সেইদিন রাতে
বড় সাহেব যখন আমার ব্লাউজের
বোতাম খুলছিলেন, তার চোখে আমি
লোভাতুর চকচকে দৃষ্টিতে সে আমার শরীর দেখছে। হয়তো আমার চোখে তাচ্ছিল্যের কোন ভাব ছিল,সম্ভবত ঠোঁটের কোনাটাও হাল্কা বেঁকে গিয়েছিল। কারণ সে হঠাত আমার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। আমি তাড়াতাড়ি ভয়ে কুঁকড়ে ওঠার ভান করে বুকের ওপর হাত গুটিয়ে আনলাম। সে কি বুঝলো কি জানি। এবার লোভাতুর চোখের সাথে যুক্ত হলো অশ্লীল হাসি। আমি ভয়ের ভান করে জিজ্ঞাসা করলাম,আমার সাথে কি করবেন বড় সাহেব? সে জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁট চেটে বললো, ও তুম আভি দেখোগে।
যদিও আমি তাকিয়েই ছিলাম,কিন্তু আসলে আমি কিছুই দেখিনি। তাকে কোন বাধাও দেইনি। শুধু কিছুক্ষণ পর পর ব্যথায় শরীরটা কুঁকড়ে যাচ্ছিল,কিন্তু তাও চোখে জল আসতে দেইনি। শুধু শরীরটাই দূষিত হচ্ছিল,কিন্তু মন ঠিকই জানতো,এই ঘরের ঠিক পেছনে এই মুহুর্তে সোহাগ লুকিয়ে আছে। এভাবে কতক্ষন কাটলো জানিনা। কতবার যে আমাকে দুষিত করলো তাও বলতে পারবো না। বড় সাহেব আমার চুলের মুঠি ধরে মেঝেতে আছড়ে ফেলার পর আমার ঘোর ভাঙে। সে শোয়ার কাপড় পড়ে ঘুমাতে গেল। রাতের খাবারের পর সে এক বোতল মদ খেয়েছে,এখন বেঘোরে ঘুমাবে।আমাকে দিয়ে তার আপাতত প্রয়োজন শেষ,তাই আমি কি করবো এটা নিয়ে সে চিন্তিত না। তাছাড়া সে জানে,ঘরের বাইরে একজন আর মাঠে দুইজন সেন্ট্রি আছে,তাই আমার পক্ষে পালানোও সম্ভব না। রক্তাক্ত আমি, ঘরের এক কোনায় বস্ত্রহীন অবস্থায় চুপচাপ বসে রইলাম। আধা ঘন্টা পর বড় সাহেব ওরফে মেজর ওয়াসিমের নাক ডাকার আওয়াজ পেলাম।
আমি বেলি, এখন যে ঘরটায় আমি আছি,সেটা আমার স্কুলের প্রিন্সিপালের অফিস ছিল। বর্তমানে পাকিস্তান সেনা ক্যাম্পের কমান্ডারের ঘর। অন্যান্য ক্লাসরুম গুলো সৈনিকদের ব্যারাক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমি আর সোহাগ এই স্কুলে একই সাথে পড়তাম। এই স্কুলের প্রতিটা কোনা আমাদের মুখস্থ। এরপর কলেজ,আর এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও একসাথে পড়ি। সোহাগ আমার বাগদত্তা। গত এপ্রিলে আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার কারনে বিয়ে পিছানো হয়। আমরাও ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে আসি।কিন্তু গ্রামের অবস্থাও খারাপের দিকে যেতে থাকলে আমাদের পরিবার বর্ডার পার হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
একরাতে সোহাগ আমার কাছ থেকে বিদায় নিতে আসে,মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবে বলে। আমার তখন কষ্টে বুক ভেঙে আসছিল। আমিও জোর করি ওর সাথে যাওয়ার। সোহাগ যেন চমকে ওঠে,মাথা নেড়ে বারবার জানায়, এ সম্ভব না! পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কোন মেয়েদের ছেড়ে দিচ্ছেনা। তা সে যে ধর্মেরই হোক। আমি ওকে বললাম যে,আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারবো না। ও আমাকে আশা দিচ্ছিল, স্বাধীন দেশে আমাদের বিয়ে হবে। আমাদের সুন্দর একটা সংসার হবে। আমি হঠাত প্রশ্ন করে বসলাম,যদি তুমি না ফিরে আসো,তাহলে এই স্বাধীন দেশে আমি কি নিয়ে বেঁচে থাকবো? সোহাগ চুপ হয়ে যায়, আমি জানতাম ওর কাছে এই প্রশ্নের উত্তর নেই।
আমি আরো আধাঘণ্টা ঝিম মেরে পড়ে রইলাম।এরপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম। ব্যথায় শরীর ভেঙে যাচ্ছে। দাঁড়াতেও পারছিনা ঠিকমত। আস্তে আস্তে হেটে রুমের কোনায় রাখা, ঝোলা গুড়ের কলসির ভিতর হাত ঢুকিয়ে চাকুটা বের করে আনলাম। বুদ্ধিটা অবশ্য বারী ভাইয়ের। বারী ভাই হচ্ছেন আমাদের এলাকার মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার। আমাদের গ্রামেরই ছেলে।আর সোহাগ তার সেকেন্ড ইন কমান্ড। সেই রাতে সোহাগের সাথে পালিয়ে যখন মুক্তিক্যাম্পে এলাম,বারী ভাই উচ্ছসিত হয়ে আমাকে মুক্তিবাহিনীতে রিক্রুট করে নিলেন। তিনি আমাকে বললেন,বিশ্বাস কর বেলি,তোকে দেখে যে আমার কি পরিমান শ্রদ্ধা হচ্ছে! তোর এত সাহস!!! আমি আসলেই তোকে নিয়ে খুব গর্ববোধ করছি রে,তুই আমার গ্রামের মেয়ে! সবাই আমাদের ভুলে গেলেও তোকে সারা দেশ চিনবে!
