তরঙ্গ বহিরঙ্গ কথা হল না। ঘনিষ্ঠতা হল না,
অথচ তিনি আমার জীবনের যাবতীয় প্রহরগুলো, দাড়িপাল্লায় মেপে দিলেন।
কপালের ভাঁজে ভাঁজে লেখা ছিল কিনা জানি না,
তবে ঘরে পড়ন্ত বিকেলে-
আমার মস্তিষ্কের সমস্ত বোধপর্বকে
আমূল নাড়িয়ে দিয়ে
বললেন-
'প্রদীপের তো তেল ফুরিয়ে আসছে।'
'আপনি কী মৃত্যুর কথা বলছেন ?'
'বুঝতে পেরেছ তা হলে' জীবনের দোসর।
'মৃত্যু কোনোদিন দোসর হয় এ তো শুনিনি মহারাজ?'
হয় দোসর হয়-
ঝরে পড়া পালকের শব্দ শুনতে পাও কখনো?
না-
হেমন্তে শিউলির ঝরে পড়ার শব্দ?
শিশিরে ভেজা শিউলির আর্তনাদ?
না তাও না,
আমি হাসলাম,
ফুল পালক ঝরে পড়ার শব্দ কোনোদিন শোনা যায়?
যায়, শোনা যায়, প্রতিটি প্রহরে প্রহরে শোনা যায়।
মশার গান শুনেছ?
শুনেছি কানের কাছে আসলে শোনা যায়,
হ্যাঁ কানের কাছে আসলে -
শীতের রাতে কান পেতে রেখো,
শুনতে পাবে শিউলির খসে পড়ার আর্তনাদ,
পালকের আর্তনাদ - প্রহর শেষ হয়ে এলো,
এবার মনের কান দিয়ে শুনতে চেষ্টা করো,
মৃত্যু আসার আগে ভেতরে যে আর্তনাদ হয়-
শুনতে পাবে দোসরের কান্না।
আমি সাধারণত এসব গুরুটুরু নিয়ে -
ভাবিনি কোনোদিন।
কি জানি কেন হঠাৎ মনে হলো প্রণাম করি একবার।
দাঁড়িয়ে হাতটা পায়ের কাছে নিতে একটু কষ্ট হলে,
উনি আমার দুই কানের পাশে হাত রাখার সঙ্গে
মনে হলো শরীরে শিহরণ খেলে গেল।
প্রথম প্রহর
দেবপ্রসাদ
শুধু ঝরা পালকের প্রতিশব্দ জেগে রইল,
এক নমনীয় হিমজা আলোর অস্ফুটে।
সে আলোর চপল ইশারায় আমোদিনী শিউলির বন, ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে পড়ল ছেনাল হাওয়ায়,
সেই আশ্চর্য হিম অন্ধকারে জেগে থাকে শিউলি।
শিউলি চোঁয়ানো অন্ধকারে হা-নগ্ন-
একা পাগল বাতাস।
অন্ধকারে জেগে থাকে বেওয়ারিশ শিউলি।
শিউলির সরল মনের ওপর চলে বাতাসের পরকীয়া।
আলো-আঁধারি ভোরের বাগানে আলোরীণা শিউলি, তার কিশোরী শরীরে একটু একটু করে ফুটে ওঠে-
নম্র কুসুমকলির অমল আভাস।
সোঁদামাটি নাভি জুড়ে তার অপরূপ স্থাপত্য।
শিউলির মনে পড়ে যায়,
গতরাতের প্রতিটা মিথুনমুদ্রার সোহাগ জ্যামিতি।
ওর বুকের গহন থেকে দলা দলা লজ্জা,
একটা চুপি চুপি সুখ কেমন আলতো চারিয়ে যায় শরীরের প্রতিটা রক্ত-নলির আনাচে-কানাচে।
কিভাবে যেন পোয়াতি রাতের পেট খসিয়ে -
আরো একটা বেজন্মা ভোর।
সদ্যজাত সূর্য,
চঞ্চল মোহময় তার নরম গোলাপী অবয়ব।
শিউলি বনে কুয়াশিত সেই ভোরে,
প্রত্যন্ত কুসুম আলোর অবকাশে -
অবলীলায়িত লীলার সব অবৈধ ছবির,
নীলাভ শীৎকারে কেটে ছিল কাল সারারাত।
দ্বিতীয় প্রহর
তখন আমার তিরিশ।
বেসরকারী অফিসে সামান্য বেতন।
আমার স্ত্রী অনুরাধা বিয়ের আগে মডেলিং করত,
বিয়ের পরে বন্ধ।
আমিই বন্ধ করে দিয়েছিলাম।
অফিসে কিছু উপরি পয়সা ছিল।
হোম লোন নিয়ে বছর চারেকের মধ্যে
দু কাঠা জমি কিনে, একটা বাড়ি উঠল,
কিন্তু লোন শোধ হল না,
ঋণের বোঝা চেপে বসল ক্রমাগত।
পাগলের মতো অবস্থা।
অগত্যা অনুরাধা ফিরে গেল তার পুরনো পেশায়।
পরিচিত জায়গা।
বছর খানেকের মধ্যে নানা টিভি সিরিয়ালের নায়িকা। ব্যস্ত জীবন।
সেই জীবনের আনাচে কানাচে কষ্ট- সুখে ভরে উঠতে-
আমাদের পরস্পরের দূরত্ব বেড়ে গেল।
সংসারটা আর সংসার রইল না।
অনুরাধা রাত করে বাড়ি ফিরতে শুরু করল।
জিজ্ঞেস করলে একটাই উত্তর- শ্যুটিং ছিল।
আউটডোর শ্যুটিংয়ের নামে নানা জায়গায় চলে যেত, বাড়ি ফিরত না।
সেই দোসর, যে কিশোরবেলায় পা টিপে টিপে এসে দাঁড়িয়েছিল বুলাদিদের ছাদঘরে, ছাদের কার্নিশে,
আবার এসে দাঁড়াল আমাদের মাঝে।
Comments
Post a Comment