বারী ভাইয়ের কথায়,মনোবল অনেক বেড়ে গেল। আর সাথে সোহাগ তো আছেই! এভাবে বেশ কিছুদিন কাটলো ট্রেনিং নিয়ে। তারপর যেদিন স্কুলে বানানো ক্যাম্পে অভিযান চালানোর কথা হচ্ছিল,সেদিন সবাই বেশ চিন্তিত ছিল। ক্যাম্পে ঢোকাটা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল,কারণ এই ক্যাম্পে সেনাসদস্যদের সংখ্যা অনেক বেশি। সবার আলোচনা শুনে আমি প্রস্তাব দিলাম যে আমি তাদের ভেতরে যাওয়ার রাস্তা করে দেব। সোহাগ বুঝলো আমি কি বলতে চাইছি। সে চমকে উঠে আমার আমার হাত চেপে ধরলো। জিজ্ঞাসা করলো,তুই কি বলছিস বুঝতে পারছিস বেলি? আমি খুব ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞাসা করলাম,আমাকে যেতে দিবি না? আমাদের জন্য? আমাদের দেশের জন্য? ওর চোখে শুধু দুফোঁটা জল দেখেছিলাম। তবে সেটা গড়িয়ে পড়ার আগেই ও মুছে ফেললো। হাসিমুখে বললো,আমাদের ভবিষ্যতেও জন্যও তো!
বারীভাই এতক্ষন মাথা নিচু করে বসে ছিলেন। এরপর আস্তে আস্তে আমাদের প্ল্যান বুঝিয়ে দিলেন। চাকুটা বের করে আমি শাড়ি দিয়ে ভালোভাবে গুড়গুলো পরিষ্কার করে নিলাম। এরপর বড় সাহেবের খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। আশ্চর্য, আমার কোন ভয় লাগছে না। শুধু পাশের বাড়ির ছয়বছরের মায়ারানীর খুবলে খাওয়া রক্তাক্ত দেহটার কথা মনে পড়ছে। বড় সাহেবের নাকি কচি মেয়ে পছন্দ,তাই ছয় বছরের বাচ্চাকেও ছাড়েনি। এইতো স্কুলের সামনে পুকুর পাড়ে ওর লাশটা পড়েছিল কেউ নিতে আসেনি। দুই দিনের দিন হয়তো শেয়াল এসে নিয়ে যায়। আমিও এই পুকুর পাড় দিয়ে গুড় বিক্রির নাম করে হেটে যাচ্ছিলাম। পাহারারত সৈনিক যখন আমাকে ডেকে জেরা করছিল,তখনই বড় সাহেব আমাকে ডেকে পাঠান। আমিও তাই চাইছিলাম,সেজন্যই তার দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য উঁচু গলায় কথা বলছিলাম। ক্যাম্প কমান্ডার ভাবছিল, আমি বাকিদের মত অমত করবো, হাতে পায়ে ধরে প্রান ভিক্ষা চাইবো। কিন্তু আমি উল্টা রাস্তার মেয়েদের মত বিচিত্র অংগভংগি করে তার মনোরঞ্জনের চেষ্টা করতে লাগলাম। কথায় কথায় গুড়ের হাড়ি থেকে একটু গুড়ও তার মুখে দিয়ে দিলাম। তার লোভী চোখ আমার এলোভাবে পড়া পাতলা সুতি শাড়ি ভেদ করে আমার শরীর উপভোগ করতে লাগলো। আমাকে তার রুমের ভেতরে নিতে বেশিক্ষন লাগলো না।
নাহ, চোখ বন্ধ করিনি। বরং খোলা চোখেই বড়সাহেবের গলায় অবলীলায় চাকু চালিয়ে দিলাম। সে বিষ্ফোরিত চোখে চেয়ে দেখলো আমার ঠোঁটের কোনে একটুকরো হাসি। চিৎকার করা তো দূরে থাক,তার গলা থেকে ঘরঘর জাতীয় আওয়াজ ছাড়া আর কোন আওয়াজ বের হলো না। কিছুক্ষন জবাই করা মুরগীর মত খাটে দাপাদাপি করলো,তারপর সব চুপ। একেবারেই চুপ।আমি অবশ্য দাপাদাপির আওয়াজে চিন্তিত হলাম না।কারণ দরজার বাইরের সেন্ট্রি হয়ত ভাবছে,সাহেব লীলা খেলায় ব্যস্ত,তাই এত শব্দ। আমার শরীর রক্তে মাখামাখি। কোন রকম শাড়িটা গায়ে ফেলে,রক্ত মুছে আস্তে করে দরজা খুললাম। সেন্ট্রিটা বোধহয় ঘুমিয়ে ছিল। ধরমর করে উঠে বসতে আমি তাকে বললাম যে, সাহেব তাকে ভেতরে ডাকে। তাকে ভেতরে নেয়ার পর বাকি কাজটা আর কঠিন কিছু ছিল না।
এলোমেলো শাড়ি পরে এবার সৈনিক ব্যারাকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটা রুমে কিছু সৈন্য তাস খেলছে।আমি তাদের সামনে এমনভাবে দাঁড়ালাম, যেন ভুল করে চলে এসেছি। তারা এম্নিতেই মনোরঞ্জনে ব্যস্ত ছিল।আমি তাদের সামনে যাওয়াতে তারা যেন আরেকটা খোরাক পেয়ে গেল। একদল হায়েনা যেমন অন্য পশুর ঝুটা খাবারের জন্য ওত পেতে থাকে,ওরাও তেমন যেন ওত পেতে ছিল। চোখের পলকে আমি আবার বিবস্ত্র হলাম।যে যেভাবে পারছে আমাকে ছুড়ে, ছিড়ে, খুবলে খাচ্ছে।আমি চোখের সামনে অন্ধকার দেখতে পাচ্ছিলাম।মুহুর্তেই জ্ঞান হারাবো।
এরমধ্যেই শুনলাম সেই কাঙ্ক্ষিত শব্দ,"সকাল"----আমাদের কোডওয়ার্ড। প্ল্যান অনুযায়ী এই শব্দ শোনার পর আমার প্রথম কাজ হবে মেঝেতে শুয়ে পড়া। তারপর গড়িয়ে গড়িয়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়া। আমি সাথে সাথেই মেঝেতে শুয়ে পড়লাম।কিন্তু একচুল নড়তে পারলাম না। ক্লান্তিতে শরীর যেন আর চলছে না। মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র যেন ঘরের ভেতরে আগুনের ফুল্কি তুলছে। বুলেটের আওয়াজে সারা স্কুলঘর কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঘুমন্ত সৈনিকদের ব্যারাকে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে,ঠিক যেমন ওরা সাধারণ নিরীহ মানুষগুলোর ঘরে দিয়েছে। তবে যারা বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিল,তাদের জন্য বাড়তি হিসেবে গ্রেনেড ছোড়া হয়।
হঠাত দেখি দরজার বাইরে যেন সূর্য্য উঠছে আর সোহাগ আমাকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে। আমি রক্তাক্ত শাড়িটা কুড়িয়ে, ধীরে ধীরে দরজার দিকে গড়িয়ে গড়িয়ে এগোতে লাগলাম। বাইরে এসে বুঝলাম আলোটা সূর্যের ছিলনা,ব্যারাকের আগুনের ছিল। আমি কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালাম । আমার পরবর্তী গন্তব্য পুকুরের দক্ষিণ পাশের তালগাছের নিচের ঝোপ থেকে ১০০ গজ পূর্বে। যেতে আমাকে হবেই। আমাকে যেতেই হবে! টলমলে পায়ে হোঁচট খেতে খেতে হাটতে শুরু করলাম। ক্লান্তিতে,কষ্টে চোখ বারবার বুঁজে আসছে। টলতে টলতে পড়েই যাচ্ছিলাম,কোথাথেকে যেন একজোড়া হাত আমাকে ধরে ফেলে। চোখ বুঁজেও বুঝলাম,এ সোহাগ ছাড়া আর কেউ না।একরাশ কান্না যেন গলায় দলা পাকিয়ে গেল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, দেখেছিস,বলেছিলাম না পারবো?
সোহাগ আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,আমরা পেরেছি রে! আমরা একসাথে পেরেছি!!!
আমি সোহাগের কাধে মাথা এলিয়ে দেই। ইশ, ভালোবাসার স্পর্শে কি আনন্দ!!!
সংগৃহীত……………
Comments
Post a Comment